Ads

বারাক ওবামার দৃষ্টিতে নৈতিক অবক্ষয় ঠেকাতে মূল্যবোধ কেন প্রয়োজন?

শারমিন আকতার

আমাদের প্রথমে জানা দরকার “মূল্যবোধ” জিনিসটা আসলে কি?

মূল্যবোধের সংজ্ঞা কি? মোতাহার হোসেন লিখেছেন: মূল্যবোধের লক্ষণ হলো ‘নিকটবর্তী স্থূল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে আনন্দপ্রদ সুকুমারবিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ জানা এবং তাদের জন্য প্রতীক্ষা ও ক্ষতি স্বীকার করতে শেখা’ আর যুক্তিবিচার হলো ‘জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা’।

জাপান প্রবাসী লেখক তৌফিক আহমেদ ২২ মার্চ ২০১৭ তে “মূল্যবোধসুশিক্ষা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট” নামক প্রবন্ধে লিখেছেন-

“অষ্টাদশ শতকের ফরাসিদের মধ্যে যে দুটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য কাজী মোতাহার হোসেন দেখেছিলেন তা হলো মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার। ঊনবিংশ শতকের চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশের দশকেও এই দুটি বৈশিষ্ট্য বাঙালিদের মধ্যে তিনি খুব একটা দেখতে পাননি। আর এ নিয়ে তাঁর মধ্যে এক ধরনের আক্ষেপও ছিল। কালের পরিক্রমায় এখন ১৬ কোটি বাঙালির দেশ বাংলাদেশে মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচারের যে করুন দশা চলছে, তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তা দেখে তাঁর কি ধরনের অভিব্যক্তি হতো সে কথা ভাবলে নির্বাক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। অবস্থা তথৈবচ। অর্থকড়ি, ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা থাকার পরও শুধুমাত্র মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচারের অভাব থাকায় সেসব মানুষদের দেখলে নিতান্তই গরিব বলে মনে হয়। এ যেন সবকিছু থাকলেও বহু দরকারি কী যেন নেই, অলংকারবিহীন নববধূ!”

মূল্যবোধের কথা বলতে গিয়ে আমেরিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন-

“আমেরিকানদের সাথে কথা বলে কিছু সময় কাটালেই বুঝা যায়, ধর্মপরায়ণ মানুষগুলো অনেক বেশী সহনশীল । সবচেয়ে সেকুলার মানুষটিও সবচেয়ে বেশী আধ্যাত্মিক । …তাই আমেরিকানদের মধ্যে  গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধটি অভিন্ন- সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে এখন। ২০০৪ সালে নির্বাচনের পারপরই দেশ জুড়ে চালানো এক ‘এক্সিট পোল’ বা জনমত সমীক্ষার ফল প্রকাশ পায় । এতে বেশিরভাগ উত্তরদাতা বলেন, ভোট দেয়ার সময় তাদের চিন্তায় সবচেয়ে বেশী কাজ করেছে নৈতিক মূল্যবোধ ।”

(পৃষ্ঠাঃ৪৫-৪৬, দ্য অ্যডাসিটি অব হোপ)

তবে সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের রকমফেরের মাধ্যমে এই মূল্যবোধ আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হতে থাকে । কিছু পরিবর্তন মঙ্গলজনক আবার কিছু পরিবর্তন কিছুটা হতাশাজনক ।

বারাক ওবামা তার দ্য অ্যডাসিটি অব হোপ গ্রন্থের মূল্যবোধ অধ্যায়ে বলেছেন-

“একেকজনের হাতে পরে এই মূল্যবোধের বিকৃতি ঘটে ।তাই আমরা মূল্যবোধের মধ্যে সংঘাত দেখি । এতে আত্ননির্ভরতা ও স্বাধীনতা রূপ নিতে পারে কার্পণ্য ও অবাধ্যতায় । উচ্চকাংখা পরিণত হতে পারে লোভে এবং স্বাভাবিক ইচ্ছা পরিণত হতে পারে যে কোন মূল্যে সফল হওয়ার উদগ্র বাসনায় । …(পৃষ্ঠা-৫১, দ্য অ্যডাসিটি অব হোপ)

আজকাল টিভি চ্যানেলগুলো যেন আমাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত যে নিজস্ব মূল্যবোধ আছে সে মূল্যবোধকে অপসারণের চেষ্টা করছে নানাভাবে বিভিন্ন কায়দায়-

“সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টেলিভিশনে যৌনতা দ্বিগুণ বেড়েছে বলে এক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করে কাইজার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন । এরপর সেখানে এক বক্তৃতায় অংশ নেই আমি । এইচবিও চ্যানেলটি আমি বেশ উপভোগ করি । ব্যক্তিগতভাবে কে ‘অ্যাডাল্ট প্রোগ্রাম’ দেখছে তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই । কিন্তু শিশুদের বেলায় কি হবে? তারা টেলিভিশনে কি দেখছে তার উপর নজর রাখার দায়িত্ব বাবা-মায়ের । বক্তৃতায় আমি বলেছি টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে সন্তানের সাথে কোন বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দিলেও দেখবেন অনেক ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে ।

পাশাপাশি আমি এটাও বলেছি, মেয়েকি পাশে বসে নিয়ে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখার সময় ১৫ মিনিট পরপর ‘গোপনাঙ্গ সতেজ করার’ বিজ্ঞাপন কতটা সুখকর হতে পারে?তরুণদের আকছে প্রিয় কিছু অনুষ্ঠান কিভাবে প্রজন্মটিকে মদ্যপ ও বিবস্ত্র হয়ে বাথটাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করছে- এগুলো নিয়েও গবেষণা হওয়া দরকার । বাড়িতে সন্তানদের নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়, এমনভাবে অনুষ্ঠান সম্প্রচারে টিভি ও ক্যাবল কোম্পানিগুলোর প্রতি আহবান জানাই । ” (পৃষ্ঠা-৫১, দ্য অ্যডাসিটি অব হোপ)

বারাক ওবামার দৃষ্টিতে এই মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে বা পুনরুদ্ধারে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ জরুরী মনে করেন । তিনি ত্রেনেই গ্রন্থে বলেছেন-

“আমরা যে সমাজ গড়তে চাই তা গড়তে সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন ও সরকারের পদক্ষেপ এবং মূল্যবোধ পরিবর্তন ও নিতি বদল দুটোই প্রয়োজন । আমরা স্কুলগুলোর দিকে তাকালেই বুঝব, সব টাকা সেখানে ঢালা হলেও একটি শিশুর মনে কঠোর পরিশ্রমের মূল্যবোধ ঢুকিয়ে দেয়া যাবে না । এর সাথে যুক্ত হতে হবে বাড়িতে বাবা মায়ের প্রচেষ্টা । আর এখানেই আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করছি নিজেদের মূল্যবোধের সাথে ।

এই একটি জিনিসই আমাকে ডেমোক্রাট বানিয়েছে । আমাদের সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ, পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সংহতির যে চেতনা, তা কেবল গীর্জা বা মসজিদে গিয়ে আওড়ালে হবে না; কেবল বাসা, কর্মক্ষেত্র অথবা আমাদের পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না- এই চেতনা কাজ করতে হবে সরকারের মধ্যেও । অনেক কনজারভেটিভের মতো আমিও ব্যক্তিগত সাফল্য ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য সংস্কৃতির শক্তিতে বিশ্বাসী । পাশাপাশি এটাও বিশ্বাস করি, এই বিপজ্জনক  সময়ে আমরা আমাদের সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছি ।  সংস্কৃতির ভালো মন্দ রূপায়নে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও বিশ্বাস আছে আমার ।”

(পৃষ্ঠা-৫৩, দ্য অ্যডাসিটি অব হোপ)

“আত্নোপলব্ধির জন্য আমরা এসব সত্যকে  ধারণ করে আছি- সব মানুষ সমানভাবে সৃষ্ট, সৃষ্টিকর্তা কিছু অনপনেয় কিছু অধিকার দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাদের । এগুলো হল- জীবন, স্বাধীনতা ও সূখের সন্ধান ।”

(পৃষ্ঠাঃ ৪৬, দ্য অ্যডাসিটি অব হোপ)

আমেরিকান সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন মূল্যবোধের অনুসরণ না করাটাকে । মূল্যবোধ লালান না করার মানসিকতাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন তার এই গ্রন্থে । তিনি  বলেছেন-

“আজকের আমেরিকানদের দেখে মনে হয় ধনী হওয়া, মেদ কমিয়ে তারুণ্য ধরে রাখা, বিখ্যাত হওয়া, নিরাপদ থাকা আর আনন্দ উপভোগ করা ছাড়া তাদের আর কোন মূল্যবোধ নেই । আমরা মুখে বলি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্য রেখে যাওয়ার মূল্যবোধে বিশ্বাস করি আমরা । কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পর্বতসম ঋণ ছাড়া কিছুই রেখে যাচ্ছি না । বলি ‘সুযোগের সমতায়’ বিশ্বাসী; কিন্তু লাখ লাখ আমেরিকান শিশুকে দারিদ্রের মধ্যে দিনাতিপাত করতে দেখেও নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকি আমরা । পারিবারিক মূল্যবোধ লালনের দাবী করি আমরা । কিন্তু অর্থনীতিকে এমনভাবে তৈরি করেছি। যেখানে পরিবারের জন্য সময় বের করাটাই দুরূহ হয়ে উঠেছে আমাদের জন্য ।

আমাদের মূল্যবোধগুলো বিলুপ্তির পথে হলেও আমরা এগুলো নিয়ে গর্ববোধ করতে ভালবাসি । অথচ মূল্যবোধগুলো অনুসরণের পরিবর্তে সেগুলোর সাথে প্রতারণা করে চলেছি । এই মূল্যবোধ অনুসরণই এই জাতিটিকে দিকনির্দেশনা দিতে পারে ।”

(পৃষ্ঠা-৫৭, দ্য অ্যডাসিটি অব হোপ)

কলেজের একটা ওপেনিং সেশনে বারাক ওবামা বলেন তিনটা বিষয়ে তার মা সব সময় তাকে বলতেন-

১) যারা তোমার চেয়ে কম সৌভাগ্যবান তাদের প্রতি দয়া পরবশ হও, তাদের প্রতি যত্নশীল এবং তাদের জন্য উপকারি হয়ে উঠো ।

২) একজন  উস্কানিদাতা হব আর পরিবর্তে একজন শান্তি স্থাপনকারী হিসাবে নিজে গড়ে তোল ।

৩) জনগণকে নিচে নামানোর পরিবর্তে উপরে তুলে ধরার চেষ্টা কর ।

বারাক অবামার দৃষ্টিতে একটি জাতির অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য তাদেরকে অবশ্যই মূল্যবোধের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে । মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে কখনই কোন উন্নয়ন বা সমৃদ্ধি সত্যিকার অর্থে সম্ভব না ।

লেখকঃ

সম্পাদক, মহীয়সী

আরও পড়ুন