।। শহীদ সিরাজী ।।
দেশের তাপমাত্রা যা-ই থাক সূর্য এবং আবহাওয়া বেশ ফেভার করছে। এ সময়ে ইউরোপের এমন অদ্ভুতুড়ে আচরণ ! এশিয়ার সাথে প্রেমে পড়লো না-কি! অবাকই হচ্ছি! জার্মানির বাসিন্দা জামাই আরিফও অনেকটা বিস্মিত! দীর্ঘ অভিজ্ঞতা যার গায়ের চামড়াকে ভুগিয়েছে সে সত্যি বিস্মিত। হেসে বলল,
“এমন প্রথম দেখছি! অনেকদিন ধরে দেখিনি। এ সময় জার্মানিতে সূর্যের দেখা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম এবার। যদিও তাপমাত্রার উপরে সূর্যের দেখা না দেখা নির্ভর করে। এবার কিন্তু ব্যতিক্রম। কম তাপমাত্রা তবুও সূর্যের আলো পড়ছে চতুর্দিকে।”
সত্যি অপূর্ব! বলা যায় রোদ মাখা দিন। মান্না দে’র গানের কথা মনে পড়ছে,
পৌষের কাছাকছি রোদ মাখা সেই দিন
ফিরে আর আসবে কি কখনো!
আসলে এমন দিনে কবি আর কাব্যের ঘটে মেলবন্ধন।
শুনেছি এখানে সামারে সকলে আনন্দের গ্ল্যামার খুলে বসে। সপ্তাহের পাঁচদিন দু’হাতে যা কামাই তা নিয়ে আবার ছুটে যায় উইকেন্ডে দুই হলিডে তে দুহাতে ওড়াতে। এভাবেই নাকি তাদের হৃদয় জুড়ায়। তাদের পরকালের ধারণা নড়বড়ে বলে ইহকালের দিন কাটে কড়কড়ে নোট ওড়ানোর কাজে। আমরা যখন জার্মানিতে ঢুকেছি শুনেছি সেই ইভেন্টে নাকি ওভার! অথচ এই শেষ অক্টোবরেও বসন্ত তার প্রেম বিলিয়ে যাচ্ছে!
অবশ্য প্রথম দিনের আমাদের অভিজ্ঞতা অনেকটা গ্রাম থেকে আসা গো বেচারার মতো। কদিন আগে যখন জার্মানিতে প্রবেশ করি তখন এয়ারপোর্ট বার্লিনের রাস্তায় নেমে টের পেয়েছিলাম শীত কাকে বলে। হয়তো শীত বুড়ি তার লোটা কম্বল হারিয়ে ফেলেছিল তাই হাড় কাঁপানো শীতে নেমে পড়েছিল রাস্তায়। আমরাও শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে গাড়িতে চড়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল আহা ঠান্ডা কেমন ভাবে ডাণ্ডা পেটাচ্ছে আমাদের উপরে! ইউরোপকে বললাম, ওহে ইউরোপ! ভাবেই আমাদের অভ্যর্থনা করলে তুমি!

তবে বেগম সাহেবা অনেকটা সবজান্তা যেন। আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। জার্মানিতে যেতে হবে শুনেই সেই অফ-সিজনেই সোনারগাঁ জনপথ রোডের সব ডাকসাইটে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির শোরুমে গিয়ে একদিন হাজির হয়েছিলেন। ইনফিনিটি , গুডউইল, জেন্টেলপার্ক, আর্টিসান, ওয়াইজম্যান সব ঘুরেফিরে শেষে আর্টিসানে মার্কেটিং এর ভাগ্যটা নির্ধারণ করেছিলেন। আমি সঙ্গ দিতে দিতে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরছিলাম। হবু নাতি, মেয়ে, জামাই এবং আমরা; সকলের জন্যই শীত যুদ্ধে জেতার জন্য কিনেছিলাম যুদ্ধাস্ত্র শীতবস্ত্র। আর এখন এখানে এসে দেখি রোদ ঝলমল দিন যদিও ঠাণ্ডা নামের দৈত্যটা এখনো সেভাবে উদয় হয়নি।
আসলে জার্মানির আবহাওয়া এশিয়ার মত নয়; একটু ভিন্ন প্যাটার্নের। অনেকে এটাকে বলে সেন্ট্রাল ইউরোপীয় প্যাটার্ন। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত উষ্ণ এবং সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঠাণ্ডা।
বাংলাদেশকে যেমন বলা হয় ষড়ঋতুর দেশ এখানে তেমন নয়। এখানে ঋতু হচ্ছে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। বসন্তকাল মার্চ, এপ্রিল ও মে মাস। গ্রীষ্মকাল জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত। শরৎ সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাস। এবং শীতকাল ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। যারা জার্মানি মানে ইউরোপ ঘুরতে চান তাদের জন্য উপযোগী সময় হচ্ছে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর তখন তাপমাত্রা থাকে সহনীয়।
আমরা কিন্তু অক্টোবরের শেষে এসেও পাচ্ছি সেপ্টেম্বরের আবহ।
আরও পড়ুন-
অভিজ্ঞতায় জার্মান মেহমান-
দুপুর। আরিফের বাসায় জার্মান মেহমানের আগমন ঘটলো। একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আরিফের কলিগ। তার ইউনিভার্সিটি ডিপার্টমেন্টাল সেক্রেটারি। নানু ভাইয়ের জন্য অনেক রকম গিফট নিয়ে এসেছে। গেস্ট বেশ আন্তরিক স্মার্ট পরিশ্রমী মিশুক। অবাকই হলাম কারণ বাংলাদেশে যা দেখেছি তা থেকে সত্যিই ভিন্ন কিছু। জার্মানির এক প্রখ্যাত ইউনিভার্সিটির একজন সিনিয়র বস তার জুনিয়র কলিগের বাসায় আসে নবজাতককে দেখতে চমৎকার সব গিফট নিয়ে! এসেছেন আবার নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে। ব্যাগগুলোও নিজে বহন করে সরাসরি গেটে এসে কলিং বেল বাজিয়েছেন।
অথচ আমাদের দেশে কি ঘটে? এখানে মানুষ এতটাই ব্যস্ত এবং আত্মকেন্দ্রিক; তারা এসব করার সময় পাবে কোথায়! কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম যদিও আছে। তার পরেও বলব জার্মানিতে এটা ব্যতিক্রমই। আরিফ মেহমানদারী ব্যবস্থা করেছে। আমার মিসেস সহযোগিতা করলো। পাশে বসে আমি তাদের কথা শুনছি। গেস্ট জিজ্ঞাসা করলো,
“বাংলাদেশ আর জার্মানির ভিতরে কোন পার্থক্য দেখছেন?”
ভাবলাম ওরা কি জানি কি উত্তর দেয়। পার্থক্য অবশ্যই অনেক। বাংলাদেশে ফজরের আজান শুনে মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। কৃষকরা মাঠে ছুটে লাঙ্গল জোয়াল গরু নিয়ে। মায়েরা ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের খাবার-দাবার রেডি করা, পোশাক পরানো। এরপর স্কুলে নিয়ে যাওয়া। এইসবই তো প্রাত্যহিকতা। আর এখানকার অবস্থা কি তা এখনো জানি না; তবে শুনেছি যা তা কোন কোন ক্ষেত্রে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক।
আতিথেয়তার টেবিলটা দেখি মেয়ে ও মা মিলে সাজিয়ে বাংলাদেশ বানিয়ে ছেড়েছে। শীতের আবহে পিঠা এবং তার স্বগোত্রীয়দের মিলনমেলা বসেছে যেন। কোন ফাঁকে পায়েসও এসে চুপসারে দেখি বসে পড়েছে টেবিলে।
মেহমান কিন্তু যথেষ্ট সপ্রতিভ। কথায় প্রশংসার সূক্ষ্ম প্রকাশে তার মার্জিত ব্যক্তিত্বের পরিচয় প্রকাশ করলো। তাদের খুশিটা অল্পক্ষণের জন্য তিনজনের মহিলা অঙ্গন হয়ে উঠলো। আমি বেচারা পুরুষ একটু দূরে বসে অবস্থার নাড়ি টিপছি। কথাবার্তায় এবং তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলছে তারুণ্য তাকে আলিঙ্গন করে রেখেছে। অবশ্য মেয়েদের স্বরূপ বর্ণনা করা কোন পুরুষের ভব্যতা নয়। তবে ৬৫ বছরের চোখে মুসলমানিত্বের পর্দা ঢেকে থাকারই কথা।

দূর থেকে শুনছি গল্প। মেহমানের প্রশ্ন ছিল , বাংলাদেশ আর জার্মানির ভিতরে কোন পার্থক্য দেখছেন?”
উত্তরে বেগম সাহেবা বললো, “তেমন পার্থক্য নেই কারণ আমরা একই আকাশের নিচে বসবাস করি। তবে দেশ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হতেই পারে।”
মামণি তাকওয়া বললো,”মানুষ হিসেবে ভিতরটা একই রকম হয়তোবা আমাদের। তবে ড্রেসআপ আলাদা।”
সুন্দর জবাব দিয়েছে ওরা। মনে হলো খুশি হয়েছেন মেহমান। বিদায়ের সময় সকলকে হ্যালো বলে মুসাফা করে গুডবাই জানালেন তিনি।
মেহমান চলে গেছেন। আমার মনটা কেন যেন সব ক্ষেত্রে উঁকিঝুঁকি মারে। কবি তো! জীবনের টুকিটাকি নিয়েই যত তার আঁকিবুঁকি, এসবই তো তাদের উপজীব্য বিষয়। জার্মানিতে আসলাম এখানকার পারিবারিক জীবন কেমন তা জানবো এটা কেমন হবে? সুতরাং জিজ্ঞাসা করলাম। জার্মানদের লাইফস্টাইল কেমন?
আরিফ বলল, ‘বাংলাদেশ থেকে সব না হলেও কিছুটা ভিন্নতর।”
জিজ্ঞেস করলাম, “সেটা কেমন?”
আরও পড়ুন-
আরিফ বলল,
“পুরোপুরি বাস্তব লাইফ লিড করে তারা। এক উইকলি হলিডেতে অভিজ্ঞতা হয়ে ছিল আমার। একবার বস বললেন চলো কোথাও ঘুরে আসি। অফিসের বড় বস; আমারও ছুটি সুতরাং সাথে গিয়েছিলাম। শুধু ম্যাডাম নয় সাথে হাসবেন্ড ও তার সন্তান। দীর্ঘ সময় তাদের সাথে ছিলাম। দেখলাম ছেলেকে স্বাধীনভাবে সব কিছু করতে দিচ্ছে কোন সহযোগিতা করছে না। সোজাসুজি বললে বলা যায় তাকে দিয়ে নানা কাজ করাচ্ছে। আমার কাছে কাজের আচরণ অনেকটা দয়া মায়াহীন মনে হচ্ছিল। একটা কাজে তাকে হেল্প করতে এগিয়ে গেলে ম্যাডাম নিষেধ করলেন, বললেন তাকে করতে দাও। বাচ্চা ছেলে আমার খারাপ লাগছিল তবুও মেনে নিতে হয়েছিল।”
আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ম্যাডাম নিষেধ করছিলেন কেন?”
আরিফ বলল,
“তখন আমার খারাপ লাগলেও পরে বুঝেছি জার্মানিদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। তারা সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই নিজের কাজ নিজেকে করতে অভ্যস্ত করে তোলে। কারো উপর নির্ভরশীল না হয় সেই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এর ফলে তারা নিজেরা সব কাজ শেখে। আমাদের দেশের মত ছেলে বায়না করে না। কোন কাজ করবে না বলতে পারে না। তারা ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত নিতে শেখে এবং নিখুঁতভাবে কাজ শেষ করতে পারে যদিও প্রথমে অসুবিধা হয় তবুও এভাবেই তারা গড়ে ওঠে।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ” চমৎকার তো! এখানে সকলেই কি এমন?”
“হ্যাঁ, জার্মানিরা এমনই। এখানে কারা জার্মানি এবং কারা বহিরাগত আচরণ দেখলেই বোঝা যায়।”
জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন?”
সে বলল, “পাশে এক ইন্ডিয়ান দম্পতি বাস করেন প্রতিদিন বাসে করে অফিসে যেতে তাদেরকে দেখতে পাই। দেখি সাথে একটা ছোট সন্তান। আমাদের দেশের মতো বরাবরই বাবা অথবা মা তাকে স্কুলে নিয়ে যায় নিয়ে আসে।”
বললাম, “উনি ঠিকই তো করেন। বাচ্চাকে রাস্তায় একা কি ছেড়ে দেওয়া যায়?”
আরিফ বলল, “এটাই পার্থক্য আমাদের দেশের সাথে জার্মানির। এখানে কখনোই দেখবেন না জার্মানিরা বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং আসছে। স্কুলে যাওয়ার বয়স হলেই তাদেরকে স্কুলে দেওয়া হয়। অল্প কয়েকদিন সাথে যায় কিন্তু তারপর বাচ্চা নিজে নিজেই স্কুলে যায় এবং আসে।”
এখন মনে পড়ছে। ঠিকই তো! প্রতিদিনই দেখি ছোট ছোট বাচ্চারা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে একা একা স্কুলে যাচ্ছে। কখনো বা ফিরছে তাদের সাথে কখনো । কখনো গার্জিয়ান দেখিনি।
অবাক হয়ে বললাম, “এখানে কোন দুর্ঘটনা ঘটে না যেমন হারিয়ে যাওয়া কিংবা কোন বাচ্চাকে অপহরণ করার মত ঘটনা?”
আরিফ বলল, “এমন ঘটনা ঘটা পুরোপুরি অসম্ভব। এখানে আইন খুবই কড়া। জালের মত ছড়ানো আছে সিকিউরিটি ক্যামেরা। বাচ্চা হারানো তো দূরে থাক; কারো কোন জিনিস কোথাও হারিয়ে গেলে অল্প সময়ের মধ্যেই সেটা ফিরে পাবে । কেউ সেটা স্পর্শ করবে না।”
আমি অবাক হচ্ছি, সত্যি অবিশ্বাস্য ঘটনা! ইউরোপীয় কান্ট্রি জার্মানিতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এ এক বিস্ময়কর অবস্থা! আমাদের দেশে এটা বিশ্বাস করাও কঠিন!
যে ইসলাম জনগণের মান সম্ভ্রম সুরক্ষা শিখিয়েছে আমরা মুসলমান হয়েও তা দেশে বাস্তবায়ন করতে পারিনি অথচ এরা ইসলাম না মেনেও এটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।
(ভ্রমণকাব্য: ইউরোপের পথে প্রান্তে, ভ্রমণ কাল : ২৬/১০/২৪)
লেখকঃ কবি , সাহিত্যিক এবং সাবেক এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।