।। মানসুরা আক্তার ।।
ইউনিভার্সিটিতে মাইগ্রেশন বিষয়ে চারদিনের একটা কনফারেন্সে ফুলটাইম এসিস্ট্যান্ট দরকার। এসিস্ট্যান্স এর বিনিময়ে আমি পেতে পারি কনফারেন্সে ফ্রি একসেস+সার্টিফিকেট, প্রতিদিন আট ঘন্টা কাজের বিনিময়ে পঞ্চাশ ইউরো করে মোট দুইশো ইউরো সম্মানী, আর খাওয়া-দাওয়া। বর্তমানের বেকার আমার জন্যে উত্তম প্রস্তাব। এইখানে বলে রাখা ভালো যে পর্তুগিজদের খাবার বেশ সুস্বাদু। বিশেষ করে পর্তুগিজ ডেজার্ট আইটেমগুলো খুবই ভালো। এসিস্ট্যান্স এর প্রথম দিনে কনফারেন্স অর্গানাইজার প্রফেসর জানালেন যে আমাদের কাজের সুবিধের খাতিরে প্রথম দিনের লাঞ্চ এসিস্ট্যান্ট লাউঞ্জেই পৌঁছে দেওয়া হবে, এগিয়ে ক্যান্টিনে যাওয়া লাগবে না। আমি ভেবেছিলাম যে হয়তো ক্যাফেটেরিয়া থেকে কেউ ট্রলিতে করে খাবার নিয়ে আসবে। কিন্তু আসলে দুই প্রফেসর বিরাট দুইটা শপিং কার্টে করে খাবার নিয়ে এসে যখন সার্ভ করলেন, আমার তখন দেশের কথা মনে পড়লো।
কনফারেন্স রুমগুলোতে হাসিখুশি প্রেজেন্টার আর সেশন চেয়ারদের সাথে কথা বলে বলেও খুবই ভালো লাগলো। মাইগ্রেশনের মতো এতো রসালো বিষয়, যা আমার একদম মনের মতো, তা নিয়ে দেশ-বিদেশের স্কলারদের ভাবনাগুলো জানতে পেরে বুকের মধ্যে কেমন অভিমানী ঢেউ খেলছিলো। আসলে প্রেজেন্টাররা নিজেরাই এতোটা দক্ষ যে মূলত তাদের তেমন কোনো এসিস্ট্যান্স এর প্রয়োজন নেই। আমি শুধু তাদের এইটুকু সহযোগিতা করছিলাম যে তারা কনফিউজড ছিলেন যে কখন স্ক্রিন শেয়ার করতে হবে, আর কখন পাওয়ার পয়েন্ট শেয়ার করা ভালো হবে! এই সামান্য সহযোগিতায় তারা এতো প্লিজড হয়ে যাচ্ছিলেন যে আমি আরো বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিলাম। এই কনফারেন্স আমার জন্যে আসলে পুরোটাই আনন্দ। কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিনে অর্গানাইজাররা জানালেন যে প্রচুর লাঞ্চ-স্ন্যাকস বক্স বেঁচে গেছে যেগুলো আমরা এসিস্ট্যান্টরা নিয়ে যেতে পারি, যার যতো খুশি। আমি জানালাম যে আমরা তো লাঞ্চ খেয়েছি! তখন সেই অর্গানাইজার জানালেন, “ডিনারের জন্যে নিয়ে যাও, ফ্যামিলির জন্যে নিয়ে যাও!” আমার তখন আবার দেশের কথা মনে পড়লো।
আরও পড়ুন-
দেশে আমার কর্মস্থলে একবার একটা কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠানে বড়ো একটা কেক আনা হলো, আর সেই সাথে কিছু স্ন্যাকস, জুস ইত্যাদি। সেই কোর্সের যিনি কো-অর্ডিনেটর ছিলেন, তিনি বিরাট কর্মকর্তা। তো, ভদ্রলোক ঘুরে ঘুরে স্টাফ দেরকে বারবার ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলেন যেন কেকের পিস ছোটো করা হয়, জুসের গ্লাস ছোটো দেওয়া হয়। অনুষ্ঠান শেষে বেশ কিছু খাবার বেঁচে গেলো, যেগুলো তিনি অফিসের পিয়নকে দিয়ে প্যাকেট করিয়ে গাড়ির বুটের মধ্যে রেখে বাসায় নিয়ে গেলেন। শুধু আনারসের জুসটা নিলেন না, কারণ ঐটা তার বাসায় কেউ খায় না!
আরেকবার মনে আছে আমি চাকরিতে প্রমোশন পেলাম। তাই অফিসের সিনিয়র-জুনিয়র সহকর্মী সকলের জন্যে একটা আয়োজনের ব্যবস্থা করতে চাইলাম। আমার সেই অফিসে চমৎকার প্যান্ট্রি ছিলো, প্রফেশনাল শেইফ ছিলো। সেই শেইফ ও প্যান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর আমার অফিসরুমে এলেন খাবারের মেন্যু, সদস্য সংখ্যা, মোট খরচ এইসব আলোচনা করতে। তার করা লিস্টে সব শিক্ষক-কর্মকর্তার নাম আছে, কিন্তু অফিসের স্টাফদের গোনা হচ্ছে না দেখে আমি ভাবলাম যে উনি ভুলে তাদের গুনছেন না! আমি পিয়ন, অফিস সহকারীদের কথা মনে করিয়ে দিলাম, তখন খাবারের কো-অর্ডিনেটর জানালেন যে তাদের প্যান্ট্রিতে অফিসার লেভেলের নিচে কারো জন্যে খাবার সার্ভ করার নিয়ম নেই। অত্যন্ত হতবিহ্বল আমি নিজস্ব পয়সায়ও তখন স্টাফদেরকে একই মেন্যুর খাবার খাওয়াতে পারিনি, বরং তাদের হাতে আলাদা করে পয়সা দিয়ে দিয়েছিলাম যেন তারা পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানি-কোক এগুলো কিনে নিয়ে এসে খায়!
সেই অফিসের প্যান্ট্রিতে প্রফেশনাল শেইফরা লাঞ্চ রান্না করতেন। সেই খাবার খাওয়ার জন্যে এলিজিবল ছিলেন ষষ্ঠ গ্রেড ও তদুর্ধ মানের কর্মকর্তারা। প্রথমে যখন নবম গ্রেডে লেকচারার হয়ে জয়েন করি, তখন আমার সেই প্যান্ট্রিতে লাঞ্চের এন্ট্রি ছিলো না। তাই পরে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হয়ে ষষ্ঠ গ্রেডে উন্নীত হওয়ার পরেও আমার আর ঐ প্যান্ট্রিতে লাঞ্চ করার প্রবৃত্তি হয়নি।
আরও পড়ুন-
দেশে আমি মোটামুটি সম্মানজনক একটি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতাম। এই ধরনের কনফারেন্সে সহযোগিতা করা কিংবা কখনো কখনো নেতৃত্ব দেওয়াটা আমার মূল কাজেরই অংশ ছিলো। অথচ এই চমৎকার কাজটি করতে গিয়ে সেখানে আমি প্রচণ্ড হয়রান হয়ে যেতাম আর তটস্থ হয়ে থাকতাম কেবল এই ভয়ে যে কখন যেন কি ভুলত্রুটি হয়ে যায় আর উচ্চপদস্থ কেউ আমাকে হেনস্তা করার সুযোগ পেয়ে যান্! প্রায়ই এমন হতো যে যারা আমার চেয়ে উপরের পদমর্যাদায় আছেন, তারা পদে পদে স্মরণ করিয়ে দিতেন যে তাদের চাকুরির গ্রেড কতো বড়ো!
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পর্তুগালে বসবাসকারী বাংলাদেশী
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।