।। জিয়াউল হক ।।
প্রখ্যাত আলেম ও ইমাম; ইমাম শা’ফি রহ-এর স্মৃতি বিজড়িত মসজিদে আসারের নামাজ আদায় শেষে যে দৃশ্য দেখেছি, তা আমার মনে এক স্থায়ী দাগ কেটে গেছে, সে কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। এর কারণ আমি একজন সচেতন বাংলাদেশি।
বাংলাদেশে আমাদের মধ্যে বাহ্যিক আড়ম্বর, বেশ ভুষা, লেবাস আর সুরাত দেখে ইসলাম আর ঈমান মাপার এবং সেই অনুপাতে মানুষের সাথে, স্বজাতী মুসলমানদের সাথে লেনদেন ও ব্যবহার করার ধারা গড়ে তুলেছি, তা একজন বাংলাদেশি হিসেবেই আমি খুব ভালো করে জানি। আপনারাও তা জানেন।
জানা সেই ধারণা আর পরিচিত সেই সব দৃশ্যের বিপরীতে আমি মিশরীয় সমাজে যা দেখেছি, তা খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে এবং আমার বিশ্বাস, যে কোনো সচেতন বিবেকবান মানুষের মনে দাগ কাটবে। তাকে ভাবতে বাধ্য করবে। এবং অতি অবশ্যই লজ্জায় ফেলবে।
আসরের নামজের সালাম ফেরানোর পরে সামান্য কিছুটা সময় দোয়া, দরুদ আর তাসবিহ তাহলিল করছি আর এদিক ওদকে নজর বুলিয়ে নিচ্ছিলাম মাঝে মধ্যে। উপস্থিত মুসল্লীদের মধ্যে এক ধরণের প্রাণচাঞ্চল্য বেশ ভালো ভাবেই লক্ষণীয়। কিন্তু ব্যাপারটা কি সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। খেয়াল করে দেখলাম মুসল্লীদের মধ্যে হতো কিশোর কিশোরীরা এক কোণে গিয়ে গোল হয়ে বসে পড়লো যার যার হাতে কুরআনের একটি করে কপি নিয়ে। মিম্বরের কাছেই ইমামের সাথেও কিছু পৌড় বসলেন একইভাবে। তারা সবাই কুরআনের অধ্যায়নে বসে পড়লেন।
আরও পড়ুন-
এ্ ঘটনা সুধী পাঠকের উদ্দেশ্যে বিগত একটি পর্বে উল্লেখ করেছি। এ ঘটনার পাশাপাশি যে বিষয়টি আমার মন ও মননে এক বিরাট ধাক্কা দিয়েছে সেটি হলো, যে উস্তাদরা কুরআন নিয়ে এইসব জমায়েতগুলো পরিচালনা করছিলেন, তাদের লেবাস, বেশ ভুষার বিষয়টা।
মসিজদের যিনি ইমাম, তাকে দেখেই বুঝা যায় যে তিনি একজন আলেম। অপরদিকে মাত্র দুই জন হাফেজ বালক নিয়ে এক কোণে বসে বাচ্চাদুটোর হেফজ পরখ করছিলেন যিনি, সেই তাকেও দেখেই বুঝায় যায় যে,তিনি একজন আলেম।
কিন্তু সবচেয়ে বড় যে জমায়েত; আট থেকে বারো বা তের বছরের জনা’কুড়ি শিশু কিশোরের জমায়েত, সেটি পরিচালনা করছিলেন এমন একজন মধ্যবয়সী মিশরীয় লোক, যার বেশ ভুষা পোশাক আশাক দেখে বুঝার উপায়ই নেই যে তিনি একজন আলেম। তাকে দেখে সাধারণ একজন শ্রমিক শ্রেণির মিশরীয় কর্মজীবি মানুষ ছাড়া দ্বিতীয় কিছু ভাববার কোনো সুযোগই নেই।
অথচ তিনি যে আবেগ, যে সুতীক্ষ্ণ কড়া মনোযোগী দৃষ্টি দিয়ে বাচ্চাদের তেলোওয়াত শুনছিলেন, যে পরম মমতা আর দক্ষতায় তা শুধরে দিচ্ছিলেন, তাঁর কন্ঠে কুরআনের যে মনকাড়া মূর্ছনা, তা যে কোনো শ্রোতাকেই উন্মন করে দেবে।
তার কন্ঠে কুরআন যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল বার বার। অনেকটা নিজের অজান্তে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলে ইশারায় এক ছেলেকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিতে বললেন । আমিও চেয়ারটায় মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বসে পড়লাম। শুনতে লাগলাম তার কন্ঠে কুরআন, দেখতে লাগলাম পরম মমতায় তিনি কী দক্ষতার সাথে কুরআনের তেলোওয়াত শুদ্ধ করে দিচ্ছেন তার ছাত্রদের। যতক্ষণ না সেই ছাত্র সঠিকভাবে তা রপ্ত করতে পারছে, ততক্ষণ তিনি বারবার তা রিপিট করছেন।
আরও পড়ুন-
ঠিক সেই মহুর্তে ওদের সামনে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছিল। লজ্জা আর অনুশোচনায় নিজের ভেতরেই নিজে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম যেন। তীব্র এক বেদনায় ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল।
মাথায় তার টুপি নেই, মুখে নেই দাঁড়ি, নেই আলেমসূলভ বাহারি বেশ ভূষণ, কে বলবে যে তিনি আলেম! কিন্তু সেই তিনিই কুরআনকে কীভাবে রপ্ত করেছেন ! সুবহানাল্লাহ।
আচ্ছা, আমাদের দেশের কোনো একটি মসজিদে যদি এই বেশে দাঁড়িবিহীন কেউ কয়েকজনকে নিয়ে কুরআন হাতে বসতেন, তা হলে আমরা তার সাথে কেমন আচরণ করতাম? তার সামনে কী আমাদের বাচ্চাদের কুরআন শেখার জন্য বসতে দিতাম? সম্ভবত না।
কারণ আমাদের কাছে ভেতরের সৌন্দর্যের চেয়ে বাহ্যিক সৌন্দর্য, জ্ঞানের চেয়ে জ্ঞানের প্রদর্শন, আ’মলের চেয়ে লেবাসের আর কাজের চেয়ে কথার দামই যে বেশি!
লেখকঃ ইংল্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও লেখক, ইংল্যান্ড
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।
ফেসবুকে লেখক জিয়াউল হক