Ads

কৈশোর স্বাস্থ্য ও সুস্থতা জরিপ

 

কৈশোর স্বাস্থ্য ও সুস্থতা জরিপ

“রাস্তায় কিশোরীদের যৌন হয়রানি বেশি”

কদিন আগে একটি বহুল প্রচলিত দৈনিকের রিপোর্টে আমার চোখ আটকে যায়। আমি কি একাই কিশোর কিশোরী সমন্বয়ে বসবাস করি? আমার মতো বয়সী যারা তাঁরা প্রায় সকলেই মনে হয় এ অবস্থানে আছেন। তাই এ বিষয়ে আমাদের সকলের প্রস্তুতি আর সাবধানতার প্রয়োজন আছে।
আমাদের দেশের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোতে স্বামী ও স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান সবচেয়ে বেশি। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৭২ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরীর পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি হিসেবে খাওয়ার বড়ি সম্পর্কে ধারনা আছে। কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় রাস্তায়।
বাংলাদেশের কৈশোর স্বাস্থ্য ও সুস্থতা জরিপ ২০১৯-২০এ বিবাহিত ও অবিবাহিত মেয়েদের সম্পর্কে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে দেখা গিয়েছে ২৭ শতাংশ কিশোরী ২২ বছর বা তার বেশি বয়সে বিয়ে করতে চায়। প্রতি পাঁচজন বিবাহিত মেয়ের একজন স্বামী থেকে পৃথক থাকতে হয় গত ১১ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার জাতীয় জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) আর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এ জরিপ করেছে। এতে সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি, যুক্তরাজ্যের সহায়তা সংস্থা ইউকে এইড আর যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটা ফর ইম্প্যাক্ট নামের প্রকল্প। কিশোর কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিয়ে দেশব্যাপী এত বড় জরিপ এর আগে আর হয়নি। জরিপে যে সকল বিষয় দেখা হয়েছিলো তা হলো,জেন্ডার বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি, বিয়ে,গণমাধ্যম ব্যবহার, পরিবার আর বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগ, মানসিক স্বাস্থ্য, সহিংসতা ও হয়রানি, পুষ্টি, মেয়েদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধি ইত্যাদি। জরিপে বলা হয়েছে বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সকে কৈশোর হিসেবে ধরা হয়। এ বয়সীরা আমাদের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ। জরিপটিতে বেশ কিছু স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকার কারনে অনুমোদনের জটিলতা তৈরি হয়। এজন্য ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের জরিপ থেকে আলাদা করা হয়। প্রায় বিশ হাজার কিশোর কিশোরীদের মধ্যে এ জরিপ কাজ চালানো হয়েছে। বিবাহিত ও অবিবাহিত ছেলে মেয়েরা এ জরিপে অংশ নিয়েছিলো। ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচটি ধাপে এর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ১২৬ জন তথ্য সংগ্রহকারি ১৮ টি দলে বিভক্ত হয়ে সারাদেশে এ জরিপ পরিচালনা করে। বন্ধুরা চলুন এবার জানার চেষ্টা করি জরিপের কিছু ফলাফল ;
২৯২ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে জানা গিয়েছে ৫ হাজার ৬৬ জন বিবাহিত কিশোরীর তথ্য। দেখা গিয়েছে অধিক ক্ষেত্রে স্ত্রীর চেয়ে স্বামীর বয়স ১০ বছর বা তারও বেশি। বিস্ময়কর বিষয় হলো, স্বামী স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য হতদরিদ্র শ্রেনীর মধ্যে কম। পার্থক্য বেশি ধনী পরিবারগুলোতে। ১৮ শতাংশ কিশোরী বলেছে তাদের স্বামী একসাথে থাকে না। অর্ধেকের স্বামী বিদেশে। স্বামী বিদেশে থাকার হার সবচেয়ে বেশি সিলেট অঞ্চলে। এ অঞ্চলের ২০ শতাংশ কিশোরীর স্বামী বিদেশে অবস্থান করে। জরিপ বলছে, দেশের কিশোর কিশোরীদের অধিকাংশই শারিরীক ও মানসিক যৌন নির্যাতনের শিকার। বিবাহিত ও অবিবাহিত কিশোর কিংবা কিশোরী কেহই বাদ যাচ্ছে না বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন থেকে। কিশোরেরা কিশোরীদের তুলনায় মৌখিক বা সামাজিকভাবে বেশি নির্যাতনের শিকার। বিবাহিত কিশোরীরা স্বামীর হাতে, অবিবাহিত কিশোরীরা মায়ের হাতে আর অবিবাহিত কিশোরেরা বন্ধু ও সহপাঠীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সাইবার বুলিং আর তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নির্যাতনের শিকারের মাত্রাও উদ্বেগজনক। কিশোরীরা নির্যাতিত অজ্ঞাত ব্যক্তির দ্বারা আর কিশোরেরা তার বন্ধু বা অজ্ঞাত ব্যক্তি দ্বারা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেছেন, তীব্র মানসিক বিষন্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা জরুরি। বিবাহিত ১৫ শতাংশ ও অবিবাহিত ১১ শতাংশ কিশোরী আর ৫ শতাংশ কিশোর তীব্র মানসিক বিষন্নতায় আক্রান্ত। এদের মধ্যে যারা উচ্চ শিক্ষিত তাদের বিষন্নতা কম। অন্যদিকে বিবাহিত কিশোরী যাদের বন্ধু বা অন্য কারো সাথে যোগাযোগ বেশি তাদের বিষন্নতার হার উচ্চ।
জরিপে কিশোর কিশোরীদের উচ্চতা, ওজন,খাবারের মান, আয়রন বা ফলিক এ্যাসিড সেবন করে কিনা তা দেখা হয়েছে। বিবাহিত কিশোরীদের ৩৬ শতাংশ আর অবিবাহিত কিশোরীদের ৩২ শতাংশ উচ্চতা কম। এক্ষেত্রে কিশোরদের মধ্যে এ হার ২২ শতাংশ। অবিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে অতি ওজন ও স্বল্প ওজন এ দুই ধরনের অপুষ্টিতজনিত সমস্যা আছে। কিশোরীদের মধ্যে আয়রন বা ফলিক এ্যাসিড খাবার প্রবনতা খুবই কম। ১৭ শতাংশ অবিবাহিত ও ৩৪ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরী বলেছে রাস্তায় তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় বেশি।
আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেছেন, এতদিন আমরা কিশোর কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেছি কিন্তু এখন ওদের মানসিক স্বাস্থ্য ও নির্যাতনের বিষয়ে কথা বলার সময় হয়েছে।
আমরা আমাদের আশে পাশের কিংবা পরিবারের সদস্যদের কতটুকু কাউন্সেলিং বা মোটিভেশনের আওতায় আনতে পারছি? সার্বিক জরিপটি আমলে নিয়ে আমরা সচেতন না হলে বিপজ্জনক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারি। এ বিষয়ে সচেতনতা আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে সমূহ দুর্ভাবনা আমাদের গ্রাস করতে পারে।

(তথ্যসুত্রঃদৈনিক প্রথম আলো, ১২.০২.২০২১ সংখ্যা)

কলামিস্টঃ নূরে আলম মুক্তা,কবি ও সাহিত্যিক।

আরও পড়ুন