সুমাইয়া আফরোজ
… এতদিন পর মাইয়্যাটারে দেইখা খুব ভালো লাগতাছে, তা জামাই কই? একা আসছে নি এবার?
গভীর কৌতূহল চেপে সালেহা বেগম প্রশ্ন করে জামিলা বানুকে।
কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে জামিলা বানু উত্তর দেয়,
: জামাই গতমাসে বিদ্যাশ গেছে বুবু। তাই মাইয়্যাটারে নিজের কাছেই কিছুদিন রাখমু চিন্তা করছি।
জমিলা বানু প্রসঙ্গ বদলাতে চায় কিন্তু সালেহা বেগম পেটের কথা ঝেড়ে না বলে কথাচাপা দেয়ার মত মোটেও বেরসিক নন। তাই কন্ঠে করুণা ঢেলে বলতে থাকেন,
: আহারে, অমন চান্দের মত মাইয়্যা! অথচ কপালডা এমন, মাইয়্যা মানুষের জীবনে কি আর স্বামী- পুত্রের মত সুখ আর জগতে আছে বুবু? আমারই কষ্টে বুকটা ফাইটা যায় ওর মুখের দিকে তাকালে। তুমি মা হইয়া কেমনে সহ্য কর?
এমন সহানুভূতিতে জামিলা বানু বিগলিত হওয়ার বদলে বিরক্তই হয় বেশ। ঝাঁঝের সাথে বলে ফেলে
… ওপর আলা যদি কারো কপালে সুখ না ল্যাখে তো আমার কি করার আছে কও দেখি? আর তোমাগো যদি বেশিই কষ্ট হয় তয় পরেরবার আসতে দড়ি কলসি নিয়া আইস।
তারস্বরে চিৎকার শুরু করে সালেহা বেগম।
… আ মরণ! দুনিয়াত কাউরে ভালা কতা কইবার নাই গো। বাঁজা মাইয়া প্যাটে ধইরাও এত দেমাগ কিসের গা? ও আমার মাইয়া পোলা হওনের লাইগা আইছে বইলা তোমার এত হিংসা? আর যদি কুনুদিন কাউরে কোন ভালা কতা কইছি! তৌবা তৌবা।
দাঁত খিঁচিয়ে জমিলা বানু বলতে থাকে
… আমাকে ভালা কতা কওনের লাইগা কে তোমারে মাথার দিব্বি দিছে কও দেখি?
তার কথায় কান না দিয়ে চিৎকার করে আগের কথাগুলো আবৃত্তি করতে করতে চলে যায় সালেহা বেগম।
জানালায় কান পেতে মায়ের সাথে ছোটবেলার সই এর মায়ের ঝগড়া শুনে চোখের জল ফেলে সাজেদা।
বিয়ের পাঁচ বছরেও সন্তানের মুখ না দেখায় তার ওপরে যে নিত্য দোষারোপ চলে তা তার অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে। একটি সন্তানের শূন্যতাই তার সহনক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তাইতো কিছুদিন আগে তার সাজানো গোছানো ঘরে যখন স্বামীর দ্বিতীয় বৌ এর আগমন ঘটল তার ঘরের অপূর্ণতা দূর করতে তখনও সে নীরবেই স্বামীর ভিটে আঁকড়ে পড়ে ছিল। কিন্তু যখন স্পষ্ট করে সে বাড়িতে তার অপ্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেয়া হলো কেবল তখনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে এক কাপড়ে, সবাইকে বলেছে তার স্বামী বিদেশে তাই সে এখন বাপের বাড়িতেই থেকে যেতে চায় কিছুদিন।
ছোটবেলা থেকেই শান্ত প্রকৃতির হওয়ায় মায়ের ভালোবাসাটাও তার প্রতি অন্য বোনদের চেয়ে গভীর, কিন্তু আজকাল মায়ের মেজাজ বড়ই খিটমিটে থাকে যদিও সে এরকম মেজাজের মানুষ নয়। সাজেদার মনের অস্থিরতা আরও তীব্র হয় জমিলা বানুর মুখপানে চেয়ে।
একাকী ঘরে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ দৃষ্টি আটকে যায় ধুলোর স্তর জমা কুরআনের দিকে।
সেটাকেই ঝেড়ে মুছে পরম যত্নে খুলে পড়তে থাকে, ছোটবেলায় মক্তবে মোটামুটি পড়া শিখেছে সে, তবে বাংলা অর্থ বেশ ভালোভাবেই বোঝে।
পড়তে পড়তে একটা অায়াতে থমকে দাঁড়ায়,
পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়,অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে তা অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন,তোমরা জান না।” (২: ২১৬)
এতটুকু পড়েই গভীর প্রশান্তিতে মনটা ভরে যায় সাজেদার।
দুদিন পর জমিলা বানুর উঠানে আবারো সালেহা বেগমের কন্ঠ শোনা যায়, তবে কোন উচ্চবাচ্চ নেই। গ্রামের এই সহজ সরল মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় গুণ হলো তারা যত সহজে একে অন্যকে আক্রমণ করে তার চেয়েও বেশি সহজে তা ভুলে যেতে পারে।
তাছাড়াও সালেহা বেগম যাওয়ার আগে জমিলা বানুর হাত ধরে বলে,
… আমার মাইয়্যাডার জন্য দোয়া কইরো বুবু আল্লাহ যেন একখান পুত্রের মুখ দেখায়, হের শ্বশুরবাড়ির সগলের খুব আশা। ওর সময় আর বেশি নাই, দু এক দিনেই আল্লাই দিলে কিছু হইবো।
জমিলা বানুর চোখ ছলছল করে উঠে, হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে
… কি যে কও বুবু, তোমার মাইয়্যা কি আমার পর? সেই ছুডুকাল থাইক্যা আমার মাইয়্যার লগে লগে বড় হইছে, আমি ওদের কাউরে আলাদা করি না।
সালেহা বেগমকে খুব খোলা মনেই কথাগুলো বলছিলো জমিলা বানু, মনটাও বেশ নরম হয়েছিল, কিন্তু ঘরে ঢুকে মেয়ের হাসিখুশি মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই মেজাজ বিগড়ে গেলো তার।
… কপালপুড়ি, তোর মত বেয়াক্কল মাইয়্যা জগতে দেখি নি, আমি সারাডাদিন চোখমুখে আন্ধার দেখি আর তুই দিব্বি দাঁত বাইর কইরা হাসোছ? লজ্জ্বাশরম কিছু লাগে না? আল্লাহ আমারে যে কেন উঠায় নেয় না, আমি যে আর সইবার পারি না।
আচমকা আক্রমণে হতভম্ব হয়ে যায় সাজেদা। মায়ের কথার কোন প্রতিবাদও করতে পারে না, কেবল মলিন মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
নিঝুম রাত, চারদিকে শুনশান নীরবতা, মা আর মেয়ে একই বিছানায়। অভিমানে ঘুম নেই কারো চোখেই। বিকেলের পর থেকে কেউ কথা বলে নি কারো সাথে। সাজেদা মেয়েটার অভিমানও কম নয়, জীবনের কত বড় বড় ধাক্কা সে অনায়াসে সামলাতে পেরেছে সে কি না মায়ের অতটুকু বকুনি এখনো হজম করতে পারে। হয়তো মায়ের প্রতি তার গভীর ভালোবাসাই একমাত্র কারণ।
দুজনেই চোখ বুজে যখন দিনের স্মৃতি ভেবে অনুতপ্ত হচ্ছে ঠিক তখনি রাতের নীরবতা ভেঙে সালেহা বেগমের উচ্চ ক্রন্দনধ্বনি শোনা গেলো, বুকের ভেতরে ধক করে উঠলো দুজনেরই। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বুঝতে চাইল বিষয়টা।
রাস্তার ওপারের বাড়ি থেকে গভীর অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসতে লাগল,
… আল্লাহ গো, আমার একী সর্বনাশ হলো, আমি মা বাঁইচা থাকতে আমার মাইয়্যাটারে তুমি কেমনে নিয়া গেলা গো… মারে কতা ক… আমার মাইয়্যার কিছু হয় নাই, একবার মা কইয়া ডাক মাগো।
কানে হাত দিয়ে ভীত শাবকের মত মায়ের বুকের কাছে এগিয়ে যায় সাজেদা। মা ব্যস্ত হয়ে বুকের সাথে শক্ত করে ধরে রাখে মেয়েকে। অনেক বছর আগে দীর্ঘ সময় প্রসব বেদনার পর মেয়েকে কাছে পেয়ে যেভাবে জড়িয়ে রেখেছিল ঠিক সেভাবে।
আর তারপর ডুকরে কেঁদে ওঠে জমিলা বানু নিজেই।
… আল্লাহ গো, আমারে তুমি মাফ কইরা দাও, তোমার ওপর নাখোশ হইছিলাম না বুইঝা, আমি আর কিছু চাইনা গো, এই যে তুমি আমার বুকের ধনটারে বুকে রাখছ আমি এতেই খুশি, তুমি আমার ভুল মাফ কইরা দাও।
মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে সেই ছোট্টবেলার মত ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সাজেদা আর তার কানে বাজতে থাকে
“পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়,অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে তা অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন,তোমরা জান না।” (২: ২১৬)”
সুমাইয়া আফরোজ সাহিত্যিক।