আমি নসিমন
এইচ বি রিতা
পর্ব-০৫. সমীকরণ
—�-
জীবন মানেই সমাধান, আশান্বিত সমীকরণ! যার সমীকরণ মিলে যায়, জীবনের স্বার্থকতা সেই খুঁজে পায়। ব্যাক্তি বিশেষে সমীকরণের ধরণ ভিন্ন হয়। কারো কাছে প্রিয় মানুষটিকে কাছে পাওয়া সমীকরণের সমাধান। আবার কারো কাছে বিষয়টা নিতান্তই অমূলক। তার কাছে হয়তো অন্যের দুঃসহ দিনে পাশে থাকাটাই জীবনের স্বার্থকতা; সমাধানের সমীকরণ।
কেউ নিজ গুনে হাজার বছর মানুষের মনে স্থান দখন করে নেন। কেউ নিজ কৃতকর্মে ঘৃণার সাথে মানুষের স্মরণে আজীবন থেকে যান। আমরা মাদার তেরেসাকে স্মরণ করি শ্রদ্ধার সাথে। আবার ‘ফার্স্ট মার্শাল অব দ্য এম্পায়ার’ অধীকারকারী ফ্যাসিবাদের জনক বেনিটো মুসোলিনিকেও মানুষ স্মরণ করে, তবে শ্রদ্ধা নয়; তার রাষ্ট্রীয় অরাজকতার জন্য। আমরা ভাল ও মন্দ এই দুই কাজের জন্যই মানুষকে মনে রাখি। তাদের দক্ষতাকে আমরা “ভাল” ও “মন্দ” আকারে বিচার করি তৃতীয় পক্ষীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু তাদের কাছে নিজ নিজ দক্ষতা ও তার স্বার্থক প্রয়োগই জীবনের স্বার্থকতা অর্থাৎ সমাধানে সমীকরণ।
পাকিস্তানের আইরন লেডি খ্যাত মুনিবা মাজারী যখন গাড়ী দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে স্বামী, সংসার ও মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে মানবতার পথে নিজেকে উৎসর্গ করে জীবনের স্বাথকতা খুঁজে নেন, তখন তার স্বামী একই কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে অন্য নারীর বাহুতে জীবনের স্বার্থকতা দেখেন। ঘটনা একই, ব্যবধান শুধু তাদের দৃষ্টিভঙ্গির।
সময়ের দাবীতে আমাদের জীবনের উত্থান পতন ঘটতেই থাকে। আর তখন ব্যাক্তিবিশেষে সমীকরণটাও হয়ে যায় অদ্ভূত! আমরা শেকড় উপড়ে কেবল সামনে দেখি, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায়। আমরা ভুলে যাই অতীত, প্রিয় মুখ, প্রিয় সুখ। শুধু সামনে বাড়ার তাড়া; যদি জীবনের সমীকরণ মিলে যায়!
জীবনটা আসলেই কি? যখন থেকে নিজেকে জেনেছি, তখন থেকেই জীবনের সমীকরণ মিলাতে ব্যাগ্র হয়েছি। তখন জানতামনা জীবনের অর্থ কি! আজ মনে হয়, জীবন মানেই শুধু সমাধানে সমীকরণ নয়, এখানে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি সর্বপ্রথম। দৃষ্টিভঙ্গির উদারতায় সমাধান আশান্বিত সমীকরণটি সহজেই মেলানো যায়। খুব কঠিন নয়।
জন্ম নিলাম, বড় হলাম, ভাল চাকরী হল, সুখের সংসার হল কিংবা রোগে-শোকে- অনুতাপে লড়াই শেষে একদিন মরে গেলাম, এটাই কেবল জীবন হতে পারেনা। জীবনকে স্বার্থকরুপে বাঁচিয়ে রাখতে, পৃথিবীর বুকে এমন কিছু করে যাওয়া বা রেখে যাওয়া প্রয়োজন যাতে করে মৃত্যুর পরও আমরা স্বীয়কর্মে মানুষের মনে বেঁচে থাকি! সেটা অবশ্যয়ই হিটলার বা মুসোলিনির মত নয়; মহাত্ববোধের মাধ্যমে।
যখন আমরা মা হবার ক্ষমতা ধারন না করি, তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি! মনে হয়, জীবনের আশান্বিত সমীকরণটি মিলানো হলনা! আমরা কেন জেগে উঠিনা? কেন ভাবিনা পৃথিবীতে হাজারো নবজাতক পিতৃ পরিচয়হীন। পিতা-মাতাহীন হাজারো শিশু অনাহারে পথে ঘুরে। তাদের কাউকে কেন কোলে তুলে নেইনা? তাদের কাউকে কেন নিজ অধীকার দিতে উদার হইনা? দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেলে সমাধান আশান্বিত সমীকরণটি সহজেই মিলে যায়!
It’s ok to cry! It’s ok to be failed! But it’s not ok to give up!
——
আমি নসিমন
পর্ব-০৬. লড়াই
মেনে নেয়া গেলে জাগতিক রুপ-রস সব কিছুই উপভোগ করা যায়। মানিয়ে নিতে গেলেই যত বিপত্তি। জন্মান্ধ আত্মপরিচয়ে আঁখিদ্বয়ে যে স্বাভাবিকতা লক্ষ্যনীয়, সয়ে সয়ে ক্ষয়ে যাওয়া আঁখি যুগল কি সেই স্বাভাবিকতা ধারণ করে? দাদীমা বেঁচে থাকলে বলতেন, নসিমন! দাঁত চেপে ঢোঁক গিলে ভাত কি হজম হয়? হজম করতে চিবাতে হয়!
বিদ্যুৎকে লোহার তার দিয়ে বাঁধানো মানুষ অতীতকেও বর্তমানে বন্দী করতে পেরেছে। সেই মানুষ কি পেরেছে শব্দকে দমিয়ে নিঃশব্দে বন্দী করতে? পারেনি। শব্দ বলতে যদি ভাসমান সংগীতকে বুঝে থাকেন তবে যথার্তই বুঝেছেন। জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে বন্দী করা মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি, হবেওনা।
বর্ণহীন রক্তপাতে ভিতর ক্ষত-বিক্ষত, বাহিরে স্নিগ্ধ হাসি, নিঃশ্বাস চাপা গোঙ্গানী গলা চেপে আছে, বাহিরে মধুর বানী- এই নারীর প্রকৃত অবস্থান।
এই অবস্থান থেকে বিচ্যুত হলেই পরিবার ও সমাজ নারীকে ছুঁড়ে ফেলে মহাসমুদ্রে! হাবুডুবু খেতে খেতে সাঁতার জানা নারীও তখন ডুবে যায় সমুদ্র তরঙ্গে। ডুবে গেলেই নারীর মুক্তি। কোন রকমে ভেসে উঠলেই আমৃত্যু নারীকে ‘হয় মেনে নেয়া, নয় মানিয়ে নেয়ার’ জীবনচক্রে পতিত হতে হয়। জীবনচক্র ঘূর্ণয়নে নারী শুধু মেনে নেয় নয় মানিয়ে যায়। তাদের কথা আত্মজীবনী আকারে ইতিহাসের পাতায় সুরক্ষিত থাকেনা। কেননা, ইতিহাস সব সত্য গলধকরণের ক্ষমতা রাখেনা।
আজ তবে শুনুন এক নসিমনের কথা! যেদিন নসিমনের স্বামী তাকে দুই সন্তানসহ ছুঁড়ে ফেলেন, মাথার উপর তিন মাসের বাড়ী ভাড়া-আনুসাঙ্গিক বিলস, সেদিন কিন্তু পরিবার ও সমাজ নসিমনের পাশে এসে দাঁড়ায়নি! বলবেন, আল্লাহ্ রক্ষা করেছেন? হ্যা! তিনি রক্ষা করেছেন, তিনি সাহস যোগিয়েছেন, তবে এগারো হাজার ডলার্স যোগার করার পর!
একা এক নসিমন, পাশে দুটি অবুঝ সন্তান, সহায়হীন-আশ্রয়হীন! অর্থনৈতিক টানাপোড়ন সেদিন নসিমনকে শিখিয়ে দেয়, অভাবের কাছে মানুষ কত অসহায়!
নারীর স্বাধিকারের প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে কবিগুরু দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন,
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা?
নত করি মাথা
পথ প্রান্তে কেন রব জাগি
ক্লান্তধৈর্য প্রত্যাশার পূরণের লাগি
দৌবাগত দিনে
শূন্যে চেয়ে রব? কেন নিজে নাহি লব চিনে’…….!
হ্যা! সেই নসিমন সেদিন নিজ অধীকার ও স্বাধীকার ছিনিয়ে নিতে পেরেছিল। ঝড়ের দাপটে ভেঙ্গে পড়তে পড়তে যেমন মাটি আঁকরে থাকা শক্ত বৃক্ষটি সোজা হয়ে দাঁড়ায়, নসিমনও সেদিন শত প্রতিকূলতায় নিজের আত্মঅহংকার ও আত্ববিশ্বাস হারায়নি বরং দূর্বার উদ্দ্যমে নিজেকে রক্ষা করার মনোবল ধরে রেখেছিল।
কেন মানিয়ে নিতেই হবে? কেন মেনে নিতেই হবে? মেনে না নিয়ে প্রেক্ষাপট বদলে দিলে? মানিয়ে না নিয়ে দৃশ্যপট অস্বীকার করলে?
জীবন সর্বদাই অমূলক লড়াই নিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরীতে চলার পথে, গতিরোধ করতে ভালবাসে। সে লড়াইয়ে আমরা অভ্যস্ত। পার্থক্য শুধু, কেউ জীবনের বৈরীতায় হেরে যায়! কেউ জীবনকে হারিয়ে দেয়।
———লেখিকা -এইচ বি রিতা
পেশায় শিক্ষক হলেও কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী হিসেবে সমাদৃত । প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার নিয়মিত লেখিকা তিনি, সোস্যাল মিডিয়াতে লেখিকা তিনি ডার্ক এভিল নামে পরিচিত ।