সুলতানা শিমুঃ
রেললাইলের পাতগুলো যতটা না সমান্তরাল তার চেয়েও বেশি কুটিল যেনো কারো কারো জীবনটা, রেল জংশনের নর্দমার পাশে বসে ভাবছিল আয়ানা।
খুব ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারাতে হয়েছে। তারপর থেকে ঠিকানাটাও বদলে স্থায়ী হয় এই রেল লাইনটার বস্তিতে। ঝনঝন করে যখন ট্রেনটা হুইসেল বাজায় আয়ানার মনে হয় তার কষ্টগুলো যেনো ঘটা করে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রাতের আঁধারে পাত দুটোর মাঝে সমস্ত কষ্টগুলোকে হত্যা করে রেখে দেয়। তারপর যখন ট্রেনটা লাইন ধরে আগাতে থাকবে তখন ট্রেনের চাকা আর পাতের মধ্যকার চাপে মৃত কষ্টের শেষকৃত্য দেখতে। কিন্তু, তাতে লাভ কি? রাত পোহালেই তো আবার কষ্ট জেঁকে বসবে।
বাবা-মাকে হারানোর পর বস্তির এক বৃদ্ধার কাছেই থাকতো আয়ানা। প্রায়ই ছোটখাটো রেষারেষি লেগেই থাকত। নানি ডাকতো আয়ানা তাকে। একদিন বৃদ্ধা আয়ানাকে বললেন, “আয়না, তুই কাইল তোনে কামে যাবি। এক সাহেব আইব তোরে লইতো।” “না” করার মতো ক্ষমতা বা সাধ্য তখনো হয়ে উঠেনি আয়ানার।
পরদিন রাত ফুরাবার পরই আয়ানা নিজেকে আবিষ্কার করে উত্তরার একটি ডুপ্লেক্স বাড়িতে। অবাক নেত্রে দেখছিল আর ভাবছিল এতটাও সুন্দর হয় কারো থাকার জায়গাটা? যদি উত্তর হয়, “হ্যাঁ” তাহলে ফিরতি প্রশ্ন মনে হয় থাকতো, আমার খুপড়ি ঘরটা তাহলে কেন এমন?
সবকিছু যখন জট পাকাচ্ছিল তখনই গৃহকর্ত্রী মিসেস রায়না বেগম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন, “নাম কী তোমার?” আয়ানা; চাপা কন্ঠে উত্তর দিলো সে।
আচ্ছা, চলো কাজ বুঝিয়ে দেই। নোংরা কাপড়গুলো হাতে দিয়ে বললেন মিসেস রায়না বেগম।
শুরু হয়ে গেলো আয়ানার ঘরকন্যার কাজ।ওই কয়েকটা দিনের কথা ভাবতে গেলে এখনও আঁতকে উঠে আয়ানা। কখন মাইর, কখন গরম ছ্যাঁক আর অশ্রাব্য গালি বর্ষিত হয় তা নিয়ে আতংকিত থাকতো সে। সব ব্যাপার নিয়েই সবসময় মনে হতো এই বুঝি আসছেন তেড়ে মিসেস রায়না।
প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, আদর, স্নেহ, কোনটাই আয়ানার পাশ ছুঁয়ে যায়নি কখনোই। শুধু কিসের যেন একটা আশা নিয়ে বেঁচে থাকতো। এই বস্তুটাই আয়ানাকে কাঁদতে বাঁধা দিতো। বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলেও এই আশার স্কেল সবসময় থাকতো নিম্নে। হঠাৎ স্কেলটা কেন যেনো বাড়তে লাগলো। এই বাড়া মোটেও নিম্নমানের কোনো বাড়া নয়। রীতিমতো উচ্চমাত্রায় বাড়ছিল। এই অবাক করা পরিবর্তনের পিছনে অবশ্য একটা প্রেক্ষাপট আছে। যা মনে করতে গিয়ে ফিক করে হেসে দিল আয়ানা।
একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলো বাড়িতে সাজ সাজ রব, বাড়ির সবাই নতুন পোশাক পরেছে। মিসেস রায়না বেগম আর তার মেয়ে টুকি লাল সবুজের কম্বিনেশনের শাড়ি পরেছে। যাদের ও সবসময় হাতাকাটা আঁটোসাঁটো পোশাকে অভ্যস্ত দেখেছে। তাদের এই পরিবর্তন দেখে অবাক সে। হা হয়ে ভাবতে লাগলো আজ কি কোনো বিশেষ দিন? কারো জন্মদিন? না না তা হবে না কারণ গতবার টুঁকি আপার জন্মদিনে তাকে সাদা সিল্কের টাউন না জানি কি গাউন পরতে দেখেছে। কিন্তু এখনতো … …
ভাবনার ছেদ পড়েছিল মিসেস রায়না বেগমের ডাকে। “কিরে নবাবজাদি, শাহাজাদী ঘুম শেষ হইসে তোর? নাকি আরও ঘুমাবি?
গায়ের কাঁথাটা গুছাতে গুছাতে আয়ানা বললো, “যাইতাছি খালাম্মা?”
‘শুন আয়ানা আমরা আজকে স্মৃতিসৌধে যাচ্ছি’, মিসেস রায়না শাড়ি ঠিক করতে করতে বললেন।
“কেন খালাম্মা?” হুট করে জানতে চাইল আয়ানা।
‘আজকে ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, তাই যাচ্ছি’।
“স্বাধীনতা দিবস! এইডা আবার কিডা খালাম্মা।” মুখ শুকনা করে বললো আয়ানা।
“স্বাধীনতা দিবস মানে হচ্ছে এই দিনে বাঙালি তাদের উপর করা দীর্ঘদিনের অন্যায়, অত্যাচার এবং শোষণের জবাব হিসেবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং অসীম সাহসিকতার বলে ৯ মাস পর বিজয় পায় তাই এই দিন উদযাপন করা হয়। যা তোর এত কেচ্ছা শুনে কি হবে!
কাজগুলো শেষ করে রাখিস আর শুন টুঁকির জুসটা রেডি করে রাখতে ভুলিস না”, এই বলে বের হয়ে গেলো মিসেস রায়না।
সেই থেকে আয়ানার মাথায় এই শব্দটাই ঘুরছিল। আর তা হচ্ছে “স্বাধীনতা”।
এরপরের তিনটা স্বাধীনতা দিবস সে শুধু আশাটাকে শান দিয়েই চলছিল। তারপরের এক দিবসে পালিয়ে যায় ওই বাসা থেকে। বের হয়েই ভাবলো, আহা! আমি মুক্ত, আমি স্বাধীন। হাঁটতে হাঁটতেই চলে আসলো এই রেললাইনের ধারটাতে। যুদ্ধ বিক্ষিপ্ত দেশটাকে সাজানোর মতো করে নিজের স্বাধীন জীবনকে সাজানোর স্বপ্ন দেখতে থাকে সে।
ঠিক ওইসময়ই পরিচয় হয় নিলুর সাথে। নিলুই তাকে একটা গার্মেন্টসে কাজ নিয়ে দেয়। প্রথমদিন কাজে যাওয়ার পর থেকেই বুঝতে কোনো বেগ পেতে হয়নি স্বাধীন হয়েও কতটা পরাধীন ও। প্রতিদিন কিছু ড্যাবড্যাব চোখ ফাঁকি দিয়ে তাকে কাজে যেতে হয় আর ফিরতে হয় কিছু অন্যায় আবদার করা হাতকে উপেক্ষা করে। তাছাড়া ভালোই কাটছিল দিনগুলো।
সবার মতো বসন্তের রঙিন প্রজাপতি এসে আয়ানাকেও ছুঁয়ে ছিল। আরিফ নামে এক গার্মেন্টস কর্মীকে ভালোবেসে বিয়ে করে আয়ানা। কিন্তু স্বাধীনতার মতোই ওই ভালোবাসার রংও বদলাতে থাকে। আয়ানার সাথে বিয়ের কয়েকদিন পরেই কাজ করা ছেড়ে দেয় আরিফ। আয়ানার একলা আয়ে সংসার চলতে থাকে। আরিফের নেশার খরচের জন্য তাও ঠিক মতো চলছিল না।
এই নিয়ে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হতো দুজনের। যার শেষ পরিনতি ছিল গায়ে হাত তোলা নিয়ে। কয়েকদিন পরে আরিফ তাকে ছেড়ে চলে যায়। পুরাতন স্বাধীনতা নতুন করে ম্লান হচ্ছিল তার জীবনে।
‘কিরে তুই আইজকা মিছিলে যাবি না’? ‘আয়ানার কাঁধে হাত রেখে বললো নিলু’।
‘তুই যা, আমি আইতেছি’- সখির দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলো আয়ানা।
উঠে গেলো জায়গাটা থেকে দেরী হয়ে গেলে আবার বকা শুনতে হবে বসের। তাছাড়া আজকে ২৬শে মার্চ। মিছিলে গেলেই ১০০ টাকা পাওয়ার কথা।
রাস্তায় বের হয়েই দেখলো সাজ সাজ রব। এইসব আয়োজন নাকি স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য। প্রায় দৌড়ে এসে ধরলো মিছিলটা। হাঁটছে আর মুখস্থ স্লোগানগুলো দিচ্ছে।
একটা বড় মাঠের শেষ প্রান্তে এসে থামল মিছিলটা। ১০০ টাকা করে বখশিশ এর সাথে এক প্যাকেট বিরিয়ানি পেলো সবাই। খুশি মুখে ভাবছে, যাক রেশমি চুড়ি কিনব এই টাকা দিয়ে আর প্যাকেট থেকে কি ঘ্রাণ! আহা!
এইতো আমি মুক্ত, স্বাধীন।
দূরের কোনো একটা মাইক থেকে একটা উত্তেজিত কন্ঠ ভেসে আসছে, ভালোভাবে বেঁচে থাকা, নিরাপদ চলাচল করা, খাওয়া, স্বাধীনভাবে স্বপ্নপূরণ করা আমাদের মৌলিক অধিকার। স্বাধীনতা দিবস আমাদের তাই শিক্ষা দেয়। এই ভাবার্থকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার এইবছর স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
লেখকঃকবি ও সাহিত্যিক।