গেল শতকের সত্তর দশকের গোড়ার দিকে ঢাকার কোনও এক ট্র্যাভেল অ্যাজেন্সি অথবা বিদেশি সংস্থার অফিসের দেয়ালে সাঁটানো একটি রঙিন পোস্টার দেখেছিলাম। তাতে বড় বড় ছাপার হরফে লেখা ছিল:
`When you are tired of London,
You are tired of life!’
লন্ডনে কয়েকবার বেড়াতে গিয়েছি, ভালো লেগেছে, দেখতে দেখতে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়েছি, রাতে হোটেলে ফিরে ধুমসে ঘুমিয়েছি। সকালে উঠে নব উদ্যমে আবার দেখাদেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। মাইলের পর মাইল হেঁটেছি, রোদে পুড়েছি, বৃষ্টিতে ভিজেছি, তবু বিলেত দেখার সাধ মিটেনি। সুযোগ পেলে আবার যাব। তথাপি, ‘লন্ডন-ই জীবন, জীবন-ই লন্ডন!’ এ কথা আমি মানতে নারাজ। বস্তুত পক্ষে মানবজীবন লন্ডনের চাইতে অনেক বড়, অনেক বিস্তৃত, অনেক আলোকোজ্জ্বল, অনেক মহিমাময়! কেন, কী ভাবে, কী অর্থে? এ সব প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে, যে জবাব দিচ্ছে তার ওপর, কারণ জীবনকে সবাই এক ভাবে দেখে না। আর তাই, এখানে বিতর্কের অবকাশ আছে বৈকি। সে বিতর্ক আমার আজকের আলোচনার জন্য মোটেও মানানসই নয়।
তবে যে প্রশ্ন এখানে ষোল আনা প্রাসঙ্গিক তা হলো, জীবনের সাধ যার মিটে যায় – সে কী করে? এ অবস্থায় অনেকে অনেক কিছুই করতে পারে। কেউ – জীবন থেকে ছিঁটকে পড়তে পারে, নেশা ধরতে পারে, তিলে তিলে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে পারে। কেউ অভিনব সামাজিক অপরাধে জড়াতে পারে, খুন-খারাবিতে লিপ্ত হতে পারে – এমন কি আত্মহত্যা করেও বসতে পারে। আবার যে ব্যক্তিত্বে অনড়, সংকল্পে দৃঢ় সে এক ঘেঁয়ে জীবনের স্রোতকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে। এক জীবন থেকে অন্য জীবনে তার উত্তরণ ঘটাতে পারে। নতুন করে নতুন জীবনের নতুন নতুন অর্থ খুঁজে পেতে পারে। কর্মময় সরস জীবনের মধুময় রস আকণ্ঠ শুষে নিতে পারে! ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, এমন মানুষও গত হয়ে গেছে, যারা জীবনের কোনও এক সময় কোনও অলৌকিক শক্তির বলে মানুষের কথা ভেবে ভেবে দেওয়ানা হয়ে গেছে। গতানুগতিক বৈষয়িক জীবন ছেড়ে অন্য জীবন বেছে নিয়েছে। সংসার বিরাগী হয়ে মানুষের সেবায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। এ সব বড় বড় মানুষের বড় বড় আলামত! বড় মানুষ এমন কাজ যত সহজে করতে পারে, আমরা আ’ম মানুষ তত সহজে তা পারি না। না, আমরা আদৌ পারি-ই না! জীবনবিমুখ মানুষ হতাশ হয়ে অন্ধকার জীবনের পথে পা বাড়ায়, আমরা তাও পারি না। যা পারি, তা কেবল আকাশ কুসুম কল্পনা। এই আমাদের সীমানা! এই আমাদের স্বান্তনা!
ইদানীং এ করম ভাবনায় আমাকে পেয়ে বসেছে। আমি স্বপ্ন দেখি, যদি এমন হতো – চাকরি বাকরি পিছনে ফেলে, নাগরিক জীবন থেকে ছুটি নিয়ে চলে যেতে পরতাম আমার জন্মমাটিতে, মরা ধামাই গাঙের পারে সুপারী-নারিকেল-আম-কাঁঠালের ছায়ায় মায়াময় সেই বাড়িতে। সেই টিনের চালাঘরের গেরস্তবাড়িতে যেখানে মানুষ গম গম করে, তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা বাতাসে দোল খায়, হা হুতাস করা আমার মনকেও দোল দিয়ে যায়, ভুলিয়ে রাখে জীবনের পেরেশানি থেকে। যেখানে জৈষ্ঠ্য মাসে আম-কাঁঠালের ম ম গন্ধে বাতাস ভরে থাকে। উঠানে, গাছের নিচে, পুকর পাড়ে আমের খোসায় মাছি ভন ভন করে, তাও ভালো লাগে। এ যে আরেক জীবন, অন্য জীবন। এখানেও তো মানুষ থাকে। থাকে মানে? আমার বাপ-দাদা পূর্বপুরুষের ঠিকানা তো এই খানেই। এই তো আমার আসল পরিচয়, শিকড়ের মূল। তবে কেন, আমি কেন সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিয়েছি, কোন আশার সাগরে ডুবে আজ হাবুডুবু খাচ্ছি? কিসের আশায়, কোন ভরসায়, কী পেয়েছি আমি? এ দেশে না এলে কী হারাতাম? আর হারাবার মতন কী-ই বা আমার ছিল? আর দশ জনের যা নেই, তা আমার থাকতেই হবে কেন? প্রশ্নগুলো বার বার আমাকে নাড়া দেয়, খোঁচা দেয়, ব্যথা দেয়।
জানি, স্বেচ্ছায় যে দাসত্বের জীবন বেছে নিয়েছি তা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ মৃত্যু। তার আগে এ জীবন আমাকে যতখানি যন্ত্রণা দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি তৃপ্তি পাই আমি মনে মনে স্বপ্ন বুনে। এ-ও তো এক ধরনের নেশা! নেশা নয় কি? হোক না নেশা, ক্ষতি কি? একটু যদি স্বস্তি মিলে!
লেখকঃ আবু এন এম ওয়াহিদ, অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, ন্যাশভিল, ইউএসএ
আগস্ট ২৩, ২০১৯