পাথেয়
দিল আফরোজ রিমা
অজু করে হাত মুখ মুছতে মুছতে জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালাম। বাইরের দিকটা হালকা আঁধার। সারি সারি বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। ভিতরে লাল নীল সবুজ ডিমলাইটগুলি মিটিমিটি জলছে। সেই আলোতেই কিছুটা আলোকিত চারিদিক। ঠান্ডা বাতাসের এক ঝাপটা এসে আমার চোখে মুখে শীতল পরশ বুলিয়ে দিল। বড় ভালো লাগলো আমার। ফজরের সময় হতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। আমি জায়নামাজে দাড়ালাম। শারীরিক অবস্থার অবনতির কারনে বেশ কিছুদিন ধরে তাহাজ্জুত পড়া হয় না। আজ খুব আশা করেই ঘুম থেকে উঠেছি।
যথা সময়ে আজান হলো। আমি ঘরের তিন সদস্যকে ডেকে নামাজের তাগিদ দিয়ে নিজে ফজর পড়তে দাড়ালাম। এক সময় চারিদিক ফর্সা হয়ে গেলো। দিনের আলো ফুটে উঠলো চারিদিকে। তাড়া করে নাস্তা বানালাম। যে যার মতো অফিস, স্কুল কলেজে চলে গেলো। প্রতিদিনের মতো ফোন করে আমার আম্মার খবর নিলাম। শ্বাশুড়ির খবর নিলাম। এই সময়টা আমার কাজ করতে ভালো লাগে না। নির্জন পরিবেশে দু’ কলম লিখতে অথবা বই পড়তে ভালো লাগে। যদিও তার পরই সংসারের কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পরি। আজও বই পড়তে বসেছিলাম। কারো কান্নার শব্দে ছুটে বেরিয়ে গেলাম। বেরিয়েই বুঝতে পারলাম পাশের বাসায় কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। দড়জাটাও খোলা। ভেতরে ঢুকেই দেখলাম ভাবীর মেঝ মেয়ে বিলাপ করে কাঁদছে। কাছে যেতেই আমাকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরলো। হাউ মাউ করে কেঁদে বলল, আন্টি আমার টুম্পামনি নেই। ওকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো?
ওর ব্যাকুল আর্তনাদে আমার বুকের ভেতটা মুছরে উঠলো। চোখের পানি ধরে রাখতে পাড়লাম না।
শ্রাবনী আমার পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীর মেঝ মেয়ে। মেয়েটি বেশ ভদ্র। পর্দায় চলে। শিক্ষিত মার্যিত, এক কথায় খুব ভাল একটা মেয়ে। ইডেন কলেজ থেকে রাষ্ট্র-বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করেছে। ভালো একটি চাকরিও পেয়েছিল। শুনেছিলাম ভালো ঘর এবং ভালো বর দেখেই বিয়ে হয়েছে শ্রাবনীর। বিয়ের কিছুদিন পর একদিন ওদের বাসায় গেলাম । তখন ওর সাথে দেখা হলো। জানতে চাইলাম, কেমন আছ ? কিছুই বলল না শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। চোখের পানিতে ভেসে গেল তার দু’ গন্ড। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, তুমি কি ভালো নেই মা’ মনি ? সে কিছুই বলল না। আমি ঘরে ফিরে এলাম।আমার মনের মথ্যে শংসয়তো রয়েই গেলো। মেয়েটি ভালো আছে কি ?
কয়েক দিন পরেই শ্রাবনী আমার বাসায় এলো। আমি খুশী হয়ে বসতে বললাম। শ্রাবনী বলল, আন্টি আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
আমি অভয় দিয়ে বললাম, হ্যাঁ কি বলবে বলো।
আন্টি আমার জীবনে একটা বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে।
কি হয়েছে আমায় খুলে বলো।
আমার বিয়েটা ঠিক হয়নি। এই বিয়েটা টিকবে না। এই সংসার আমি করতে পারব না।
কেন ? কি হয়েছে ?
আন্টি ওরা একদম অন্যরকম। আমি নামাজ পড়ি, পর্দায় চলি এসব ওরা পছন্দ করে না। আর ওরা কেউ নামাজ পরে না। সম্পুর্ন খ্রিস্টানদের মতো ওদের চলাফেরা। কেউতো কোনদিন ফজরের নামাজ পড়েই না, মুখ না ধুয়ে বিছানায় বসেই চা খায়।
এদের খাওয়া -দাওয়া, চলা-ফেরা সব কিছুই অস্বাভাবিক। আমার বর, আমার শ্বাশুড়ি, ননদ সবাই মিলে বারে যায়, বাজে বাজে পার্টিতে যোগ দেয়। সেখানে মদ্য পান, নাচ-গান এসব চলে তারপর এক একজন অনেক রাতে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে। এদের জীবন খুব অপরিচ্ছন্ন, নোংরা, আগোছালো, বাউন্ডেলে। আর আমি নিয়ম মেনে চলতে পছন্দ করি। এ সংসার করতে হলে আমাকেও ওদের মতো হতে হবে। ওদের তালে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমি তো তা পারবোনা। ওদের ব্যবহার খুব খারাপ।
আচ্ছা তোমার বর তোমাকে ভালোবাসেতো ?
ভালোবাসলেতো অন্তত ভালো ব্যবহার করত। বলতে খারাপ লাগছে তবুও বলছি- আসলে রবিন আমাকে পছন্দই করে না। মাত্র কয়েক মাস হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। এরই মধ্যে তিন দিন ও আমার গায়ে হাত তুলেছে। শুধু তাই নয়, একদিন এমন মেরেছিল যে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। তখন নিজেই মাথায় পানি ঢেলে ভালো করেছিল।
ভালোবাসলেতো অন্তত ভালো ব্যবহার করত। বলতে খারাপ লাগছে তবুও বলছি- আসলে রবিন আমাকে পছন্দই করে না। মাত্র কয়েক মাস হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। এরই মধ্যে তিন দিন ও আমার গায়ে হাত তুলেছে। শুধু তাই নয়, একদিন এমন মেরেছিল যে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। তখন নিজেই মাথায় পানি ঢেলে ভালো করেছিল।
এতো সাংঘাতিক ব্যপার।
এখন আমি কি করব আন্টি ? ডিভোর্স দেব ? তবে আমি জানি একজন ডিভোর্সি মেয়ের জীবন কখনো সুন্দর হয় না। আমি এখন কি করব আন্টি ? মা অসুস্থ্য মানূষ তাই তাকে কিছু বিলিনি। তবে মা জানে ওরা অন্য রকম মানুষ। আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তা জানে না।
একটা সম্পর্ক যত তারাতারি ভেঙে ফেলা যায়, তা গড়ে তোলা ততই কঠিন। আচ্ছা ওতো তোমাকে ভালোবাসে না, তুমি কি ওকে ভালোবাসো ?
আমি ওকে ভালোবাসি কিনা জানিনা। তবে ওকে আমার নোংরা মনে হয়। ওর আচার -আচরণ চলাফেরা সুস্থ নয়। তবে কেন জানিনা মাঝে মাঝে লোকটির জন্য আমার খুব মায়া হয়। মনে হয় এমন একজন উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন মানুষ, যদি ওর আগোছালো স্বভাবটা বদলে জীবনটাকে গুছিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে পারতাম।
বুঝতে পেরেছি তুমি ওকে ভালোবাসতে চাও। নতুন জীবন দিতে চাও। তা নয় কি ? তুমি যদি অন্তর থেকে চাও তাহলে নিশ্চয়ই পারবে। সেজন্য তোমাকে অত্যান্ত ধৈর্যশীলা হতে হবে। এ কাজ বড়ই কষ্টসাধ্য। তবে তুমি চেষ্টা করলে ঠিক পারবে। এখন তুমি বল ওকে ভালোবেসে চেষ্টা করে ওর জীবনের সব ভূল ঠিক করে জীবনটাকে গুছিয়ে সুন্দর করে দু’ জন একসাথে বাঁচতে চাও ? নাকি ডিভোর্স দিয়ে একা একা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাও।
আন্টি কি করলে ভালো হয় ?
একবার চেষ্টা করে দেখো কোন ফল পাও কিনা, তারপর দেখা যাবে।
ঠিক আছে আন্টি তাই করব। কিন্তু আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।
নিশ্চয় করব।
আমি পারবো তো আন্টি ?
ইনশাআল্লাহ তুমি পারবে। তুমি ওকে খুব ভালোবাসবে। জানইতো ও অন্যরকম। ওর আচরণের চরিত্রের কোন দোষ নিয়ে কোনদিন কোন কথা বলবে না। পারলে প্রশংসা করবে। ওর যত্ন করবে। ও যেমন খাবার পছন্দ করে সেরকম খাবার রান্না করে সুন্দর করে পরিবেশন করবে। ওর কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করবে। তোমার প্রতিটি কাজে ও যেন বুঝতে পারে তুমি ওকে খুব ভালোবাসো। ওর সামনে সুন্দর করে নিজেকে গুছিয়ে রাখবে। ও যদি বোরখা পরা পছন্দ না করে তাহলে পরবে না। সালোয়ার কামিজ ওড়না এসব দিয়েই পর্দা করা যাবে। সব সময় নিজে রুচিসম্মত পোশাক পরবে। স্মার্ট হয়েও পর্দা করা যায় । তুমি তাই করবে। সব সময় শুদ্ধ সুন্দর ভাষায় কথা বলবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাবে। ওর দরুদি হয়ে সব কাজে ওর পাশে থাকবে। একদিন দেখবে ও মনের অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলবে এবং তোমাকে খুশী রাখতে চাবে। তখন তুমি খুব ধীরে ওর খারাপ অভ্যাসগুলো কৌশল করে ভাল অভ্যাসে পরিবর্তন করবে।
ইনশাআল্লাহ তুমি পারবে। তুমি ওকে খুব ভালোবাসবে। জানইতো ও অন্যরকম। ওর আচরণের চরিত্রের কোন দোষ নিয়ে কোনদিন কোন কথা বলবে না। পারলে প্রশংসা করবে। ওর যত্ন করবে। ও যেমন খাবার পছন্দ করে সেরকম খাবার রান্না করে সুন্দর করে পরিবেশন করবে। ওর কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করবে। তোমার প্রতিটি কাজে ও যেন বুঝতে পারে তুমি ওকে খুব ভালোবাসো। ওর সামনে সুন্দর করে নিজেকে গুছিয়ে রাখবে। ও যদি বোরখা পরা পছন্দ না করে তাহলে পরবে না। সালোয়ার কামিজ ওড়না এসব দিয়েই পর্দা করা যাবে। সব সময় নিজে রুচিসম্মত পোশাক পরবে। স্মার্ট হয়েও পর্দা করা যায় । তুমি তাই করবে। সব সময় শুদ্ধ সুন্দর ভাষায় কথা বলবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাবে। ওর দরুদি হয়ে সব কাজে ওর পাশে থাকবে। একদিন দেখবে ও মনের অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলবে এবং তোমাকে খুশী রাখতে চাবে। তখন তুমি খুব ধীরে ওর খারাপ অভ্যাসগুলো কৌশল করে ভাল অভ্যাসে পরিবর্তন করবে।
এবার বলোতো আন্টির কথামত চলতে পারবে কিনা।
হ্যাঁ আন্টি আমি পারবো। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।
অবশ্যই দোয়া করবো। আল্লাহ তোমার সব সমস্যা একদিন ঠিক সমাধান করে দিবেন।
এক বছর পর একদিন হঠাৎ শ্রাবনীর সাথে দেখা হলো। ওকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। আগের চেয়ে স্বাস্থ্যও ভালো হয়েছে। আমাকে দেখে খুশী হয়ে ছালাম দিল। বলল, আন্টি এখন আমি খুব ভালো আছি। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। বললাম, পরম করুনাময়ের কাছে লাখকোটি শুকরিয়া। আলহামদুলিল্লাহ। আরো বললাম এবার তোমাদের নতুন সংসারে নতুন মেহমান দরকার। তার আসার জন্য কি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছ?
শ্রাবনী লাজুক হেসে বলল,আন্টি আমার শারীরিক সমস্যা আছে তাই কিছুতেই কনসিভ করছে না। ডাক্তার বলেছেন,আমার পেটে একটা বড় ধরনের অপারেশন করাতে হবে।
ধৈর্য ধারন কর মা, ডাক্তার যা যা করতে বলেন তা সব করতে হবে। এক সময় আল্লাহ তোমার সব সমস্যা দূর করে দেবেন। তোমাদের ঘরে সুন্দর ফুটফুটে ছোট্ট মেহমান আসবে ইনশাআল্লাহ।
ধৈর্য ধারন কর মা, ডাক্তার যা যা করতে বলেন তা সব করতে হবে। এক সময় আল্লাহ তোমার সব সমস্যা দূর করে দেবেন। তোমাদের ঘরে সুন্দর ফুটফুটে ছোট্ট মেহমান আসবে ইনশাআল্লাহ।
দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে একটা বাচ্চার জন্য চেষ্টা করে গেছে। হঠাত একদিন শুনতে পেলাম, শ্রাবনী কনসিভ করেছে। বাচ্চা পৃথিবীতে আসার আগেই ওর মা আমাদের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালো। খুব আনন্দ পেলাম। সময় মত শ্রাবনীর কোল জুড়ে এলো সেই অতি আকাঙ্খিত ছোট্ট মেহমান। ছোট্ট একটি মেয়ে বাবু। শ্রাবনী ওর নাম রাখলো পাথেয়। আদর করে টুম্পা মনি বলে ডাকত।
শ্রাবনী খুব সুন্দর করে মেয়ের যত্ন করে। কত স্বপ্ন দেখেছে মেয়েকে নিয়ে। সে স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে খুব ভালো আছে।
একদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগেই পাথেয়কে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে শ্রাবনী। কিন্তু বাচ্চাটি কোন সাড়া দেয় না। কেমন যেন নিশ্চল আসার হয়ে পড়ে আছে। শ্রাবনী ওকে কাছাকাছি এক ডাক্তারের বাসায় নিয়ে যায়। ডাক্তার পাথেয়কে দেখে বললেন বাচ্চাটি কয়েক ঘন্টা আগেই মারা গেছে।
শ্রাবনীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এক সন্তান হাড়ানো মায়ের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে এলো। শ্রাবনী আমার হাত ধরে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, আন্টি কেন এমন হলো ? বিয়ের পর কত কষ্ট সহ্য করে জীবনটা কোন রকমে স্বাভাবিক হলো। তারপর বাচ্চার জন্য পাঁচটি বছর সাধনা করে পাথেয়কে পেলাম। আল্লাহ পাথেয়কে আমার কোলে দিয়েও আবার কেড়ে নিল। আমি এখন কি করবো। কি নিয়ে বাঁচবো ?
ওর কথার কোন জবাব দিতে না পেরে আমার নির্বাক চোখে শুধু জল গড়িয়ে পড়ছিল। অনেক চেষ্টায় নিজেকে শক্ত করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, ওতো তোমার পাথেয়। বড় সাধ করে ওর নাম রেখেছিলে পাথেয়। শ্রাবনী ওতো তোমার সত্যিকারের পাথেয়। ও তোমাকে হাত ধরে জান্নাতে নিয়ে যাবে। দুনিয়ার জীবনতো মাত্র দুদিনের। পদ্মপাতার শিশির বিন্দুর মতই ক্ষনস্থায়ী। যে জীবন কোন দিনও শেষ হবে না, সেই জীবনে তুমি ওকে পাবে। ও আল্লাহর কাছে আবেদন করবে। বলবে, আমি মায়ের আদর পাইনি, আমার মাকে এনে দাও। একটু ধৈর্য ধারন করো পাথেয় তোমার জান্নাতে যাওয়ার রাস্তাটা সহজ করে দিবে। ও যে তোমার পাথেয়।
সমাপ্ত
দিল আফরোজ রিমা,গল্পকার।