ফারহানা শরমীন জেনী
উনাকে ভালো করে চিনে রাখ।এখানে যতদিন থাকবে উনার সাথে বারবার দেখা হবে তোমার।কখনও নৌকায়, কখনও নদীর ঘাটে, কখনও বাঁধে অথবা চড়ে বালির মাঝে। এগুলোই তার আবাস।
তৃণা খুব কাছে যেয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করলো।একদম ভাবলেশহীন নির্লিপ্ত দৃষ্টি। কিন্তু তৃণার মুখের দিকে চেয়ে কেমন চমকে উঠলো মাঝি।তৃণা হঠাৎ আঞ্জুআপাকে ধরে বসলো নায়রি পাগলের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য তাও আবার আজই।আঞ্জুআপা বললেন “ঠিক আছে আজ বিকালে তোমাকে নিয়ে যাব নায়রিদের বাসায়। যদিও আমি নিজে কখনো যায়নি। তবে যখন ফসল ওঠার সময় হয় তখন নায়রির মাকে ডেকে নিয়ে আসা হয় সাহায্য সহযোগিতার জন্য। নায়রির বাবা পাগল হয়ে যাওয়ার পরে তাকে কাজের সন্ধানে বের হতে হয়েছিল। যেহেতু আমার বাবা এখানে নামকরা মেম্বার ছিলেন।তখন এলাকার অনেকে বাবাকে বললেন তাকে কোন একটা কাজ করার জন্য। তখন বাবা আমাদের বাসাতেই তাকে রাখলেন মাকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য।”
দুপুরে খেয়ে তৃণা একটা গভীর ঘুম ঘুমিয়ে নিল।রাত্রের নিদ্রাহীনতা কাটানোর জন্য যথেষ্ট একটা ঘুম। আসরের আজানেও আজ তৃণার ঘুম ভাঙছিল না।কিছুক্ষণ পর আঞ্জু আপার ছোট মেয়ে অনন্যা এসে আদুরে হাতে তৃণাকে ডেকে তুললো। মেয়েটা খুব কাছ ঘেঁষে থাকা। পুতুলের মতো। আপার ছেলেটা দশম শ্রেণির ছাত্র।সেও খুব ভালো একটা ছেলে।আপার বর দুলাভাই ব্যাংকে চাকরি করে। পোস্টিং রংপুর। এজন্য তৃণার জড়তা আসেনি আপার বাসায়। মাত্র আট/দশ দিনে তৃণা আপার বাসার সদস্যা হয়ে উঠেছে। মাঝে অবশ্য শুক্র, শনি বাড়ি থেকে ঘুরেও এসেছে। বাড়িতে রীতিমত শোকের মাতম।মায়ের খুব রাগ।কি দরকার তার মেয়ের এত কষ্টে বাড়ি ছেড়ে দূরে চাকরি করার। তাও আবার বিসিএস পরীক্ষা বাদ দিয়ে মনোবিজ্ঞানে পড়া ছাত্রী কিনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিল।কিন্তু ভিন্ন চিন্তা ধারার মানুষ তৃণা বরাবরই প্রাথমিক শিক্ষার সাথে থাকতে চেয়েছে। সে মাস্টার্স পরীক্ষার সময় ব্যাবহারিক পরীক্ষায় “শিশুদের বিকাশে বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ভূমিকা ” এ বিষয়ের ওপর জরীপের সময় খুব অনুভব করেছে প্রাথমিক স্তরেই শিশুদের মনে স্বপ্ন বুনে দিতে হবে। কাটাতে হবে পড়াশোনা ভীতি।পড়া লেখাকে আনন্দ দায়ক উপভোগ্য বিষয়ে পরিণত করতে হবে। কার কোনদিকে আগ্রহ তাকে সেদিকে গড়ে তুলতে হবে। কারণ সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে না। আর প্রতিটি মানুষই মূল্যবান এই অনুভূতি গড়ে তোলা প্রয়োজন প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে।এসব সাত পাঁচ ভেবে তৃণা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তৃণার বাবা তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়নি।আসলে ছোটবেলা থেকেই তৃণার ভাবনাগুলো একটু অন্যরকম।সমাজ নিয়ে এ সমাজের গোঁড়ামি কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা সব বিষয় নিয়ে তার ভাবনা।সে কিছু বদলাতে পারবে না।কিন্তু ষোলকোটি মানুষের মাঝে যদি সে দশটা মানুষকে সঠিক শিক্ষার আলো দিতে পারে এবং সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান দিতে পারে তবে তার ইহকাল ও পরকাল দুটোতেই কিছু সঞ্চয় থাকবে।এজন্য মায়ের রাগ উপেক্ষা করে হলেও এ চাকরি পাওয়া মাত্র যোগদান করেছে। হঠাৎ আঞ্জু আপার ডাকে আবার সম্বিত ফিরে এলো।আপা রেডি হওয়ার জন্য তাগাদা দিলেন।
নায়রিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে আজ তৃণা নতুন এক রাস্তা চিনলো এই এলাকার। নদীর বাঁধ ঘেষে রাজশাহী শহরের বর্জ্য নিষ্কাশনের বড় নর্দমা নদীর সাথে যুক্ত হয়েছে এই চর শ্যামপুর এলাকাতেই। সেই নর্দমার পাশে গড়ে উঠেছে ঘনবসতি। সেই বসতির মাঝে একচিলতে জমিতে নায়রিদের বাড়ি। একই সাথে মানুষ, কুকুর, বিড়াল, হাঁস-মুরগী,গরু-ছাগল সবার বসবাস। নর্দমার উৎকট গন্ধ গা সওয়া হয়ে গিয়েছে এসব অঞ্চলের মানুষের। তৃণা মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে যে আল্লাহ তাকে কত আলোকিত পরিবেশে জন্ম দিয়েছে। কত সু-স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দিয়েছে আবাসনের জন্য। সব কিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। তৃণা দেখছে ছোট্ট বাচ্চারা বাঁধের ওপর খেলছে, ছোটাছুটি করছে পাশ দিয়ে কখনও চলে যাচ্ছে হোন্ডা সাইকেল আবার ব্যাটারি চালিত ভ্যান।অথচ মায়েদের এ নিয়ে নেই কোন উৎকন্ঠা। অথচ শহুরে মায়েরা এইচএসসি লেভেলের বাচ্চাটাকেও করতে চায় না হাতছাড়া। ধূলো মাটির সাথে মিশে এরা হয়ে ওঠে দূরন্ত সাহসী। আর শহুরে বাচ্চারা একগাদা বইয়ের পাতা আর কৃত্রিম বিনোদনের মাঝে গড়ে উঠেছে শোকেসে সাজানো সতেজতা বিহীন বাহারী ফুলগুলোর মতো।
ঢুকতেই নায়রির মা সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে পাটি বিছিয়ে দিলো বারান্দায় রাখা চৌকিতে। খুব পরিপাটি বাসা।একগাল হেসে নায়রির মা বললো “এই আপা কি গুচ্ছ গ্রাম স্কুলের সবার প্রিয় আপা?” আঞ্জু আপা বললো “হ্যাগো লালবানু সেই আপা।যে তোমার সাথে কথা বলার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে। ”
নায়রির মায়ের সাথে পরিচিত হওয়ার পর তৃণা জানতে চাইল নায়রির ইতিহাস।
নায়রীর বাবা পেশায় জেলে আবার মাঝি।নৌকা আর নদীর সাথে তার জীবন একসূত্রে বাঁধা। ডিঙ্গি নৌকাটায় তার পেশার মূল উপকরণ। দিনে নৌকা চালায় আর মাঝরাতে এই নৌকায় করে মাছ ধরে নদীর মাছ মহাজনের কাছে বিক্রি করে। একবার এক ভূমি কর্মকর্তা আসলো গুচ্ছ গ্রামের জরীপে।ঘটনা চক্রে তিনি নায়রীর বাবার নৌকায় উঠলেন। সে যাত্রাপথে সেই বড়সাহেবের সাথে বেশ সখ্য গড়ে ওঠে মাঝির। সেই সাহেব আবার ছিলেন সাহিত্যিক।কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলেন মাঝির দু’দিন হলো একটা মেয়ে জন্ম নিয়েছে। সাহেব জিজ্ঞেস করলো “মেয়ের নাম কি রাখলে মাঝি?”মাঝি একগাল হেসে বললো “আমরা মূর্খ মানুষ সাহেব কি আর রাইখভো। জরীনা,সালেকা,মালেকা কিছু একটা।” সাহেব তখন বললো তোমার জীবন নৌকার সাথে বাঁধা। ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকাকে বলে নায়রী।তোমার মেয়ে যেমন তোমার প্রিয় তেমন তোমার এই নৌকাও প্রিয়।তুমি মেয়ের নাম রাখ নায়রী।সেইদিন মাঝি বাসায় যেয়ে তার মা আর বউকে বললো “যে যা বুলুকগ্যা আমি আমার বিটির নাম রাইখভো নায়রী।নায়রী মানে নৌকা। বুঝলি বউ।” মা বউ আপত্তি তুললেও ধোপে টিকালো না।সেই থেকে মাঝি তার মেয়েকে নায়রি বলে ডাকতো।
চলবে
দ্বিতীয় পর্বের লিংকঃ
ফারহানা শরমীন জেনী কবি ও সাহিত্যিক।