অর্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
অধিকাংশ লেখক বা লেখিকা নিজের লেখার বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা খোলা মনে নিতে পারেন না। অধিকাংশই চান শুধু প্রশংসা শুনতে। ফেসবুকেও দেখি সবাই সবার লেখার ঢালাও প্রশংসা করে যাচ্ছেন সে লেখা ভালো হোক বা না হোক। মন জুগিয়ে চলাই যেন এখন এই ফেসবুক নামক মাধ্যমটির দস্তুর। অহেতুক প্রশংসা করে লেখক বা লেখিকার প্রকৃত উপকার করা হয় কি ? নাকি তার লেখার ত্রুটি ধরিয়ে দিলেই তার বেশি উপকার করা হয় ? যে ত্রুটি ধরায় সেই তো প্রকৃত হিতৈষী। কিন্তু ত্রুটি ধরাবে কে ? যে ত্রুটির কথা বলবে সেই হয়ে যাবে অপ্রিয়। সুসম্পর্কও নষ্ট হয়ে যেতে দেখেছি এই ত্রুটির কথা উল্লেখ করার কারণে। হতে পারে যিনি ত্রুটির কথা বলছেন তিনি হয়ত ঠিক বলছেননা বা তার বিচার বিশ্লেষণে হয়ত কোথাও ভুল আছে। কিন্তু ঠিক,ভুল যাই থাক সেই মতকে সানন্দে স্বীকার করে তার সঙ্গে সেই ত্রুটির বিষয়ে আলোচনা করা যেতেই তো পারে। তাতে লেখক ও সমালোচকের পারস্পরিক মত বিনিময় হয়। তাতে দুজনেই সমৃদ্ধ হন। কিন্তু সে ধৈর্য বা মনের স্থিতি অধিকাংশ লেখকের নেই। সকলেই শুধু চান সাধুবাদ।
এর একটা কারণ অবশ্য আছে। লেখকের কাছে তার নিজস্ব লেখাটি ভীষণ আদরের জিনিস। সন্তানসম মায়া থাকে নিজ সৃষ্টির উপরে। সন্তানকে কেউ মন্দ বললে বা তার কোনো ত্রুটির কথা বললে জনক জননীর যেমন খারাপ লাগে ঠিক ততটাই হয়ত লাগে নিজের লেখাটির ত্রুটির কথা কেউ বললে। কিন্তু এটা কি আমরা কেউ ভেবে দেখেছি যে, সন্তানের ক্ষেত্রেও যদি আমরা স্নেহে অন্ধ হই তাহলে তার চরিত্রের বিকাশে আমরা ঠিক ঠিক সহায়ক হতে পারবনা। মা বাবা তো বটেই, কাকা,জ্যাঠা,মামা ইত্যাদি সকলের মিলিত অনুশাসনেই একটি সন্তান ভালো ভাবে গড়ে ওঠে। ঠিক তেমনি নিজের লেখাটিও বন্ধু, অবন্ধুর ক্ষুরধার আলোচনা বা সমালোচনায় ঋদ্ধ হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা নিজের অহং টি বিসর্জন দিতে পারি। নিজের লেখার উন্নতির জন্যই এই ইগো টি ছেড়ে লেখকের বেরোনো উচিত।
আমি বারাসতের একটি লিটিল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। পত্রিকাটির নাম “বহুস্বর”। এই পত্রিকার একটি মাসিক আড্ডা হয়। সেখানে একজন লেখক তার লেখাটি পাঠ করেন এবং বাকিরা তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। নির্মম আলোচনাও হয় সেখানে। কোনো মন জোগানো কথা বলা হয়না সেখানে। লেখকের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগও নেই এখানে। তিনি চুপ করে বসে তার লেখার সমালোচনা শোনেন শুধু। এই ব্যবস্থা বা পদ্ধতি ইচ্ছে করেই রাখা হয়েছে যাতে লেখার সঠিক মূল্যায়নটি হয়। তবে সবসময় যে ওখানে সঠিক মূল্যায়ন হয় তাও নয়। ভুল মতামতও আসে। কিন্তু ভুল আসুক আর ঠিক আসুক যে মতামতই দিকনা কেন অন্যেরা তাকে হাসি মুখে স্বাগত জানাবার একটা শিক্ষা সেখান থেকে পাওয়া যায়। আগে তো শুনুন নিজের লেখা সম্পর্কে অন্যের সবরকম অভিমত। তারপরে আপনি তা মানবেন কি মানবেননা সে স্বাধীনতা তো সম্পূর্ণ ভাবেই আছে আপনার।
শুধু লেখার ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো ব্যাপারে অন্যের মতামতের প্রতি আমরা অসহিষ্ণু। কোনো ব্যাপারে মতান্তর হলেই মনান্তর হয়ে যায়। এটা কেন হবে ? বিতর্ক তো ভালো জিনিস। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে যুক্তির দ্বারা তর্ক করুন। সেই তর্ক উভয়কেই সমৃদ্ধ করে। বিতর্কের সময় কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ বা টিজ করে অপর পক্ষকে কিছু বলা নিজের দীনতাকেই প্রকাশ করে। যারা সৃষ্টিশীল মানুষ তাদের কাছ থেকে তো একটু পরিণত আচরণ বা পরিশীলিত ভাবনা চিন্তা আশা করাই যায় তাইনা ?

লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক, কলকাতা, ভারত