Ads

অপরাজিতা

ড. উম্মে বুশরা সুমনা

জিতা তার অ্যাকাডেমিক সব পরীক্ষায় এ প্লাস পেত। এস.এস.সি, জে.এস.সি,এইচ.এস.সি সব পরীক্ষায় সে এ প্লাস পেয়েছিল। তাই ওর বাবা আদর করে ডাকত অপারাজিতা। ও নাকি কখনো হারবে না,মেয়েকে নিয়ে এরকম উচ্চ ধারণা ছিল জিতার বাবার।

জিতা ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছিল। সেখানে সেকেন্ড প্রফ পরীক্ষার পর তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক হয় রিডিং পার্টনার আসিফের। ইন্টার্নী শেষে যখন বাসা থেকে জিতাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালানো হলো, তখন সে আসিফের সাথে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা প্রকাশ করেছিল।জিতার বাবা মেয়ের সাথে সাতদিন কথা বললেন না। তিনি তার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলেন। ভালো ঘর, ছেলেও খুব ভালো আর পরহেজগার ছিল। জিতার সাথে রাগ করে থাকলেও পরে জিতা কিভাবে কিভাবে যেন বাবা-মা দুইজনকেই আসিফের ব্যাপারে রাজি করে ফেলেছিল। শেষে জিতার বাবা কোরবান সাহেব আর না করতে পারেননি। বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। পারিবারিকভাবেই দুইজনের বিয়ে হয়।

বিয়ের প্রথম বছরটা ভালোই কেটেছিল। জিতা একটা ক্লিনিকে চাকরিকরত আর আসিফপিজির লাইব্রেরিতে সারাদিন পড়ত।আগে আসিফ কোনো কোর্সে ঢুকবে তারপর জিতা চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোর্সের জন্য পড়তে বসবে, এরকমই কথা হয়েছিল। দুজনের মধ্যে দারুণ বোঝাপড়া, খুব ভালোই কাটছিল দুইজনের জীবন।

পরের বছর আসিফ প্যাথলজিতে এমডি কোর্সে ঢুকেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সে আর কথা রাখে নি।সংসার চলে না এই অজুহাতে জিতাকে আর চাকরি ছাড়তে দেয় নি। জিতা সারাদিন ডিউটি করে এসে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরে। তারপর রান্না চাপিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসে।এর মধ্যে জিতার শ্বশুর-শাশুড়ি এসে হাজির হন। তারা একেবারেই ঢাকায় চলে আসেন। জিতারশ্ব শুর রিটায়ার্ডমেন্টে গেছেন।এখন ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে থিতু হবেন।

জিতার শ্বশুর শাশুড়ি ফ্ল্যাট কেনার জন্য বিভিন্ন এলাকা ঘুরতে থাকেন। যেটা পছন্দ হয়, সেটা দামে মিলে না। আবার যেটা দামে মিলে সেটা অত ভালো লাগে না। শেষে একটা ফ্ল্যাট পছন্দ করে আসেনকিন্তু ১৫ লাখ টাকা শর্ট পড়ে।

শাশুড়ি জিতাকে টাকার জন্য চাপ দেন। একদিন গল্প করতে করতে সুন্দর করে বলেন,‘তোমরাই তো থাকবে, আমরা আর কতদিন বাঁচব, বলো।তোমার বাবার কাছ থেকেসামান্য শর্ট পড়ে যাওয়া ১৫ লাখ টাকা এনে দাও।’

জিতা চুপ করে শোনে, কিছু বলে না। শাশুড়ি আবার চেপে ধরেন। জিতা শান্ত গলায় বলে, ‘আমার আব্বুর কাছে আমি চাইতে পারব না। তিনি আমাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছেন। আমি আপনাদের অনেক প্রশংসা করেছি। আমার আব্বু আপনাদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা রাখেন। এখন এই ধরনের কিছু চাইলে উনি আরো কষ্ট পাবেন। আমি তো আসিফের পরিবারকে ছোট করতে পারি না।’

জিতার শাশুড়ি হিসহিস শব্দ করে বলেন, ‘আরে তুমি তো ধার চাইবা। এটা তো যৌতুক নয়। ফ্ল্যাটটাতো তোমাদেরই হবে। মেয়ের সুখের জন্য উনি কিছু দেবেন না, এটা কেমন কথা!’ জিতা দৃঢ় গলায় বলে, ‘না, আমি চাইতে পারব না, কখনোই না। আপনি আর এই প্রসঙ্গ তুলবেন না, প্লীজ।’

কিছুদিন গড়ায়। তারপর শাশুড়ির আসল রূপ বেড়িয়ে আসে। একদিন জিতা নাইট ডিউটি করে সকালে ফেরে। ডাইনিং এ শাশুড়ির বানানো নাস্তা খেতে বসে। শাশুড়ি ঝগড়ার ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলেন, ‘লজ্জা করে না। রান্না না করে বসে বসে খেতে?’

জিতা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি তো এতদিন রান্না করতাম। আপনি আসার পর তো রান্না ছেড়ে দিলাম। আপনি তো আমার রান্না পছন্দ করেন না। আপনিই তো আমাকে রাঁধতে নিষেধ করলেন।’

শাশুড়ি কড়া গলায় বললেন, ‘আহঃ, মুখে মুখে তর্ক। কেন যে তোমার মতো একটা বেআদব মেয়েকে ঘরে তুলেছিলাম। আমার ছেলের জন্য এলাকায় কত মেয়ের বাবা আমাদের পিছন পিছন ঘুরেছে। গাড়ি, বাড়িসব দিতে চেয়েছে।কিন্তু তুমি কোথাকার কোন মেয়ে এসে আমার সহজ সরল ছেলেটার মাথা নষ্ট করেঘাড়ে এসে বসলে, বাপু? বাপের ভালো ঘরে বিয়ে দেবার মুরোদ নাই, তাই মেয়ে কে লেলিয়ে দিয়েছিল।’

ক্লান্ত জিতা রাগে ফেটে পড়ে বলল, ‘বাবা তুলে গালি দিবেন না। আমাকে নিয়ে কোনো উল্টা-পাল্টা কথা বলবেন না।’

শাশুড়ি হাত নেড়ে মারমুখী ভঙ্গিতে বলল, ‘নাইট ডিউটির নাম করে রাতকাটিয়ে আসো। আমি কিছু বুঝি না, ভেবেছ? তুমি তো আর অত ভালো ঘরের মেয়ে নয়, বাপু। ভালো ঘরের মেয়ে হলে তার আত্মসম্মান থাকত। আমার ছেলে যে তোমাকে এখন আর পছন্দ করেনা, তোমাকে চায় না, সেটা তুমি বোঝ না?তোমার আত্মসম্মানবোধ থাকলে নিজে থেকে সরে যেতে, বুঝলে? এভাবে জিগার আঠার মতো ঝুলে থাকতে না। গরিব ছোটলোক কোথাকার!’

জিতার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গিয়েছিল।ও চিৎকার করে সব কথার জবাব দিয়েছিল। আসিফ সত্যি দূরে সরে গিয়েছিল।অন্য আরেকজনের সাথে ওকে দেখা যায়।কানাঘুষা শোনা যায়। এটা নিয়ে গত সপ্তাহে আসিফের সাথে বেশ ভালোই ঝগড়া হয়েছিল। এরপর থেকে আসিফ দূরে দূরে থাকে। তাদের মধ্যকার মনোমালিন্যের কথা শাশুড়ি জানেন। শাশুড়ি আর আসিফ মিলে তাই জিতাকে আপোসে সরানোর চিন্তা করেছেন। গতরাতে জিতার অনুপস্থিতিতে তারা কিছু প্ল্যান করেছিল। সন্ধ্যেয় আসিফ থমথমে মুখে ঘরে ফিরল। জিতাকে ডেকে ধমকের সুরে বলল, ‘কী বলেছ আমার মাকে? সাহস খুব বেড়ে গেছে না?’
জিতা রাগী স্বরে জবাব দিল, ‘কী বলেছি, জানো না? আমার কাছে ভাব ধরো কেন? আসার সাথে সাথেই তো সব উনি জানিয়েছে। আমি ওনার সাথে লাগতে যাই নি, উনি আমাকে নিয়ে যা তা বলল, শুধু তার জবাব দিয়েছিলাম।’

আসিফ মারমুখী হয়ে বলল, ‘খুব মুখ হয়েছে,না! আমার মা যাই বলুক তুমি জবাব দিলে কেন? খুব বাড় বেড়েছ, তুমি! আমার মাকে ভালো লাগে না, আমাকে ভালো লাগে না। রান্না-বান্না কিচ্ছু করতে চাও না, এভাবে তো সংসার হয় না। তুমি তার চেয়ে আপোসে চলে যাও। আমাকে মাফ কর আর বিদায় হও।’

জিতা চুপ হয়ে গেল।কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রাগে শরীর কাঁপছে। আসিফ আর সোমার প্রেম কাহিনী এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। জিতা পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আপোসে সরানোর প্ল্যান করেছে। ঝগড়া করে তাকে চটাবে, তারপর গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। তাদের প্ল্যানটা জিতার কাছে পানির মতো সহজ হয়ে ধরা দেয়। জিতা মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না।

চিৎকার করে সে আসিফকে গালি দিল, ‘লুচ্চা কোথাকার! আমি চলে গেলে তোর সুবিধা হয়, না? এত খারাপ তুই! ছিঃ, আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম, নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে।’

আসিফ দাঁত খিচিয়ে জিতাকে পাল্টা গালি দিল। তারপর জিতাকে ইচ্ছেমত পিটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘কাল ফিরব, ফিরে এসে যেন তোর মুখ না দেখি।’

জিতা দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকে।কী করবে বুঝতে পারে না। বাবার অমতে বিয়ে করেছিল। বাবাকে সেবড় মুখ করে বলেছিল যে আসিফ আর তার ফ্যামিলি খুব ভালো।সে খুব ভালো থাকবে। এখন সে কোন মুখে বাবার কাছে দাঁড়াবে।যৌতুক লোভী পরিবার সাথে চরিত্রহীন স্বামী। কী বলবে সে তার বাবাকে।নিজের উপর সব রাগ এসে পড়ে। শুধু আসিফ নয় আর কেউ তার মুখ দেখতে পাবে না, কোনো দিনই দেখতে পাবে না। সে ঘরের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল। পৃথিবীর দুঃখ, কষ্ট আর অশান্তির হাত থেকে বাঁচতে সে চিরস্থায়ী অশান্তিকে ডেকে আনল। সে তার বাবার দেওয়া নামের সার্থকতা রাখল না। বাবার দেওয়া নামটা মুহূর্তেই অপরাজিতা থেকে পরাজিতা হয়ে গেল। ইহকাল পরকাল দুটোতেই সে হেরে গেল।

 

টিকাঃ জীবনে পরীক্ষা আসবেই। এইসব পরীক্ষাকে ধৈর্য সহকারে মোকাবেলা করার মতো শক্তি থাকা দরকার। শুধু অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায় সফল হলেই চলবে না, জীবনের পরীক্ষাতেও সফল হতে হবে। সেই জন্য ছোট বেলা থেকেই সন্তানকে শক্ত মনের মানুষ হিসেবে তৈরি করতে হবে যাতে সে খারাপ পরিস্থিতি গুলোও খুব সহজে সমাধান করতে পারে আর শক্তভাবে টিকে থাকতে পারে। তাই তাকে সেই মহিয়সী নারীদের গল্প শুনাতে হবে।অপবাদ সহ্যকরেছিলেন পবিত্র নারী মারইয়াম (আ:)।কুমারী মারইয়াম (আঃ) আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় গর্ভবতী হয়েছিলেন। সমাজ আঙুল তুলেছিল এই পবিত্র নারীরদিকে। কিন্তু তাকওয়াশীল মারইয়াম(আঃ) ভয় পান নি।

আল্লাহতা’আলার ইচ্ছায় হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর স্ত্রী বিবি হাজেরা (আঃ) কে দুগ্ধপোষ্য সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ)কে জনমানবহীন বিস্তৃত মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। বিবি হাজেরা (আঃ) ভয় পেলেন না। আল্লাহ্‌ সুবহানা তায়ালার ফয়সালার উপর ভরসা রাখলেন। যখন শিশুপুত্র ক্ষুধাওপিপাসায়ছটফটকরতেলাগল, তখন তিনি পানির সন্ধানে ছাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন।ছাফা পাহাড়ে উঠে চারদিকে পানির খোঁজ করলেন।কোথাও পানির লেশমাত্র দেখতে পেলেন না।সেখান থেকে নেমে আবার মারওয়া পাহাডের দিকে দৌড়ালেন।সেখান থেকেও কোনো পানির সন্ধান পেলেন না। তিনি আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ্‌ সুবহানা তায়ালা তার জন্য জমজম পানির ফোয়ারা তৈরি করে দিলেন। এভাবে তিনি কঠিন পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন।

আছিয়া (আ.) ছিলেনমিসরের বাদশাহ ফেরাউনের স্ত্রী।ফেরাউন ছিল অত্যন্ত প্রতাপশালী, জঘন্য ও কুখ্যাত ব্যাক্তি যে নিজেকে খোদা বলে দাবি করত।সে আল্লাহর প্রভুত্বকে অস্বীকার করে নিজের মনগড়া আইন-শাসন ওস্বৈরাচারীনীতি মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল।কিন্তু আছিয়া (আ.) ফেরাউনের ভ্রান্তদাবি, বিশ্বাস ও স্বৈরাচারী নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেন।এতে ফেরাউন তাঁর উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।তখন আছিয়া (আ.) এর উপর নেমে আসে অসহনীয় নির্যাতন।ফেরাউনের নির্দেশে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।বিরাট পাথরের নিচে তাঁকে চাপা দিয়ে রাখা হয়।প্রস্তরাঘাতে তাঁর পবিত্র দেহকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়।তাঁর চোখ উপড়ে ফেলা হয়।কিন্তু এসব অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়নেও আছিয়া (আঃ) হতাশ হন নি এবং ফেরাউনের কাছে নতি স্বীকার করেন নি।আছিয়া (আ.) কাফের ও জালিম স্বামীর জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেও ঈমান ও ধৈর্যের পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন। এমন সব ঈমানদার নারীরা যখন আমাদের আদর্শ তখন আমাদের কন্যাদের শুধু অ্যাকাডেমিক পরীক্ষা নয়, জীবনের সব পরীক্ষায় সফল হওয়া উচিৎ।

লেখকঃ সাহিত্যিক এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক 

লেখকের প্রকাশিত লেখাসমূহ-

আমাদের বাবু ও বই

আমি নারীবাদী নই

আরও পড়ুন