Ads

দহন

ড. উম্মে বুশরা সুমনা

টুকটুকি কে নিয়ে মা কোথায় যাচ্ছে, টুকটুকি কিছুই বুঝতে পারে না। গাড়িতে করে যেতে যেতে সে মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, আমরা কোথায় যাই? নানু বাড়িতে? বাবা যাবে না?’

মীরা ধমক দিয়ে বলল, ‘এত কথা বলো না তো। চুপ হয়ে থাকো। সেই কখন থেকে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছ।’

ট্যাক্সি চলতে লাগল। সন্ধ্যের সময় একটা সাততলা বিল্ডিং এর সামনে এসে ট্যাক্সিটা থামল। অপরিচিত জায়গা দেখে টুকটুকি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘মা, এটা কার বাসা? আমরা কোথায় যাচ্ছি? এটা তো নানুবাড়ি নয়?

মীরা বিরক্তি ভাবটা লুকিয়ে মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এটা তোমার রানু আন্টির বাসা। এখন থেকে আমরা এখানেই থাকব। চলো, ভিতরে চলো। তোমার রানু আন্টিরও একজন মেয়ে আছে, তোমার চেয়ে একটু বড়। দুইজন মিলে খেলবে, কেমন?’

টুকটুকি আবার বলল, ‘মা, আমাদের সাথে বাবা থাকবে না? আমরা এখানে কয় দিন থাকব?’

মীরা কলিংবেল চাপতে চাপতে বলল, ‘বেশি বাবা বাবা করো না তো। তোমার বাবা আমাদের সাথে আর থাকবে না। এখন থেকে শুধু তুমি আর আমি থাকব, বুঝলে? এখন একটু হাসো, তোমার আন্টি তোমাকে ভালো বলবেন।’

রানু আপা দরজা খুলে দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে টুকটুকিকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘টুকটুকি মামনি, তুমি তো দেখি অনেক বড় হয়ে গেছ? স্কুলে ভর্তি হবে? তোমাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করাব। দারুন মজার স্কুল। রাইম শোনাবে, মাথা নেড়ে গান গাইবে, খুব আনন্দের স্কুল। যাবে? তোমার ছোঁয়া আপুর সাথে যাবে, ঠিক আছে?’

ছোঁয়া নামের একজন আট বছরের মেয়ে দৌড়ে এল। তারপর টুকটুকিকে সে বারান্দায় নিয়ে গেল। ওখানে ঝুল দোলনায় দুইজন দুলতে লাগল। একটু পর দুইজন পাজল মিলানো খেলা খেললো। তারপর ব্লক সেট দিয়ে বিল্ডিং বানিয়ে খেলতে লাগল। দুইজনের মধ্যে খুব দ্রুত ভাব হয়ে গেল। মীরা আড়চোখে ওদের খেলা দেখতে লাগল। টুকটুকির হাসি মুখ দেখে তার মনের ভিতরের কালো মেঘটা সরে গেল।

রাতে মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমাতে এল। টুকটুকির ঘুম এল না। সে প্রতি রাতে একটা পা বাবার গায়ে আর আরেকটা পা মায়ের গায়ে দিয়ে ঘুমায়। তার একপাশটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো। সে এপাশ ওপাশ করে ছটফট করতে লাগল। পাঁচ বছরের জীবনে সে খুব কম রাতই তার বাবাকে ছাড়া ঘুমিয়েছে। যে রাতগুলোতে তার ঘুম আসত না, সে রাতগুলোতে তার বাবা তাকে বারান্দায় নিয়ে যেয়ে আকাশের চাঁদ দেখাত, তারা দেখাত আর টুইংকেল টুইংকেল ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াত।

বাবার কথা মনে হতেই সে ভ্যা করে কেঁদে বলল, ‘আম্মু, আমি বাবার কাছে যাব। এখানে থাকব না। বাসায় চল।’

মীরা মেয়ের কান্না থামাতে চেষ্টা করল। এত রাতে কান্নার শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যাবে যে। মেয়েকে কোলে নিয়ে টুইংকেল টুইংকেল ছড়া শুনিয়ে পায়চারি করতে লাগল। এত ভারী বাচ্চা, কোলে নিয়ে হাঁটতে তার খুব কষ্ট হলো। একসময় টুকটুকি ঘুমিয়ে গেল।

মীরার দিন গুলো বেশ ভালোই কাটছিল। শুধু রাতের বেলায় মেয়েকে ঘুম পাড়াতে তার কষ্ট হচ্ছিল। কিছুদিন পর মেয়ের শুধু মাকে জড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যেস হয়ে গেল। মীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দেখতে দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল। একদিন হঠাৎ রানু আপা হাসি মুখে ঘরে ফিরে বললেন, ‘মীরা, একটা খুশির খবর আছে। আমি স্কলারশীপ পেয়েছি, সামনের মাসে পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়া চলে যাব।’

মীরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার এত চমৎকার আশ্রয়টা সে হারাতে যাচ্ছে। সে রানু আপাকে বলল, ‘আপা, ছোঁয়ার কী হবে?

রানু আপা হেসে বললেন, ‘ওর জন্যই তো এদেশ ছাড়ছি। মেয়েটার স্কুলে প্রায়ই ওর বাবা যায়, ফুপি যায়। আমার নামে উল্টা-পাল্টা কথা বলে। মেয়েকে এটা সেটা গিফট দেয়, যাতে মেয়ে একেবারে তার কাছে চলে যায়। আমাদের ডিভর্সের সময় তো আদালত থেকে আমি অনুমতি পেয়েছিলাম যে আমার কন্যা আমার হেফাজতে থাকবে। অথচ তার বাবা এখন ঝামেলা বাঁধাতে আসছে। আমার মেয়ে আমাকে ভুল বুঝতেছে। আমি আমার মেয়েকে ওদের কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাব, কেউ জানতেও পারবে না যে আমরা কোথায় যাচ্ছি।’

রানু আপা পরের মাসে ছোঁয়াকে নিয়ে একেবারেই চলে গেলেন। যাওয়ার সময় অনেক কাঁদলেন। টুকটুকি অনেক কাঁদল তার খেলা আর পড়ার সাথী ছোঁয়া আপুর জন্য। মগবাজারের এতবড় ফ্ল্যাটের ভাড়া দেবার সামর্থ্য মীরার নাই, অন্য কোনো অপরিচিত মানুষকে সাবলেট দিতেও সে ভয় পায়। ঢাকা শহরে স্বামী ছাড়া একটা মেয়ের একা চলা অনেক কঠিন। সে ছোট বাসা খুঁজতে বের

হলো। একা একজন মহিলা স্বামী ছাড়া শুধু বাচ্চা নিয়ে থাকবে এটা কোনো বাড়িওয়ালা মেনে নিতে পারে না। টুকটুকির বয়স তখন ছয় পেরিয়েছে। সে একা একাই অনেক কাজ করতে পারে। মীরা ফোনে শফিকের সাহায্য চাইল। শফিক নতুন বিয়ে করেছে। বউ নিয়ে হানিমুনে ব্যস্ত। সে শুধু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারবে, বাচ্চার দায়িত্ব নিতে পারবে না। শেষে মীরা একজনের পরামর্শে টুকটুকি কে একটা নামী-দামি স্কুলের বোর্ডিং রেখে দিল। শফিক প্রতিমাসে স্কুলের খরচ দেওয়া শুরু করল। মীরা মিরপুর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে উঠে গেল।

আজ টুকটুকির প্যারেন্টস ডে। টুকটুকির বয়স এখন তেরো বছর। সে অনেক ম্যাচুয়ুর হয়ে গেছে। হোস্টেলের অধিকাংশ বাচ্চাই ব্রোকেন ফ্যামিলির। টুকটুকির অনুরোধে আজকে শফিক-মীরা দুইজনেই একসাথে প্যারেন্টস ডে তে যাবে। শফিক-মীরার এতবছর মুখ দেখাদেখি হয় নি। টুকটুকিকে দেখতে একমাসে শফিক যেত আর তার পরের মাসে মীরা যেত। তাই কারো সাথে কারো দেখা হতো না। আজ এত বছর পর দুইজন মুখোমুখি হবে।

মিরপুর মহিলা হোস্টেলের নীচতলার গেস্টরুমে শফিক বসে আছে। মীরা বক্সে করে নুডুলস, সেমাই আর কিছু নাস্তা নিয়ে চারতলা থেকে নিচে নামছে। অনেক বছর আগে, ছাত্রী অবস্থায় সে এমনি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের চারশ তিন নাম্বার রুম থেকে নিচে নামত। শফিক হলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকত। ৪০৩ লেখা স্লিপ আপুদের হাতে ধরিয়ে দিত, তখন মোবাইলের চল ছিল না। আপুদের ডাকে মীরা শিহরিত হতো। এই রুম নম্বর নিয়ে শফিক খুব ক্ষেপাত আর বলত, দেখো আমি কিন্তু চারটা বিয়ে করব। তুমি তো এখন থেকেই চার সতিনের ঘরেই আছ, তাহলে পরবর্তীতে মানিয়ে নিতে আর সমস্যা হবার কথা নয়।’

মীরা খুব ক্ষেপে যেত। তার শফিক অন্য কারো হবে এটা সে ভাবতেও পারত না। দুপুরে না ঘুমিয়ে সে শফিকের জন্য নিজ হাতে বিভিন্ন রকমের নাস্তা বানাত। তারপর দুইজন হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে চলে যেত। ওখানে বসে মীরা শফিককে নাস্তা খাওয়াত আর গল্প করত।

কত স্মৃতি এসে ঝাপটা মারছে। মীরার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চশমা খুলে সে চোখ মোছে। হায়, সেই শফিক, হৃদয়ে যে শিহরণ ছড়াতো, যার ভরাট কণ্ঠের কবিতা তার হৃদয় জুড়াতো। যাকে একটু দেখার জন্য সে দুপুরের ঘুমে ছটফট করত, বিকেলে একটু খানি দেখা হবার প্রত্যাশায়। তাকে সে পেয়েও ছুঁড়ে মেরেছে। আজ তারা যোজন যোজন দূরে বাস করে। প্রায় আট বছর পর গেস্ট রুমে দুইজন দুইজনকে দেখে চমকে উঠল।

শফিকই প্রথমে আগ বাড়িয়ে কথা বলল, ‘এই ক বছরে তুমি এত পাল্টে গেছ মীরা? হঠাৎ দেখে তো তোমাকে আমি চিনতেই পারি নি। এত শুকিয়ে গেছ? এত ভেঙে গেছ কেন তুমি?’

মীরা কষ্ট লুকিয়ে হেসে বলল, ‘তুমিও তো অনেক পাল্টে গেছ। চুলে পাক ধরেছে।স্বাস্থ্যটা বেশ ভালো দেখাচ্ছে। মুখে দাড়ি রেখেছ। কাটার আলসেমী, ফ্যাশন নাকি সত্যি ধর্ম কর্মতে ঝুকেছ?’

শফিক চাপা হেসে বলল, ‘যা খুশি ধরে নাও।’

‘তোমার জন্য কিছু খাবার এনেছিলাম, খাবে?’

‘না, এখন খাবো না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

মীরা কান্না চেপে বলল, ‘মেয়েটা শুধুই তোমার?’

শফিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘না, আমাদের মেয়ে ছিল। কিন্তু এখন একমাসে বাবার রাজকন্যা আর পরের মাসে সে মায়ের আশার আলো কন্যা হয়ে দেখা দেয়।’

মীরা চুপ হয়ে গেল। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। শফিকের দ্বিতীয় বউ, সংসার নিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। সে কি খুব সুখে আছে? তার সামনে বেড়িয়ে আসা ভুড়িটা কি সুখের চিহ্ন? মোটা তাজা পুরুষ, বউ কি খুব ভালো রাঁধে? অতি কৌতূহল লুকিয়ে মীরা শান্ত গলায় বলল, ‘তোমার বউ আর ছেলে মেয়েরা ভালো আছে?’

শফিক হেসে মাথা ঝাঁকাল, ‘হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। তুমি কেন আর বিয়ে করলে না? তোমারও তো নতুন সংসার হতে পারত। এমন করে কেউ থাকে? আত্মীয় স্বজন ছাড়া একা একা হোস্টেলে, খুব কষ্ট হয় তোমার, না? কিভাবে এত বছর একা একা কাটালে? বিয়ে করলেই পারতে।’

মীরা চুপ হয়ে গেল। ডিভোর্সের পর ঢাকার বাসিন্দা এক খালা তার পুনঃবিবাহের জন্য অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেরকম ভালো বা যোগ্য পাত্র পান নি। ডিভোর্সী শুনলে সবাই নাক কুচকাতো।

ঘটকালী করতে যেয়ে খালাকে অনেক কটু কথা হজম করতে হয়েছিল। এক ছেলের মা তো নোংরা ভাষায় মুখের উপর বলেছিল, ‘ছ্যা ছ্যা, অন্যের ছাড়া ভাত আমার ছেলে কেন খাবে? তার উপরে বাচ্চাওয়ালী মহিলা, নিশ্চয় চরিত্র খারাপ, না হলে কেউ সংসার ছাড়ে?’ তারপর অফিসে জানাজানি হলে, কিছু লোলুপ পুরুষরা যেন ছোঁকছোঁক করেছিল যেন সে একটা সস্তা মেয়েলোক আর তাদের ‘সার্বজনীন বউ’। মীরার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। মাথার উপর না আছে ছাদ, না আছে কোনো নিরাপত্তা। বঞ্চিত আর লাঞ্চিত মীরা, যে সম্মানের জন্য ঘর ছেড়েছিল, তা যেন আরাধ্যই থেকে গিয়েছিল। গরম কড়াই থেকে সে জ্বলন্ত উনুনে যেয়ে পড়েছিল। কন্যা টুকটুকিকে বোর্ডিং এ রেখে পরে সে কর্মজীবী হোস্টেলে উঠেছিল। এখানে কেউ কাউকে খোঁচাত না। তাই এটাই তার নিরাপদ আবাস হয়ে গিয়েছিল।

মীরা তার অতীত কাউকে বলতে চায় না। শফিক তার জীবনটা দেখে আফসোস করছে না কী করুণা করছে কে জানে। শফিকের গাড়ি এসে সামনে দাঁড়াল। শফিক ড্রাইভারের পাশের সিটে যেয়ে

বসেন। মীরা পিছনে আরাম করে গা এলিয়ে বসল। বাসে আর বড় জোর সিএনজি তে অভ্যস্ত মীরা গাড়িতে বেশ আরামবোধ করল। গাড়ির লুকিং গ্লাসে মীরার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল। যে ছিল শুধুই তার, আজ সে আরেকজনের প্রিয় স্বামী, তার পাশে বসাও পাপ। গাড়ি এসে স্কুলের সামনে দাঁড়াল। টুকটুকি দৌড়ে এল। টুকটুকি কাকে আগে জড়িয়ে ধরে সেটা মীরা দেখবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু সে কাউকেই জড়িয়ে ধরল না। একপাশে বাবার আর আরেকপাশে মায়ের হাত ধরে ঘুরতে লাগল। বান্ধবীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। খুব আনন্দে কাটল সময়টা। বিদায়ের সময় দুইজনকেই একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমরা দুইজন এক সাথে পড়বে। আমাদের স্কুলের পিছনে একটা বড় পার্ক আছে। ওখানে বসে ঠান্ডা মাথায় পড়বে, কেমন?’

টুকটুকি কাঁদো কাঁদো চোখে ভিতরে চলে গেল। মীরার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। বাচ্চাটার কত কষ্ট। বাবা-মা ছাড়া একা একা বড় হচ্ছে। মীরা-শফিক দুইজনেই পার্কের বেঞ্চে বসে খাম খুলে চিঠি পড়তে শুরু করল,

আব্বু ও আম্মু,

তোমরা দুইজনেই খুব ভালো আছো, তাই না? আমি কেমন আছি, কখনো জানতে চেয়েছ? আমার এই ছোট্ট জীবনটা কত কষ্টে ভরা তোমরা তা কখনো অনুভব করতে পারবে না। নিজেদের ইগো আর রাগ-অভিমানের বলি হয়েছি আমি। তোমরা তো সুখেই আছ। মাঝখান থেকে আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছ। তোমাদের এত সমস্যা ছিল, তাহলে আমাকে পৃথিবী এনেছিলে কেন? তোমরা পুতুল খেলেছ, আমার জীবনটাকে নিয়ে। আমি তোমাদের কখনোই ক্ষমা করব না।

মাত্র ছয় বছর বয়সে আমাকে এই হোস্টেলে রেখে গিয়েছিলে। আমি একা ঘুমাতে ভয় পেতাম। প্রতিটা রাতে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। হোস্টেল সুপার ম্যাডাম ধমক দিতেন। বালিশে মুখ

গুঁজে দম বন্ধ করে কাঁদতাম যাতে কোনো শব্দ বাহিরে না যায়। কোলবালিশটাকে জড়িয়ে ধরতাম, সেটাকে আব্বু ভাবতাম। মনে হতো আব্বু আমাকে রাইম শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন।

যখন ডাইনিং এ খেতাম, চামচ থেকে ভাত পড়ে যেত। ঠিকমত খেতে পারতাম না। মাকে খুব মনে পড়ত। মা কত গল্প করে করে ধৈর্য নিয়ে খাওয়াতেন। একদিন চামচটাকেই মায়ের হাত হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করলাম। তারপর একদিন কল্পনার আব্বু-আম্মু আমার সাথেই থাকা শুরু করে দিল। আমি যখন খাই তখন আমার কল্পনার আম্মু আমার পাশে বসে থাকে। যখন পড়ি তখন আমার কল্পনার আব্বু আমার পাশে বসে থাকে। ঘুমাতে গেলে আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রাইম শোনায়।

আব্বু, আম্মু, তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমার সাথে কল্পনার আব্বু-আম্মু সবসময়ই থাকে। তারা আমাকে শাসন করে, আদর করে, পড়া দেখিয়ে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়, সব কাজেই তারা আমার পাশে থাকে। কল্পনার এই আব্বু-আম্মুকে আমি যতটুকু ভালোবাসি ঠিক তার বিপরীত বাস্তবের আব্বু-আম্মুকে আমি ঘৃণা করি। ভালোবাসা আর ঘৃণা যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।

তোমরা আমার জন্য প্রতি মাসে দামি দামি খাবার, জামা কাপড়, গল্পের বই, রঙ পেন্সিল আরও কত কী আনো। আমাকে দামি স্কুলে পড়িয়ে তোমরা আনন্দ পাও, তৃপ্তি পাও। নিজেদের অনেক দায়িত্বশীল প্যারেন্টস ভাবো।

অথচ তোমরা আমার কাছে কতই না নিকৃষ্ট তা তোমরা জানো না। আমি আর তোমাদের সাথে অভিনয় করতে পারছি না। হাসিমুখে তোমাদের সামনে দাঁড়াতে আমার কষ্ট হয়। তোমরা যখন বাস্তবে আসো, তখন আমি আমার কল্পনার আব্বু-আম্মুকে হারিয়ে ফেলি। তাদেরকে আবার সামনে আনতে আমার কষ্ট হয়। প্যারালাল দুই জোড়া আব্বু-আম্মু কে নিয়ে মাথার ভিতরটা তোলপাড়

করে। আমার মাথা প্রচন্ড ব্যথা করে। তোমরা দেখা দেবার পরের দুই দিন আমি আর ঘুমাতে পারি না।

প্লীজ তোমাদের একটা অনুরোধ করব, তোমরা আর এসো না। তোমরা এলে আমি পাগল হয়ে যাব। প্লীজ আমাকে ভালো থাকতে দাও। আমাকে আমার কল্পনার আব্বু-আম্মুর সাথেই থাকতে দাও।

ইতি,

কোনো অচেনা মেয়ে

শফিক-মীরার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। নিজেদের সামান্য ইগো আর অহংকারের জন্য তারা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। ‘নো কম্প্রোমাইজ’ স্লোগান বুকে নিয়ে তারা সংসার যুদ্ধ শুরু করেছিল। মাঝখান থেকে একটা নিষ্পাপ শিশুর জীবন ধ্বংস হয়ে গেল। বাচ্চাটার জন্য মীরা কি একটু ছাড় দিতে পারত না? শফিক কি আগ বাড়িয়ে ফোন দিতে পারত না? সরি বলে রাগ ভাঙিয়ে মীরাকে ফেরাতে পারত না? যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আর ফেরার পথ নাই। আকাশ থেকে টপটপ করে বৃষ্টি নামছে। দুইজনেই ভিজছে। ভিতরের জমানো ইগোর আগুন আজ নিভে যাচ্ছে। এত দিনের দহন ঝুম বৃষ্টিতে আজ ছাই হয়ে বাতাসে মিলে যাচ্ছে।

 

টিকাঃ

সন্তান প্রতিপালনে বাবা-মায়ের উপস্থিতি, স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা আর শাসন খুবই জরুরী। তাই এসবের অভাবে ব্রোকেন ফ্যামিলির অধিকাংশ সন্তানেরাই নষ্ট হয়ে যায়। আবার চাকরিজীবী ব্যস্ত বাবা-মায়ের সন্তানদের প্রতি চরম উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়, যা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। সন্তানের পিছনে অর্থ ব্যয় করলেই তারা ভাবেন আসল দায়িত্ব পালন হয়ে গেল। এক

সময় এই সব সন্তানেরা মায়াহীন, ভালোবাসাহীন আর কঠোর মনোভাবের হয়ে পরে। তারা একসময় ভারসাম্যহীন জীবন যাপন শুরু করে দেয়।

অথচ সন্তানকে ইসলামিক ফরজ জ্ঞান দেওয়া তথা নামায, রোযা, যাকাত, যিকির, সৃষ্টির সেবা, সৎকাজে আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ ইত্যাদি সকল কিছু শেখানো এবং তাকে একজন পরিপূর্ণ মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পিতা মাতার।

সন্তানদেরকে মুসলিম হিসেবে তৈরি করা পিতা ও মাতার উপর অন্যতম ফরয আইন। এই ফরয দায়িত্বে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নাই। এ সম্পর্কে আল্লাহ্‌ সুবহানা তায়ালা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা নিজদেরকে এবং পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।’ (সূরা তাহরিম : ৬)

পিতা-মাতার অবহেলায় সন্তানেরা একসময় অকালে ঝরে যায়, তাদের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। ব্যস্ত, স্বার্থপর আর সম্পদের পিছনে ছুটে বেড়ানো পিতা-মাতাকে অবশ্যই একদিন আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে। নিজেদের সুখ, আনন্দ আর ভালো থাকার স্বার্থপরতা কাটিয়ে উঠে স্বামী-স্ত্রী থেকে দায়িত্বশীল পিতা-মাতা তে পরিণত হতে হবে। মনে রাখতে হবে আল্লাহ প্রদত্ত আমানত স্বরূপ এই সন্তানদের জন্য বিচারদিবসে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।

লেখকঃ সাহিত্যিক ও একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপক

আরও পড়ুন