Ads

দুখু মিয়ার ছেলেবেলা

ছেলেটির জন্ম ২৫শে মে ১৮৯৯ সালে । বর্ধমান জেলার আসানসোল মহাকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া inগ্রামে । পিতা ১৮৯৯ সালে । বর্ধমান জেলার আসানসোল মহাকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে । পিতা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান । বড় ছেলে সাহেবজানের পর ৪ ছেলের অকাল মৃত্যু ।

নেক দুঃখ শোকের পর এই শিশুটির জন্ম । তাই শিশুটির নাম রাখা হল দুখু মিয়া । আর দুখুর জন্মের পরে পরেই দুঃখের বান বয়ে গেল গোটা পরিবারে । জৈষ্ঠ্যের ঝড় আর অজয় নদের ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান । বড় ছেলে সাহেবজানের পর ৪ ছেলের অকাল মৃত্যু । অনেক দুঃখ শোকের পর এই শিশুটির জন্ম ।

তাই শিশুটির নাম রাখা হল দুখু মিয়া । আর দুখুর জন্মের পরে পরেই দুঃখের বান বয়ে গেল গোটা পরিবারে । জৈষ্ঠ্যের ঝড় আর অজয় নদের বান একাকার করে দিল সবকিছু । পীর পাহলোয়ানের মাজার, মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ, সারা এলাকার ঘরবাড়ি ডুবে একাকার ।

আশেপাশের দশ বিশটা গ্রামে কাজী বংশের খ্যাতি, মানসম্মান, আভিজাত্য থাকলেও অভাব তাদের বেঁধে ফেলেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে । মুসল্লী মানুষ ছিলেন ফকির আহমেদ । পীর হাজী পাহলোয়ান সাহেবের মাজার আর মসজিদে খেদমত করেই দিন গুজরান হত তাঁর ।
দুঃখের জীবন নিয়ে শুরু হল দুখুর শৈশবকাল । কিন্তু দুখুর মনে দুঃখের লেস মাত্র ছিল না । আনন্দে, আহ্লাদে আর দুষ্টুমি করে কাটত তার দিন ।
‎তার দুষ্টুমির মুখে লাগাম দিতে ফকির সাহেব তাকে ভর্তি করে দিলেন গ্রামের মক্তবে । সেখানে বাংলা ভাষার সাথে সাথে তালিম পেলেন আরবি ও উর্দু ভাষায় । শিখলেন কোরআন পাঠ । তার কোরআন তেলাওয়াত শুনে মৌলভী, মুসল্লিরা অবাক হয়ে যেতেন । পিঠ চাপড়ে বাহবা দিতেন ।

দুখু মিয়া দুঃখের জালে আরো জড়িয়ে পড়লেন । দুখু মিয়ার ১০ বছর বয়সে হঠাৎ মারা গেলেন তার পিতা । মা পড়ে গেলেন অথৈ সাগরে । অগত্যায় শিশু বয়সেই দুখুর ঘাড়ে পড়ল সংসারের জোয়াল । যে মক্তব থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছিলেন সেই মক্তবেই শিক্ষকতার ভার পড়ল তার উপরে । শুরু হল তার আর এক সংগ্রামি জীবন । সেই সাথে পালোয়ানের মাজারে খাদেমগিরি এবং মসজিদের ইমামতি জুটল তাঁর কপালে । তার আজানের ধ্বনি, কোরআন পাঠ শুনে ধন্য ধন্য করল সকলে । কিন্তু মন থেকে দুখু মিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলনা নিজেকে ।
একালের যাত্রা পালার মত সেকালে গ্রামে গ্রামে পালাগান হত । চুরুলিয়া গ্রামের পাশে নিমশা গ্রামে লেটো গানের একটা দল ছিল । একদিন তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে ভিড়ে গেলেন সেই দলে । চাচা কাজী বজলে করীমের কাছে কবিতা, গান লেখার হাতেখড়ি হয়েছিল তার । সেসব কাজে লাগালেন লেটো পালাগানে । লিখলেন সংগীত বহুল ছন্দবদ্ধ নাটক । প্রয়োজনে আসরে কবির লড়াইয়ে নেমেছেন বহুবার । তার পালাগানের কদরও জুটল চারদিক থেকে ।

সেকালের বিখ্যাত কবিয়াল শেখ চকোর, দুখু মিয়াকে “ব্যাঙাচি” আখ্যা দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন — “এই ব্যাঙাচি বড় হয়ে সাপ হবে ।” ঘটেছিল তাই ।
লেটো দলে কাজ করার সময় কিছু পয়সা কড়ি মিলছিল । সংসারের কিছুটা অভাব মিটছিল, তবুও দুখুর মনে হল, নাটক, গান লিখতে হলে পড়াশুনাটা অত্যন্ত জরুরি । তাই একদিন লেটো দলের কাজ ছেড়ে দিয়ে ১২ বছর বয়সে ভর্তি হলেন মাথরুণ স্কুলে ।

কিন্তু অর্থই অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল তার লেখাপড়ায় । তাই পড়াশোনা ছেড়ে একজনের বাড়িতে গার্ড দেবার কাজে নিযুক্ত হলেন ।
কিন্তু সেই কাজ তার মোটেই ভালো লাগলো না । একদিন কাউকে কিছু না বলে সোজা চলে গেলেন আসানসোলে ।
সেখানে মাওলা বক্সের রুটির দোকানে ৫ টাকা মাইনের চাকরি নিলেন । দিনের বেলায় রুটি বানানো আর বিক্রি করাই ছিল তার কাজ । দিনের বেলায় হাড়ভাঙা খাটুনি আর রাতের বেলায় সুর করে পুঁথি পড়া । “হাতেম তাই”, “জঙ্গনামা”, ” চাহার দরবেশ” আরো কত পুঁথি । আশেপাশের লোকজন সেই পুঁথি মনোযোগ সহকারে শোনে । অবাক হয় । গালে হাত দিয়ে ভাবে । তাঁর পুঁথি পড়ায় খুব আকৃষ্ট হয় এক সদাশয় দারোগা । নাম কাজী রফিজউল্লা । বাড়ি ময়মনসিংহে । দুখু মিয়ার অসাধারণ প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে নিয়ে গেলেন নিজের গ্রামে, কাজীর শিমলায় । তাঁকে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাইস্কুলে । সেটা ছিল ইং ১৯১৪ সাল । দারোগা সাহবের স্ত্রী শামসুননেশার তাঁকে মাতৃ স্নেহে কাছে টেনে নিলেন । কিন্তু বছর পার হতে না হতেই দুখু মিয়ার মনে হল তিনি যেন পিঁজরার পাখির মত আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন ।

তার সুর করে পুঁথি পড়া, গান গাওয়া, বাঁশি বাজানো, কবিতা লেখা সব হারিয়ে যেতে বসেছে । তার স্বাধীন সত্তা বিলিন হবার মুখে । সেটা বাঁচাতে একদিন ফিরে এলেন আসানসোলে ।

ভর্তি হলেন রানীগঞ্জের শিয়ারশোল স্কুলে, ক্লাস এইটে । বন্ধু হিসাবে পেলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে । বন্ধু লিখতেন কবতা, দুখু লিখতেন গল্প । পরে ব্যাপারটা গেল উল্টে । দুখু লিখলেন–

এপার হতে মারলাম ছুরি/লাগলো কলাগাছে/হাঁটু বেয়ে পড়লো রক্ত/চোখ গেলোরে বাবা । কবিতা শুনে শৈলজানন্দ হেসে কুটোকুটি ।

স্কুলে গুরু হিসাবে দুখু পেয়েছিলেন চারজন শিক্ষকের সহচার্য । এরা হলেন– ১ । কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ২ । নিবারণ চন্দ্র ঘটক ৩ । হাফিজ নূরুন্নবী এবং ৪ । সতীশ চন্দ্র কাঞ্জিলাল । প্রথমজনের কাছে শিখলেন কবিতার শব্দ নির্বাচন, দ্বিতীয়জনের কাছে বিপ্লবের মন্ত্র, মুক্তি যুদ্ধের চেতনা, দেশোদ্ধারের প্রেরণা, তৃতীয় জনের কাছে শিখলেন ফরাসী ব্যাকরন, কবিতার ছন্দ মাধুর্য, আর চতুর্থ জনের কাছে পেলেন সংগীতের সুর ।
দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় হঠাৎ বেজে উঠল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা । অশান্ত হয়ে উঠল দুখু মিয়ার মন । পড়াশুনা সব জলাঞ্জলি দিয়ে, সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি যোগ দিলেন সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে । পড়ে রইল তার ম্যাট্রিক পরীক্ষা । প্রশিক্ষণ শেষে তাঁর স্থান হল করাচীর ৪৯ নাম্বার বাঙালি রেজিমেন্টে । সেখানে পাঞ্জাবেরএক মৌলভীর সাথে পরিচয় হয় তাঁর । তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী গুণী লোক । তাঁর স্নেহছায়ায় আরবি ও ফারসি ভাষা রপ্ত করেন দুখু মিয়া । তারপর ফরাসি ভাষায় লেখা ওমর খৈয়াম, শেখ সাদী ও হাফিজের সমস্ত রচনার সাথে পরিচিত হন । ফলে নতুন চিন্তা ভাবনার দিগন্ত খুলে যায় দুখু মিয়ার চোখের সামনে ।
১৯২০ সালে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেয় ইংরেজ সরকার । ফলে চাকরি হারিয়ে আবার অথৈ জলে পড়ে যান দুখু মিয়া ।
যুদ্ধে যোগদানের জন্য ইংরেজ সরকার তাঁর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে ছিলেন । কিন্তু সে চাকরি অবলীলায় ত্যাগ করে তিনি চলে গেলেন কোলকাতায় । বেছে নিলেন সাংবাদিকতার অনিশ্চিত জীবন । কারণ যুদ্ধের বীভৎসতা ও মানবিকতা লঙ্ঘিত হতে দেখে খুব মর্মাহত হয়েছিলেন খুব ।
‎পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করতে, মানুষের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালতে ১৯২১সালে “মোসলেম ভারত” কাগজে লিখলেন “বিদ্রোহী” কবিতা । ওই একটি কবিতাতেই দুখু মিয়ার পরিচিতি জেনে গেল দুনিয়ার লোকে । তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ।
‎এরপর তিনি হাত দেন সম্পাদনার কাজে । প্রকাশ করেন “ধূমকেতু” নামে একটি পত্রিকা । দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়ে কবি লিখলেন–

সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়, স্বরাজ-টরাজ বুঝি না । কেননা, এ কথাটার মানে এক এক সারথী এক এক রকম করে থাকেন । ভারতের এক পরমাণু অংশওবিদেশের অধীনে থাকবে না । ভারতবর্ষের সম্পূর্ন স্বাধীনতা রক্ষা শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে ।”

‎”আনন্দময়ীর আগমনে” কবিতায় তিনি লিখলেন–

“আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল / স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারি শক্তি চাঁড়াল ।” এই কবিতার জন্য এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয় কবির ।

জেলের মধ্যেই কবি অনশন করতে শুরু করেন । অবশেষে জেল কর্তৃপক্ষ মেনে নেয় কবির দাবী । লেখার কাগজ, কালিকলম, হারমোনিয়াম প্রভৃতি সরবরাহ করে জেল । ৪০ দিন পরে তিনি অনশন ভাঙেন । কারাগারে বসে কবি লিখেন— “এ শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল/এ শিকল পরে শিকল তোদের করব রে বিকল”।
‎কবির মুক্তির জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস জনসভা ডাকলেন কোলকাতার গোলদিঘিতে । পরে কবি মুক্তি পান জেল থেকে ।
‎১৯২৪ সালের ২৪শে এপ্রিল প্রমিলার সাথে কবির বিয়ে হয় । সেই বছরেই কবির “বিষের বাঁশী” ও “ভাঙার গান” বই দুটি প্রকাশিত হয় ।
‎১৯২৬ সালে লেখেন– দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার । এ ছাড়াও অজস্র কবিতা,গান । সেগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয় । মুহূর্তে তা নিঃশেষ হয় । কিন্তু কবি তার পয়সা পায় না । এরকম একটা কঠিন পরিস্থিতিতে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা । ১৯২৮ সালে কবির মা জাহেদা বিবি হঠাৎ মারা যান । কবি খুব মুষড়ে পড়েন ।
‎১৯৩০ সালে বসন্ত রোগের প্রকোপে মারা যায় তার প্রিয় পুত্র বুলবুল । উদভ্রান্ত, দিশেহারা হয়ে পড়েন কবি । সেই অবস্থায় ২৫শে অক্টোবর তাকে আবার কারারুদ্ধ করে সরকার । প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে সারা দেশে । ফলে ৭ই নভেম্বর তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় বৃটিশ সরকার ।
‎১৯৪০ সালে কবি পত্নী আচমকা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন । ১৯৪২ সালে কবি চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলেন তার বাকশক্তি । শেষ হয়ে যায় তার সাহিত্য জীবন । ১৯২১ থেকে ১৯৪২ সালের কিছুদিন পর্যন্ত
‎প্রায় ৫০টির মত বই লিখেছেন কবি । গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, গান , কি লেখেনি তিনি ? লিখেছেন শ্যামাসংগীত, ইসলামী গজল সহ অনেক গীত । আকাশবাণী কলকাতার সাথে জড়িয়ে ছিলেন বহুদিন ।
‎১৯৬২ সালে প্রমিলা মারা যান । ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হলে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বাংলাদেশে নিয়ে যান । জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেন । ডি, লিট খেতাব, ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন । ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি প্রদান করা হয় । এছাড়া মাসিক সরকারি ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয় ।
‎ধানমন্ডির বাড়িতে কবি অসুস্থ হলে তাঁকে পি, জি, হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগষ্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । পি, জি, হাসপাতালের মসজিদ চত্ত্বরে তাঁকে কবর দেওয়া হয় । অগণিত লোক তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন । দোয়া করেন তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় । কবির বাক শক্তি হারাবার আগে এক ভাবাবেগে লিখেছিলেন—

“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন গোর থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই ।”
সারাজীবন লড়াই করে গেছেন কবি ।

সংসারের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, কিন্তু তার সুফল জোটেনি তার কপালে । দুঃখে শোকে কেটেছে তার সারা জীবন । সেই জীবন শেষে তার শান্তি এইটুকু, গোর থেকে আজান শোনার মোনাজাত তার পূরণ করে দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা । এটা তাঁর অশেষ কৃপা, সীমাহীন করুণা ।

লেখকঃ সৈয়দ রেজাউল করিম, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

_____________________________________

আরও পড়ুন