Ads

নিভৃতচারিনী-১ঃ তিতাসের কথা

শামীমা নাসরিন

ছোটবেলা থেকেই রূপম আমার বন্ধু। বয়সে আমার চাইতে বছর দুয়েকের বড় হলেও বন্ধুত্বে আটকালো না আমাদের। দেখতে ছোটখাট শ্যামলা চেহারার আমাকে কখনোই কোন অবস্থাতে আর যাই হোক সুন্দরী কেউ বলবে না। ছোট বেলায় বিষয়টা নিয়ে ভাববার অবকাশও হয়নি। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকার কারনে বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের বন্ধুত্ব বরং দিন দিন গাঢ় হতে থাকে। স্কুলটা ছিল আমাদের ইন্টার পর্যন্ত। তাই স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত দু বছর আগুপিছু করে পড়া শেষ করার পরে রূপম ঢাকা ভার্সিটি ভর্তি হলে শুরুতে কয়েক ঘন্টার জন্য মাঝে ছাড়াছাড়ি হয় আমাদের। আস্তে আস্তে সে বিচ্ছেদের সময়ের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। সে সময়টাতে আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি রূপমকে আমি ভালবাসি। ছুটে যাই রূপমের কাছে। রূপম তখন ব্যাস্ত তার ভার্সিটিতে সদ্য পাওয়া নূতন বন্ধুদের নিয়ে। আমাকে দেখে আগের সেই বন্ধুত্বের হাতছানি তার দুচোখে আর দেখি না। কেমন যেন অচেনা কারোর মত পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আমি ভেতরে যাই, আন্টির সাথে গল্প করে চলে আসি। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে রূপমদের বাসায় ওর অনেক বন্ধু বান্ধবের ভিড় হয়। ছেলে বন্ধু, মেয়ে বন্ধু অনেক। বন্ধ দরজার এপার থেকে ওদের কথাবার্তা, হাসি আর খুনসুটির শব্দ শুনি। ভেতরে আন্টিকে দেখি ব্যাস্ত সমস্ত রূপমের বন্ধুদের চা নাস্তা সাজাতে। হঠাৎ কি মনে হলো একদিন আন্টিকে বললাম,

– আন্টি আমাকে দাও আমি নিয়ে যাই
– তুই নিবি? আচ্ছা নিয়ে যা। পারবি তো? ভারি আছে কিন্তু।
– পারতে তো আমাকে হবেই….।

কাদের নিয়ে রূপমের এত ব্যাস্ততা তাতো আমার জানতে হবে। মনে মনে বলি আমি। ট্রে হাতে এগিয়ে গেলাম রূপমের ঘরের দিকে। মৃদু নক্ করতে দরজা খুলে দাঁড়ায়। চমকে যায় আমায় দেখে,
– তুমি? ময়না কই?
হাত থেকে ট্রে হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করে রূপম। দরজা একটু ফাঁক রেখে এমনভাবে দাঁড়ায় রূপম যেন ভেতর থেকে কেউ আমায় দেখতে না পারে।
– ময়না মনে হয় অন্যকাজে ব্যাস্ত। আন্টি বললে….
– ও আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে…. এবার যাও তুমি। —- বলে মুখের ওপর দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ করে দেয় রূপম। বন্ধ দরজাটা যেন এক সেকেন্ডে মনে হলো আমার বুকের ওপর এসে পড়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। ভেতরটা বোবা কান্নায় ভরে আছে। কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেদিন সারারাত ঘুমালাম না। নিজের রূপবিহীন চেহারাটা আয়নায় বারবার খুঁটিয়ে দেখতে থাকি। পাশাপাশি রূপমের মেয়ে বন্ধুদের দাঁড় করাই। হেরে যাওয়া মন নিয়ে নিদ্রাহীন দুচোখে রূপমের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত মনের পর্দায় ভেসে বেড়াতে থাকে। পরদিন অনেক বেলায় ঘুম থেকে জাগি। বারান্দায় যেতে অজানতে রূপমদের বাসার দিকে চোখ যায়। ধীরে ধীরে রূপমদের বাসায় যাওয়া কমিয়ে দিই। আড়ালে লক্ষ্য রাখি রূপমের দিকে। বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যাস্ততা আরো বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিন তাদের আসা যাওয়া দেখতে পাই। মায়ের কাছে শুনলাম ওরা সবাই মিলে গ্রুপ স্টাডি করে রূপমের বাসায়। প্রায়ই দেখি সাতজন ছেলে মেয়ে একসাথে আসে রূপমের বাসায়। কয়েকদিন লক্ষ্য রাখতে একটা কিছু বিসদৃশ ঠেকতে থাকে আমার চোখে। রূপমের সব বন্ধু আগে পরে একসাথে আসলে ও সবাই একসাথে যায় না। রায়না নামের মেয়েটা যায় সবার শেষে। রূপম মেয়েটাকে আগিয়ে দিয়ে রিক্সায় তুলে দেয়। যা বুঝার বুঝে নেই আমি। নিজেকে নিজের বশে আনার চেষ্টা করি। রূপমের সামনে না পড়ার চেষ্টা করি। রূপমকে ভোলার জন্য পড়াশুনায় মন প্রান সঁপে দিই। যেন নিজের রূপবিহীন চেহারার ঘাটতি মেটানোর একটা সূক্ষ্ম প্রয়াস। আশাতীত রেজাল্ট হয় আমার ইন্টারে। ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবারো একসাথে হলাম রূপমের। একি ডিপার্টমেন্ট….। প্রথম এবং তৃতীয় বর্ষ। পাশাপাশি ক্লাস। আবারো রাতদিন চোখের সামনে রূপম। তবে আগের রাতদিন আর এখনকার রাতদিনে বিস্তর ফারাক। আগের রাতদিনে ক্লাসের সময়টুকু বাদে রূপমের সাথে থাকতাম আমি। এখনকার রূপমের সাথে আমার যোজন যোজন ফারাক। তার সাথে আজ আর আমি নই অন্য কেউ। রায়নাকে সবসময় রূপমের সাথে সেঁটে থাকতে দেখি। ক্লাসের বাইরে দুজনকে হাত ধরে হাঁটতে দেখি। একদিন এ অবস্থায় ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হতে সামনা সামনি হয়ে যায় ওরা আমার। পাশ কাটিয়ে যাই আমি। ছুটির পরে বের হতে রূপমের সাথে দেখা গেইটের কাছে। যেন সে এতক্ষণ আমারি অপেক্ষায় ছিল। কাছে যেতে একটু হেসে জিজ্ঞেস করে,
– এত দেরী করলে যে? এতক্ষনে ছুটি হলো?
– না… টিউটোরিয়াল জমা দেয়ার ডেট ছিল। তাই দেরী হলো। তুমি যাওনি ?
– না তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একসাথে যাব
– হঠাৎ?
– হঠাৎ আবার কি? একসময় স্কুল, কলেজ থেকে তো এক সাথেই ফিরতাম।
বুকের ভেতরটা কি একটু উদ্বেল করে ওঠলো? ভেতরের আবেগটুকু প্রশ্রয় দেয়া কি ঠিক হবে? একটু তাকালাম রূপমের দিকে। ও জানে না এখনো ওর মুখের দিকে তাকালে ওর ভেতরটা পড়তে পারি আমি। অনেক কষ্টে ভেতরের ঢেউটাকে আরো ভেতরে চালান দিয়ে মুখে মুচকি হাসি টেনে বললাম,
– ভেবো না বাসায় কেউ কিছু জানবে না
– মানে? চমকে ওঠে কি রূপম?
– মানে তো পরিষ্কার রূপম। তুমি ভয় পাচ্ছ আমি তোমার আর রায়নার ব্যাপারটা বাসায় বলে দিতে পারি। আমি কিছু বলব না কাউকে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।— বলে আর দাঁড়ালাম না। সামনে দাঁড়ানো একটা রিক্সায় ওঠে রিক্সাওয়ালাকে বললাম,
– মামা চালাও
আমি জানি পিছনে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে রূপম।
পড়াশুনায় আরো ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। এছাড়া উপায়ও নেই। যতক্ষণ একাকি থাকি রূপম আমার পিছু ছাড়ে না। ডিপার্টমেন্টেও পারতোপক্ষে ওর সামনে পড়তে চাই না। এর মধ্যে প্রথম বর্ষ ফাইনাল হয়ে যায়। ডিপার্টমেন্ট এ রেকর্ড পরিমান নাম্বার নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উঠি। বাসায় সবাই আমার উত্তরোত্তর ভাল রেজাল্ট দেখে খুব খুশি। এস এস সি তে ছিল এ প্লাস, এইচ এস সি তে গোল্ডেন এ এবারে আরো ভাল। আত্নীয় পরিজন সবাই আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাসায় এবং ভার্সিটিতে সবাই বাহ্ বাহ দেয়। অনেকের চোখে মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে পড়তে দেখি। শুধু আমি জানি এর কৃতিত্ব কার? রূপম যদি অবহেলায় আমার জীবনটা মুড়িয়ে না দিতো আমি আজকের এই আমি হয়ে ওঠতাম না। অপেক্ষায় ছিলাম রূপম কবে আসবে? নাহ্ আসেনি ও। তবে ডিপার্টমেন্ট এ দেখা হয়েছিল। নোটিশবোর্ডের সামনে। যথারীতি রূপমের হাতের মুঠোয় রায়নার হাত। নোটিশ পড়ে পিছন ফিরতে দুজনের মুখোমুখি হয়ে যাই। রায়নাই আগে কথা বললো,
– আরে তিতাস যে… কনগ্র্যাচুলেশান্স! তুমি তো সুপার্ব রেজাল্ট করেছ। তুমি যে এত ভাল স্টুডেন্ট কখনো বল নি তো?
হাসলাম আমি। তাকালাম রূপমের দিকে। দেখি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম,
– তোমরা এখানে?
– ফাইনালের রুটিন দেখতে আসলাম। নোটিশ বোর্ডে আছে।
– ও হ্যা যাও…. বলে জায়গা ছেড়ে দিয়ে সরে আসলাম আমি।
তরতর করে দিনগুলি পার করছিলাম। তৃতীয়বর্ষে উঠে গেলাম। রেজাল্ট অপরিবর্তিত। বাসায় এক আধটু ঘটকের আনাগোনা শুরু হয় টের পাই। মাকে ডেকে সোজা মানা করে দেই এসময় যেন আমাকে বিরক্ত না করে। মাস্টার্স ফাইনালের আগে বিয়ে শাদীর চিন্তা ভাবনার প্রশ্নই আসে না। মা একটু দোনমনো করলেও বাবা মেনে নিলেন। এর ভেতরে একটা হোঁচট খেলাম। রূপমের অনার্স ফাইনালের রেজাল্ট বের হয়। রূপম ভাল করে না। রায়না সেকেন্ড ক্লাস।
রায়না কে আজকাল রূপমের পাশে দেখা যায় না। ভার্সিটিও কম আসে। এরমধ্যে একদিন জানতে পারি প্রবাসী এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে রায়নার বিয়ে হয়ে গেছে। মনটা চাইলো রূপমের কাছে ছুটে যাই। ওর এই দূঃসময়ে ওর পাশে দাঁড়াই। গেলাম না। একটা সংকোচ, একটা দ্বিধা আমার পথরোধ করে দাঁড়ালো। অনেক দিন ধরে দুজনের মাঝখানে একটু একটু করে যে প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে সে প্রাচীর আজ ডিঙোতে পারলাম না কিছুতে। দূর থেকে রূপমের ভেঙে পড়া চেহারাটা দেখে মনে মনে শুধু কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।
রূপমের মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হয়েছে আজ। ভার্সিটি ঢুকে খবরটা পেয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না কিছুতে। ক্লাসে ঢুকার আগে নোটিশবোর্ডে গেলাম। রূপমের রোল নাম্বার জানা নেই আমার। কাউকে জিজ্ঞেস করবো? জিজ্ঞেস করার আগে পিছন থেকে রূপমের গলার আওয়াজে ফিরে তাকাই।
– তুমি এখানে?
– রেজাল্ট দেখতে আসলাম
– কার?
– স্পেসিফিক কারো না। এমনি ডিপার্টমেন্ট এর রেজাল্ট কেমন হলো দেখতে এসেছি। চলে আসছি এমন সময় রূপমের ডাকে ফিরে তাকাই
– শোন আমি সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি, তাও টেনেটুনে। এটাই তো জানতে এসেছিলে তাইনা? আমি থতমত খেয়ে যাই। কিছু বলতে যাব আমাকে থামিয়ে দিয়ে রূপম বলে,
– থাক্ আর চালাকি করতে হবে না। তোমাকে ওটা মানায় না। এবার যাও…। আর হ্যা করুণা দেখাতে এসো না আমাকে। কারো করুণার ধার আমি ধারি না।
এত জনের সামনে রূপমের এমন তীব্র কথার অপমানে আমার চোখমুখ ঝা ঝা করে ওঠে। কিছু বলতে পারি না আমি। চোখের পানি লুকোতে সে জায়গা ছেড়ে দ্রুত সরে আসি আমি। কি করে রূপমকে বুঝাই আমি রূপমকে করুণা করতে যাইনি। ওকে আমি করুণা করতে পারি না। ও আমার ভালবাসা, আমার স্বপ্ন।ওকে ভালবেসে আমি ওর রেজাল্ট দেখতে গিয়েছি। গত দুই বছরে রূপমের কোথাও ভাল কিছু হয়নি। বিসিএস দিয়েছিল দুই দুইবার। একবার রিটেনে আউট আর একবার ভাইভা পর্যন্ত গিয়ে আউট। এরপর বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ দেয়। ছয়মাস আগে কোন এক আত্নীয়ের সুপারিশে মাঝারি গোছের একটা ব্যাংকে জয়েন করে সে। ঐ ঘটনার পর আর রূপমের সামনে পড়ি না। যথাসম্ভব এড়িয়ে যাই। তবে রূপমের চাকরীর পরে ওকে অভিনন্দন জানাতে ভুলি না। এরমধ্যে আমার ফাইনাল হয়ে যায়। ডিপার্টমেন্টে জয়েন করি আমি। বাসা থেকে আবার সম্বন্ধ দেখে। আবারো এড়িয়ে যাই। এবারে এড়িয়ে যেতে বেশ চাপে পড়তে হয় আমায়। বাবাকে অনেক কষ্টে বুঝাতে পারি যে সামনে আমার একটা কমনওয়েলথ স্কলারশীপ হতে পারে এ সময় বিয়ের চক্করে পড়লে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। অন্তত আর দুটো বছর সময় চাই আমার। এম এস টা করে এসে বিয়ের কথা ভাবা যাবে
বাবা খুব মন খারাপ করে পিছু হটলেন। মাস ছয়েকের মধ্যে এম এস করার জন্য বিদেশ পাড়ি দেই আমি। ওখানে বসেই বাবা চলে যাওয়ার খবর পাই। এম এস শেষ করে দেশে ফিরে আসি। দেখে শুনে ছোটবোনটার বিয়ে দেই। মা কিছুতে রাজি হচ্ছিল না আমার আগে তিতিরের বিয়ে দিতে। রাজি হতে হলো। আমি ছাড়া মায়ের আর কে আছে?
আজকাল আবার রূপমদের বাসায় যাতায়াত শুরু করি। তবে বেশিরভাগ সময় রূপম থাকে না তখন। রূপম থাকলে আমার দুচোখ তখন রূপমের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। রূপমদের বাসায়ও আজকাল ঘটকের আনাগোনা শুরু হয়েছে। বাসায় গেলেই আন্টি একগাদা মেয়ের ছবি আমার সামনে মেলে ধরে। আমি একটার পর একটা ছবি দেখি আর নাকচ করতে থাকি।

(চলবে)

লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক

 

আরও পড়ুন