Ads

পাগলের খপ্পরে একদিন

মো ইব্রাহীম খলিল

একদায় সকাল আটটার দিকে বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি একটি মুরগী কোলে নিয়ে সামু পাগলা আসতেছে। সামু পাগলার বাড়ি আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ায়। বউ বাচ্চা আছে। কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, সামু ভাই, মুরগী নিয়ে কই যান?
সামু পাগলা আমার কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল। মুখটা কালো করে কিছুটা ব্যথিত কণ্ঠেই বলল, ডাক্তারের কাছে।
তার মুখের ব্যথিত ভাব এবং ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা শুনে ভাবলাম বাড়ির কারো হয়তো গুরুতর অসুখ করেছে। জানার জন্য আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কার অসুখ?
কার অসুখ প্রশ্ন করতেই সামু পাগলা ক্ষেপে গেলো, আমাকে একটা রাম ধমক দিয়ে বলে উঠল, তুই লেখাপড়া শিখছস কি করতে? চোখে দেখোস না? মুরগীডা যে অসুখে কাহিল হয়া পড়ছে?
পাগলের কথা শুনে ব্যাক্কেল হয়ে গেলাম, আমি ভাবলাম কি, আর পাগলে কয় কি? পাগল আমার উপর খামাখা ক্ষেপলেও আমি পাগলের উপর ক্ষেপতে পারলাম না, কারণ পাগল কারো উপর ক্ষেপে গেলে হয় মেরে বসে নয়তো অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। সেই ভয়ে তার উপর না ক্ষেপে উল্টো পাগলরে খুশি করার জন্য মুরগীর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, হ দেখলাম, মুরগী খুব কাহিল হইছে।
তার কথার অনুকুলে আমি কথা বলায় পাগল মনে হয় কিছুটা শান্ত হলো। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, এখন ক তো কোন ডাক্তার দেখামু?
আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, আপনি যাইবেন কোনখানে হেইডা না কইলে তো কইবার পারতেছি না?
পাগলের ঝটপট উত্তর, কুমিল্লা শহরে যামু।
— শহরে গেলে মাইনষেই আপনারে কয়া দিব কোন ডাক্তার দেখাইতে হইবো।
আমার কথা শুনে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার থেমে গেল। পিছন ফিরে বলল, এই হোন্– মহিলাদের জানি কোন ডাক্তার দেহায়?
— মহিলাদের মহিলা ডাক্তার দেখায়।
— আরে হেইডা তো জানি, হেই মহিলা ডাক্তাররে জানি কি কয়?
— গাইনী ডাক্তার।
গাইনী ডাক্তারের নাম শুনেই পাগল খুশি হয়ে বলল, হ হ এইবার পাইছি, মুরগী তো মহিলাই, মহিলা মুরগীরে পুরুষ ডাক্তার দেহান উচিৎ হইবো না, হাজার হইলেও পর্দা-পুশিদার একটা ব্যাপার আছে না?
পাগলের কথা শুনে মুখ ঠেলে হাসি আসতে লাগল, কিন্তু পাগলের সামনে হাসতে সাহস পেলাম না। যদি ক্ষেপে গিয়ে হাতের মুরগী দিয়েই মাথায় বাড়ি মেরে বসে। তখন পাগল ঠেকানোর জন্য এই মুহুর্তে কেউ এগিয়ে আসবে না। কাজেই পাগলের মাইর খাওয়ার ভয়ে খুব কষ্টে মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
পাগল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তাইলে কি শহরে গিয়া গাইনী ডাক্তারই দেহাইতে হইবো?
পাগলের কথায় সম্মতি দিয়ে বললাম, হ ভাই, গাইনী ডাক্তার দেখানোই ভালো হইবো।
আমার সম্মতিমূলক কথা শুনে পাগল হনহন করে রওনা দিল। অল্প কিছুদূর গিয়েই আবার থেমে গেল, ফিরে এসে বলল, এই হোন, তোর কাছে ট্যাকা আছে?
— ট্যাকা দিয়া কি করবেন?
— আরে খালি হাতে কি আর শহরে যাওয়া যায়? বিড়িটিড়ি খাওয়া লাগবো না?
মনে মনে আমার আক্কেলের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলাম, কোন আক্কেলে যে সকাল বেলা পাগলের সাথে কথা বলতে গেলাম, বিনা কারণে ধমকও খেলাম এখন টাকাও দেওয়া লাগে। তাকে যদি আরো কিছুক্ষণ আটকিয়ে রাখি তাহলে না জানি আবার কি চেয়ে বসে, তাই পাগল বিদায় করার জন্য তাড়াতাড়ি পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে দিলাম। পাগল টাকাটি পকেটে নিয়ে আবার হন হন করে রওনা হলো। তার হনহন করে চলে যাওয়া দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু হাফ ছেড়ে বাঁচতে চাইলেও বাঁচা হলো না। পাগল বেশি দূর গেল না, অল্প কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই হোন্।
পাগল পুনরায় ফিরে আসায় নতুন কোন ঝামেলা করবে কিনা এমন দুশ্চিন্তায় মুখটা কালো হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে আস্তে করে বললাম, কী?
পাগল আমার কাছাকাছি এসে মুখটা সামনের দিকে এগিয়ে এনে চোখ দুটা বড় বড় করে প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে বলল, শহরে যদি ভালো ডাক্তার না পাই তাইলে কই যাইতে হইবো?
অকস্মাৎ তার বড় বড় চোখ করা দেখে ভয়ই পেয়েছিলাম কিন্তু প্রশ্ন শুনে সাহস পেলাম। একটা হাসি দিয়ে মাথা ডানে বামে ঝাকিয়ে বললাম, তাইলে তো ভাই বহুত দূরে যাইতে হইবো।
আমার মাথা ঝাকানো দেখে পাগল যেন খুব চিন্তায় পড়ে গেল। মুখটা বিবর্ণ করে বলল– বহুত দূর আবার কোন জায়গা রে?
বললাম– ঢাকা।
ঢাকার নাম শুনেই পাগলের মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ও ঢাকা– ঢাকার নাম তো ম্যালা শুনছি। তয় ঢাকা যাইতে কতক্ষণ লাগবো রে?
— কিসে যাইবেন, ট্রেনে না হাইটা?
ট্রেনের কথা বলতেই পাগল বিরুক্তি প্রকাশ করে ডান হাত নেড়ে নেড়ে বলল, না না না-হ, ট্রেনে যামু না, ট্রেন একটু পরপরই খালি স্টেশনে স্টেশনে থামায়, শরীরে রাগ ধইরা যায়, ট্রেন যতই জোরে চলুক না ক্যান এত ঘনঘন থামাইলে কি রাস্তা আউগায় রে? রাস্তা আউগায় না? তার চায়া হাইটাই ট্রেনের আগে যাইবার পারমু।
পাগল তো পাগলই, এখান থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ১২০’ কিলোমিটার অথচ পাগল বলে হেঁটেই ট্রেনের আগে যেতে পারবে। পাগলরে এসব কথা এখন বুঝায় কে? পাগলের কথার বিপক্ষে গেলেই তো বিপদ, তাই তার কথার বিপক্ষে না গিয়ে সায় দিয়ে বললাম, হ ভাই, ঠিক কথাই কইছেন, আসলেই ট্রেনে যাওয়া উচিৎ না, একটু পরপরই খালি থামায়, রাস্তা মোটেই আউগায় না, তার চায়া হাইটাই যান, হাইটা গেলে তাড়াতাড়ি যাইবার পারবেন।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই একটু এগিয়ে এসে বলল, তাইলে তরে যে আরো একটু উপকার করা লাগে রে।
তার কথার ভঙ্গি দেখে নতুন বিপদ মনে হলো, মাথা চুলকিয়ে বললাম– কি উপকার?
পাগল হাসি হাসি মুখেই বলল– আরো পাঁচটা ট্যাহা দে। অনেক পথ হাঁটতে হইবো না– ম্যালা বিড়ি লাগবো।
সকাল বেলা আগ বাড়িয়ে কথা বলে যে কি বিপদে পড়লাম, টাকা থাক আর না থাক ধার কর্জ করে হলেও দিতে হবে, তা না হলে যদি পাগল ক্ষেপে যায় তখন দৌড়িয়ে কুল পাওয়া যাবে না। মুখটা কাচুমাচু করে পকেট থেকে আরো পাঁচ টাকা বের করে দিলাম। পাগল টাকা পেয়ে মুরগী নিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে চলে গেল।
দুপুরের পরপর বাড়ির পিছনে কপুকুর পাড়ের আইলে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সাথে আরো দুইজন দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় দেখি পাগল দক্ষিণ দিক থেকে ফিরে আসতেছে। কোলের ভিতর তখনও মুরগী। তবে মুরগী জ্যান্ত নেই, মরে ঘাড় হেলে পড়েছে।
কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, সামু ভাই, শহরে যান নাই?
পাগল মুখটা কলো করে শোকাতুরভাবে বলল, নারে ভাই, যাওয়া হয় নাই, অর্ধেক রাস্তা যাইতেই মুরগী ইন্তেকাল করছে।
মুরগী মরার শোকে শোকাতুর পাগলের ভাব দেখে মনে হলো — এ যেন মুরগী নয় তার নিজের কোন ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজনই মরেছে। তার ভাব দেখে ঠেলে হাসি আসতে লাগল, কিন্তু হাসলেই বিপদ। তাই ভয়ের মাঝেও তার শোকের সাথে তাল মিলিয়ে রসিকতা করে বললাম, আহারে! এত সুন্দর মুরগীডা ইন্তেকাল করলো! দুকখে কইলজাডা ফাইটা যাইতেছে।
পাগল রসিকতা বুঝতে না পেরে আমার কথাটাকে সত্যি ধরে নিয়ে বলে উঠল– হ রে– আর কইস না, মুরগীর শোকে আত্মা ফাইটা চিক্কুর আইতেছে।
আমি বললাম, সামু ভাই, চিক্কুর পাইরা কান্দলে তো আর লাভ নাই, যা হইবার তা তো হইছেই, এহন এই মরা মুরগী কি করবেন?
অসহায় ভাবে বলল, কি আর করমু– বাড়িত নিয়া তর ভাবীরে দেই– হে যা করার করবো।
এমন সময় পাগলের বউ এসে উপস্থিত। পাগলের কোলে মরা মুরগী দেখেই জ্বলে উঠল, এহন ভালো হইলো না? এত কইরা কইলাম মুরগীর ব্যারাম হইছে, জবহ্ কইরা দেই, পোলাপানে খাইবো। উনি জবহ্ না কইরা বড় ডাক্তার দেহাইতে নিয়া গেল। ডাক্তারের আর খায়াদায়া কাম নাই, মানুষ থুইয়া হ্যার ব্যারাইমা মুরগীর চিকিৎসা করবো? আমি এতো কইরা না করলাম তারপরেও জোর কইরাই মুরগীডারে নিয়া গেল, এহন মরা মুরগী কোলে নিয়া নাচতে নাচতে আইছে।
বউয়ের কথা শুনে পাগল তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল, ওইডা কোন কথা কইলি রে, মুরগীর অসুখ হইলেই জবহ্ করা লাগবো ক্যান?
— তাইলে কি করবা, এহন যে মুরগী মইরা গেল, এই মুরগী কোন কামে লাগবো?
— মুরগীর অসুখ হইলেই জবহ করা লাগবো মানে? ওই মাগী– তুইও তো মুরগীর জাত, তর অসুখ হইলে তরে ধইরা জবহ করলে কেমুন লাগবো?
পাগলের মেজাজকে পাত্তা না দিয়ে বউ ঝামটা মেরে বলে উঠল, জবহ করলে করবা, তাও তোমার মত পাগলের জ্বালা আর ভালো লাগে না।
পাগলের বউ কথাগুলো শেষ করতে না করতেই পাগল মুরগী দুই হাত দিয়ে ধরে বউয়ের মুখের উপর ছুঁড়ে মেরেই গালি দিয়ে উঠল, ধর মাগী, তর মুরগী তুই নি। শালার খবিস জানি কোনহানকার? কাউরে উপকার করতে দেখলেই মাগী জ্বইলা পুইড়া মরে, বলেই হন হন করে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
আমরা তিনজন তখনও দাঁড়ানো ছিলাম, ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলাম! পাগলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি মরা মুরগীর পায়ের নখ লেগে দুই তিন জায়গায় গাল কেটে গেছে। গাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
তাড়াতাড়ি বললাম, ভাবী, আপনার গাল দিয়ে রক্ত পড়তেছে।
পাগলের বউ ডান হাত দিয়ে গালের রক্ত মুছতে মুছতে বলল, রক্ত পড়লে আর কি করমু রে ভাই, পাগলের অত্যাচার আর সহ্য হয় না। মনডা চায় মইরা যাই। খালি ছোট ছোট দুইডা পোলাপানের মুখের দিকে চায়া মরবার পারি না, বলেই কান্না ভেজা চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে চলে গেল।

লেখকঃ সাহিত্যিক ও রম্য লেখক

আরও পড়ুন