Ads

প্রেমের কবি নজরুল

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ,প্রেমের কবি রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহী কবি নজরুল। তাই বলে কি নজরুলের কবিতায় প্রেমগাথা নেই ? অবশ্যই আছে।

যেহেতু কবিতা আর প্রেম যে অবিচ্ছেদ্দ ভাবনা। তাই কবিমাত্রই কখনো কখনো তার কবিতায় প্রেমের কাঙালপনা প্রকাশ পায়ই।

নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাতিলাভ করলেও তিনি একজন যথার্থ প্রেমের কবিও। তাঁর অসংখ্য কবিতার ছন্দে ছন্দে প্রেমের গৌরব গাঁথা আমরা লক্ষ্য করি। ওইসব কবিতার প্রেমসাগরে আমরা যখনই অবগাহন করি তখনই আত্মস্ত করি তাঁর প্রেমিক কবি হয়ে ওঠার যথার্থতা।

আমার নিজস্ব অনুভূতিতে নজরুলের একাধিক কবিতার প্রেমরসে ডুব দেওয়ার আগে প্রেমিকা নার্গিস বেগমকে লেখা অভিমানে ভরা তাঁর দুটি পত্রের এখানে অবতারণা করি। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ লিখিত ‘কাজী নজরুল ইসলাম–স্মৃতিকথা’য় (পৃষ্ঠা-৭৩) প্রকাশিত একটি পত্রে নজরুল লিখেছিলেন

“আমি কখনো কোন ‘দূত’ প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে, তার ‘সেতু’ কোন লোক তো নয়ই- স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কিনা সন্দেহ। … তোমার উপর আমার কোন অশ্রদ্ধা নেই, কোন অধিকারও নেই আবার বলছি। …তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে – তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্‌ অধিকারে তোমায় বারণ করব- বা আদেশ দিব ? নিষ্ঠুরা নিয়তি সমস্ত অধিকার থেকে আমায় মুক্তি দিয়েছেন।”

এরপর নার্গিসের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় পত্রে তিনি লিখেছিলেন “আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবী-মূর্তির মত আমার হৃদয়-বেদীতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহন করলে না। পাষাণ-বেদীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদি-পীঠ।”
পরবর্তীতে নজরুল নার্গিসের পত্রের জবাব দিয়েছিলেন একটি গান রচনা করে। অভিমানে ভরা সেই গান আজও হিল্লোল তোলে শ্রোতাদের মনে

“যারে হাত দিয়ে মালা দেতে পার নাই/কেন মনে রাখ তারে।/ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।”

যদিও আবেগপূর্ণ এমন আরও অনেক গান লিখে তিনি সঙ্গীত প্রেমীদের হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনটি অলংকৃত করে রয়েছেন। থাকবেনও চিরকাল। তবে নার্গিসকে লেখা নজরুলের আবেগ মথিত পত্র দুটি যে প্রেমের বৈভবকে এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

কবিতা গান বা গানই কবিতা, এমন ভুরি ভুরি নিদর্শন পাই নজরুলের রচনায়। যদিও ‘প্রেমের কবি নজরুল’ আজ আলোচ্য বিষয়। নজরুল ‘পূজারিণী’ কবিতায় তাঁর প্রেমের কাঙালপনা প্রকাশ করে বলেছেন ‘যতদিন বাসিনি তোমারে আমি ভালো/যতদিন দেখিনি তোমার বুক-ঢালা রাগ-রাঙা আলো,/তুমি ততদিন/ যেচেছিলে প্রেম মোর, ততদিন ছিলে ভিখারিনি।/ততদিনই এতটুকু অনাদরে বিদ্রোহের তিক্ত অভিমানে/তব চোখে উছলাতো জল,ব্যথা দিত তব কাঁচা প্রাণে !/একটু আদর-কণা একটুকু সোহাগের লাগি,/ কত নিশি-দিন তুমি, মনে কর, মোর পাশে রহিয়াছ জাগি।’
‘দুরের বন্ধু’ কবিতায় পথিকের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে যে পথ বঁধুকে খুঁজে বেড়ানো, তা বোঝাতেই কবি লিখেছেন ‘তোমার বাঁশির উদাস কাঁদন / শিথিল করে সকল বাঁধন,/কাজ হ’ল তাই পথিক সাধন,/ খুঁজে ফেরা পথ-বধূরে,/ঘুরে ঘুরে দূরে দূরে।’

সমাজ সচেতক নজরুলের সাম্যবাদী ভাবনার ‘নারী’ কবিতায় নারী-পুরুষের সহাবস্থানকে মান্যতা দিয়ে তিনি যেমন লিখেছেন ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণ-কর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ তেমনি নারী কিভাবে বধূ হয়ে তাঁর প্রেমরসে ভিজিয়ে পুরুষের জীবনকে করেছে মধুময় তারও উল্লেখ রয়েছে এই কবিতায় ‘পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ/কামিনী এনেছে যামিনী শান্তি, সমীরণ বারিবাহ।/দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু,/পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে-নারী যোগায়েছে মধু।’
প্রেম-বিরহ যেন একে অপরের নাড়িছেঁড়া টান। প্রেমের গান গাওয়ার পাশাপাশি বিরহ যে কখনো কখনো মূর্ত হয়ে ওঠে মানব জীবনে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কবির ‘সিন্ধু’ কবিতাটি। এই কবিতার প্রথম তরঙ্গের শেষে কবি বলেছেন ‘নিখিল বিরহী কাঁদে, সিন্ধু তব সাথে,/তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে প্রিয়া রাতে।/সেই অশ্রু সেই লোনাজল/তব চক্ষে-হে বিরহী বন্ধু মোর-করে টলমল !/ এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া/তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া !’
‌ ‘গোপন প্রিয়া’ কবিতাটির নামের মধ্যে দিয়েই এক উদ্দাম প্রেমের আভাস পাওয়া যায়। কবিতাটি রোমন্থন করলেই এক দুরন্ত প্রেমের উন্মাদনা অনুভব করা যায়। প্রিয়া দূরে থাকলে প্রেম কত গভীরভাবে তাড়িত করে প্রেমিককে, তা বোঝাতেই কবি লিখেছেন

‘বন্ধু, তুমি হাতের-কাছে সাথের-সাথী নও,/দূরে যত রও এ-হিয়ার তত নিকট হও/থাকবে তুমি ছায়ার সাথে/মায়ার মত চাঁদনী রাতে।’/যত গোপন তত মধুর-নাইবা কথা কও/শয়ন-সাথে রও না তুমি, নয়ন পাতে রও।’। ‘নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা’র মতোই প্রেমের গাঢ়তা বোঝাতে কবি ওই কবিতাতেই লিখেছেন ‘ রাত্রে যখন একলা শোব-চাইবে তোমার বুক,/নিবিড় ঘন হবে তখন একলা থাকার দুখ।’

প্রেম শাশ্বত, সর্বজনীন, বিশ্বচরাচরে বিরাজমান। স্রষ্টার আদি সৃষ্টি কামনাতেও যার অস্তিত্ব। তাই কবি ‘অ-নামিকা’ কবিতায় লিখছেন ‘যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম ভাঙা-রাতে,/রাত্রি জাগা তন্দ্রা লাগা ঘুম পাওয়া প্রাতে,/সকলের সাথে আমি চুমিয়াছিল তমা,/সকলের ঠোঁটে যেন হে নিখিল-প্রিয়া প্রিয়তমা।/তরু,লতা,পশুপাখি সকলের কামনার সাথে/আমার কামনা জাগে আমি রমি বিশ্ব-কামনাতে।’। আবার এই কবিতার একেবার শেষে লিখেছেন ‘প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু,/বহু পাত্রে ঢেলে পি’ব সেই প্রেম-/সে শরাব-লোহু !/তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়,/ভৃঙ্গারে, গেলাসে কভু, কভু পেয়ালায় !’
প্রেমের আগুন মাস ফাগুন। বসন্ত বিলাপের আর এক মাস ফাল্গুন। কবি তাঁর ‘ফাল্গুনী’ কবিতায় প্রেমের গান গেয়ে বলেছেন ‘আজ লাল-পানি পিয়ে দেখি সব-কিছু চুর !/সব আতর বিলায় বায়ু বাতাবি নেবুর!/হ’ল মাদার অশোক ঘা’ল/ রঙন ত নাজেহাল!/লালে-লাল ডালে-ডাল/পলাশ শিমূল !/ সখি তাহাদের মধু ক্ষরে –মোরে বেঁধে হুল্‌ !’
প্রেম শরাবের মতো দুরন্ত এক নেশা। এ-নেশায় বুঁদ হলে প্রেমিকের হৃদয় যে বে-সামাল হয়ে যায়, তার ব্যখ্যা করতে গিয়ে কবি ওই কবিতার সপ্তম স্তবকে বলেছেন ‘সখি মিষ্টি ঝাল মেশা একি বায় !/ এ যে বুক যত জ্বালা করে মুখ তত চায়!/ এ যে শরাবের মত নেশা/ এ পোড়া মলয় মেশা,/ ডাকে তায় কুলনাশা/কালামুখো পিক্‌!/ যেন কাবাব করিতে বেঁধে কলিজাতে শিক্‌ !’
নজরুলের সুনির্বাচিত কবিতা সংকলনের ‘বাসন্তী’ কবিতাটি কবিতা প্রেমীদের মনে হিল্লোল তুলে বুঝিয়ে দেয় ঋতুরাজ বসন্ত কিভাবে প্রেমের জোয়ার এনে দেয় প্রকৃতিতে। বসন্তর ছোঁয়ায় কি অপরুপ সাজে সেজে ওঠে প্রকৃতি, তার নিখুঁত বর্ণনা করেছেন ওই কবিতায়। রাধা-কৃষ্ণের স্বর্গীয় প্রেমের ঋতুও বসন্ত। তাই তিনি লিখেছেন ‘কুহেলীর দোলায় চ’ড়ে/ এল ঐ কে এল রে ?/মকরের কেতন ওড়ে / শিমুলের হিঙুল বনে।/পলাশের গেলাস-দোলা,/কাননের রংমহলা,/ ডালিমের প্রাণ উতলা/লালিমার আলিঙ্গনে।’ কবিতার ৬ষ্ঠ ও ৭ম স্তবকে লিখেছেন ‘তখনি বলেছি ভাই/আমাদের এ মান বৃথাই /এলে শ্যাম আস্‌বেনই রাই/ শ্রীমতী শ্যাম দুলালী।’ ‘এলে শ্যাম বংশীধারী ! গোপনের গোপ ঝিয়ারি/ফুল সব শ্যাম পিয়ারি/ভুলে যায় ছার গৃহ-বাস।’
এই সংকলনের ‘পথের স্মৃতি’ কবিতায় পথ চলতে চলতে কিভাবে অচেনা পথিকের সাথে পরিচয় হয় এবং ঐ পরিচয়ের সূত্র ধরে দুজনের মধ্যে প্রেমের সূচনা হয়। একটা সময় গন্তব্যের কাছাকাছি এসে তাদের মধ্যে যখন ছাড়াছাড়ি হয় তখন শুরু হয় স্মৃতির জাল বোনা। সেই ক্ষণিক প্রেমের অনুভূতি কবি এভাবেই ব্যক্ত করেছেন

‘পথিক ওগো, চলতে পথে/তোমায় আমায় পথের দেখা।/ ওই দেখাতেই দুইটি হিয়ার/জাগল প্রেমের গভীর রেখা।’ কবিতার শেষ স্তবকে কবি বলেছেন ‘হয়ত মোদের শেষ দেখা এই/ এমনি করেই পথের বাঁকেই,/ রইলো স্মৃতি চারটি আঁখেই।’

‘অপরাধ শুধু মনে থাক’ কবিতায় অভিমানী প্রেমিকার উদ্দেশ্যে কবি বলেছেন ‘কত তারা কাঁদে কত গ্রহে চেয়ে/ছুটে দিশেহারা ব্যোমপথ বেয়ে/ তেমনি একাকী চলি গান গেয়ে/ তোমারে দিইনি পিছু ডাক/ অপরাধ শুধু মনে থাক।’
প্রেমিকাকে পাবে না জেনেও শ্রাবণের অশান্ত ধারার মত প্রেমিক ছুটে বেড়ায় এদিক সেদিক। ব্যর্থ প্রেমিকের উদ্দেশ্যে কবি ‘তোমারে পড়িছে মনে’ কবিতায় তার মানসিক অবস্থানটা এভাবেই তুলে ধরেছেন ‘ অকারণে। জানি আমি জানি তোমারে পাব না আমি।/ এই গান এই মালা খানি/ রহিবে তাদেরি কণ্ঠে যাহাদের কভু/ চাহি নাই, কুসুমে কাঁটার মত জড়ায়ে রহিল যারা তবু।’/বহে আজি দিশেহারা শ্রাবণের অশান্ত পবন,/ তারি মত ছুটে ফেরে দিকে দিকে উচাটন মন,/ খুঁজে যায় মোর গীতি-সুর/ কোথা যেন বাতায়নে বসি তুমি বিরহ বিধুর।’
‘প্রেমের কবি নজরুল’ এই গভীর বিষয়ে আলোচনা করতে চাওয়াটা হয়তো আমার ধৃষ্টতা। কারণ বিষয়টিতে প্রকৃত আলোকপাত তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা নজরুলকে অধ্যয়ন করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। ২৯ আগস্ট তাঁর প্রয়াণে দিবসকে সামনে রেখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই সীমিত বোধে দুচারকথা লেখার চেষ্টা করলাম মাত্র। এক্ষেত্রে হয়ত আরও অনেক যথার্থ কবিতা উল্লেখ করা যেতো যা সম্ভব হোল না আমার অপারগতার জন্য।
_____________________________________

‎লেখকঃ সেখ আবদুল মান্নান, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক,পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

আরও পড়ুন