হোসনে আরা মেঘনা
এক গেরস্ত বাড়ির ছাদে ছিল একটা ফুলের বাগান। শীতকাল এলে বাগানটা শীতকালীন ফুলে রমরমা হয়ে উঠে। শীত ফুরিয়ে যখন বসন্ত আসে তখন শীতকালীন ফুলের গাছগুলো ফুল ফুটিয়ে কিছু দিন পর মরে যায়।
মর্নিং গ্লোরি ছিল এমন একটি ফুল যা সারা বছর ফুটে। শেষ রাতে ফুটে সকাল পর্যন্ত তার রং জৌলুশ ছড়ায়। সূর্য্যের রোদ পড়লে আস্তে আস্তে ছোট হয়ে সবগুলো পাঁপড়ি একত্রে মিলে।
গেরস্ত বাড়ির বড় খুকী একদিন শহর থেকে মর্নিং গ্লোরির ফুলের বীজ আনলো। ছাদের এক কর্ণারে ছিল আরসিসি পিলারের রড়। তার এক পাশে ছিল এ্যালমন্ডা গাছ অপর পাশে ছিল একটা গোলাপ গাছ। দুই গাছের মাঝখানে রডের কাছাকাছি স্থানে একটি টব রেখে সেখানে মর্নিং গ্লোরির বীজ বপন করলো বড় খুকী। বাবাকে তার যত্নআত্তির দায়িত্ব দিয়ে খুকী চলে গেলো শহরে। খুকীর বাবা নিয়ম করে প্রতি এক দিন পর পর সকল ফুল গাছে এবং চারায় পানি দিতে লাগলো। মাঝে মাঝে শক্তি বৃদ্ধির জন্য সার এবং কীটনাশকও প্রয়োগ করে।
কয়েকদিন পর মর্নিং গ্লোরির চারা ফুটলো। খবর শুনে খুকী সেকি খুশী ! আস্তে আস্তে গাছটি বেড়ে উঠছে। কিন্তু ওতো লতানো গাছ, ওর উপরে উঠার একটা অবলম্বন চাই। গোলাপের দিকে ঝুঁকে আসে তাকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু গোলাপ তাতে সায় দেয় না। গোলাপ ভাবে তাতে যদি তার বর্ধন ব্যহত হয়, যদি ফুল ফোটাতে না পারে ! তাই গোলাপ প্রত্যাখ্যান করে মর্নিং গ্লোরিকে।
মর্নিং গ্লোরি অনুতাপে, দুঃখে মাথা নুয়ে থাকে। সে ভাবলো এ্যালমন্ডাতো বর্ষার ফুল। বর্ষা আসতে এখনও অনেকটা সময় বাঁকি। সে হয়তো তাকে ভালবেসে বুকে টেনে নেবে। তাই কয়েকদিন পর আবার সে আলিঙ্গন করলো এ্যালমন্ডাকে। দেখলো এ তো আরও অহংকারী। গৌরবে সে তাচ্ছিল্যভরে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। বেচারি ছোট্ট মর্নিং গ্লোরি কষ্টে কেঁদেই ফেললো। সূর্য্যের দিকে মুখ করে নতজানু হয়ে টবের নীচে গড়াতে লাগলো। সূর্য্যকে বলতে লাগলো,
” একদিন আমিও বড় হবো, শেষ রাতে ফুল ফুটিয়ে তোমাকে সুন্দর, উজ্জ্বল, ঝলমলে একটা সকাল উপহার দেবো। সেদিন দেখো ওরাও আমাকে ভালবাসবে, কাছে নিতে চাইবে।”
এদিকে খুকীর বাবা মর্নিং গ্লোরির কান্ড দেখে হতবাক। একবার উত্তর দিকে, একবার দক্ষিণ দিকে আবার পূর্বে সূর্য্যের দিকে মাথা দোলায় ছোট্ট মর্নিং গ্লোরি। এইটা দেখে তার গিন্নীর সাথে গল্প করে আর হাসে। গিন্নী বলে,
” গোলাপ আর এ্যালমন্ডাকে মাথা দোলায়ে ভালবাসা জানাচ্ছে হয়তো। কিন্তু ওরা কেউ ওকে গ্রহন করছে না। তাই মন খারাপ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে বেচারি ।”
অবশেষে মর্নিং গ্লোরি আরসিসি রডের সাথে সখ্যতা করে, তাকেই আঁকড়ে ধরে উপরে উঠতে থাকে। রড তাতে কোনো বাধা দেয় না। কিছুদিন পর মর্নিং গ্লোরিতে কলি আসলো। সেদিন খুকী, ওর বাবা, মা সবাই এক সাথে ছাদে গিয়ে খুব আনন্দ করলো। এটা দেখে মর্নিং গ্লোরিও খুব খুশী হলো। তিন-চার দিনের মধ্যে অনেক কলি এলো কেউ আবার ফুটতে আরম্ভ করলো। এভাবে সারা গাছময় ফুলে ফুলে শোভিত হলো। রাতে ফুটে সকাল পর্যন্ত তার রূপের ঝলকানি ছড়ায়। এই শোভা দেখার জন্য খুকীর পরিবারের সবাই ফযরের নামাজ পড়েই ছাদে যায় প্রস্ফুটিত মর্নিং গ্লোরিকে দেখতে।
গোলাপ, এ্যালমন্ডা এবার নিজেদের ভুল বুঝতে পারলো। ওরা ছোট্ট মর্নিং গ্লোরিকে তাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু তাতে কি লাভ হলো ? মর্নিং গ্লোরি তো ঠিকই তার স্বপ্নময় সকালটা দেখতে পেলো। তারা শপথ করলো, ছোট বলে আর কাউকে কোনও দিন হেলা করবে না।
লেখকঃ সাহিত্যিক ও শিক্ষক