Ads

মহীয়সীর কলাম

ডিএনএ

    –মনসুর আলম
প্রবাসী অধ্যুষিত একটি এলাকায় জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি। গ্রামের প্রতিটি ঘরে কেউ না কেউ প্রবাসী বিশেষকরে মধ্যপ্রাচ্যে। ছোটবেলায় গ্রামের যে কেউ ছুটিতে দেশে আসলে আমরা দলবেঁধে দেখতে যেতাম। প্রধান আকর্ষণ ছিলো রঙ বেরঙের চকোলেট, ক্যান্ডি। ক্যান্ডির সুন্দর, চকচকে মোড়কও আমাদের কাজে লাগতো, কী কাজে লাগতো সেটি পরে বলছি। দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিলো বিদেশের গল্প শোনা। বিভিন্ন দেশের সামাজিক রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস, রাস্তাঘাটের অবস্থা জানার বিপুল আগ্রহ ছিলো আমার। কেউ যখন বিদেশের গল্প বলতেন তন্ময় হয়ে শুনতাম। এত দ্রুত গতির যানবাহনের কথা শুনে চোখ কপালে উঠে যেতো। আবার কষ্টও পেতাম মধ্যপ্রাচ্যের ধনী শেখদের দুর্ব্যবহারের কথা শুনে।
দোকান খোলা রেখে চলে যায়, কোনো মানুষ নেই; কাস্টমার পণ্য কিনে নিজেই টাকা রেখে চলে যায়- অবিশ্বাস্য লাগলেও স্বপ্নপুরীর এমন গল্প চুম্বকের মতো আমাকে টানতো। আসর ছেড়ে উঠে আসার শক্তি পেতাম না। হাঁটু গেড়ে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা।
সবচেয়ে অবাক হলাম সেদিন, যেদিন শুনলাম পুলিশ যদি কোনো কারণে কাউকে গ্রেফতার করে তাহলে হাতকড়া লাগায় না, কোথাও বন্দী করেনা। মাটিতে একটি বৃত্ত কিংবা বর্গ এঁকে আসামীকে বসিয়ে রেখে চলে যায়। অন্যান্য কাজ শেষ করে এসে আসামী নিয়ে যায় কিংবা ছেড়ে দেয়। আমরা বাঙালিরা ভাবতে লাগলাম ওরা কত বোকা! আসামী ধরে দাগ দিয়ে চলে যায়! এরকম বোকামী কেউ করে? আমরা আইনের শাসন পদদলিত করে পালিয়ে যাওয়া শুরু করলাম। ওখানকার পুলিশ দেখলো এরা তো বেঈমান, এরা পলায়নকারী। ওদের বিশ্বাস ভঙ্গ হলো আমাদের জন্য যেমন কুকুর তেমন মুগুরের আয়োজন করলো। এখন আর বসিয়ে রেখে যায়না, হাতকড়া পরিয়ে গাড়ির সিটির সাথে নয়তো রাস্তায় লোহার রেইলিং এর সাথে বেঁধে রেখে যায়। আমরা ওদেরকে শেখালাম কীভাবে আমাদেরকে ট্রিট করতে হবে?
ফজরের নামাজের সময় উঠে আমরা দলবেঁধে আরবী পড়তে যেতাম। পাড়ার সকল ছেলেমেয়ে একসাথে বসে কোনো হুজুরের কাছে আরবী শিখতাম। যারা নীচের দিকের পড়া শেষ করে কোরআন পড়া শুরু করতাম আমরা তখন মোটামুটি সিনিয়র। ধারাবাহিকভাবে একটার পর আরেকটা সূরা পড়ি, হুজুরের কাছে পড়া দেই এটি আমাদের নিয়মিত রুটিন। কোরআনের যে আয়াতে আজকের পড়া শেষ করলাম সেই আয়াতে চিহ্ন রাখার জন্য আমরা ব্যবহার করতাম সেই মধ্যপ্রাচ্যের চকোলেটের মোড়ক। বিশেষ কায়দায় কয়েকটি ভাঁজ দিয়ে ত্রিভুজাকৃতির একটি অবয়ব তৈরী করতাম যাকে আমরা খপ্তর বলে ডাকতাম। কেউ কেউ ব্যবহার করতাম ময়ূরের পালক কিংবা রেশমী সুতা। যত তাড়াতাড়ি পুরো কোরআন মাজীদ পড়া শেষ হবে তত তাড়াতাড়ি মক্তবে যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারবো। আমরা সেই ছোটবেলায়ই অভিনব কায়দা উদ্ভাবন করে আমাদের সৃজনশীলতার পরিচয় রাখলাম। এত বেশী ছাত্রছাত্রী একসাথে; কে, কোন সূরা পড়ছে হুজুরের পক্ষে ঠিকমতো মনে রাখা প্রায় অসম্ভব। আমরা, আমাদের সৃজনশীল চরিত্র থেকে পবিত্র কোরআনকেও ছাড়িনি। হুজুর যেহেতু মনে রাখতে পারেন না আমরা সেখানে ফাঁকি দেয়া শুরু করলাম। দশ/ পনেরো আয়াত ছেড়ে ছেড়ে পড়া শুরু করলাম যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। যদিও আমরা ছোট ছিলাম, বয়স কম, বুঝিনি কিন্তু, কীভাবে চুরি করতে হয় সেটি ঠিকই বুঝেছি। কম বয়সের দোহাই দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনো ইচ্ছা নেই। এই জঘন্য জোচ্চুরি আমরা করেছি। ভাবা যায়? পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নিয়ে জোচ্চুরি করার দুঃসাহস আমাদের ছিলো সেই কিশোর বয়সে!
চোরের ত্রিশ দিন …। হুজুর একসময় ঠিকই বুঝতে পারলেন আমাদের চালাকি। আমরা বিশ্বস্ততা হারালাম সাথে স্বাধীনতাও। হুজুর এখন পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়ে রাখেন, সবাইকে একসাথে যেতে হবে, আগেপিছে নেই। যখনই শেষ হয় সবার একসাথে শেষ হবে। আমাদের সৃজনশীলতা মুখ তুবড়ে পরলো সত্যের কাছে।
ইউরোপ, আমেরিকা যেসব দেশে পারিবারিক ভিসা চালু ছিলো, এখনো আছে সেসব দেশে প্রায় সবাই পরিবার নিয়ে যেতেন বিশেষকরে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। আবেদন করলেই স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সবার ভিসা হয়ে যায়। দলবেঁধে উড়াল দেই। আমরা আবারও আবির্ভূত হলাম আরো জটিল পদ্ধতি নিয়ে। নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে ভাই/বোনের বাচ্চাদেরকে যোগ করে নিজের সন্তান পরিচয় দিয়ে শুরু করলাম মানব পাচার, নির্দিষ্ট করে বললে শিশু পাচার। কেউ কেউ আবার আত্মীয় ছাড়াও টাকার বিনিময়ে বাচ্চা পাচার শুরু করলেন। ওখানে নিয়ে সেই বাচ্চার কোনো আত্মীয়ের কাছে দিয়ে দিতেন। একসময় ওরা ঠিকই বুঝতে পারলো আমাদের প্রতিভা। এখন আর বার্থ সার্টিফিকেট কিংবা নিজের বাচ্চা বলে দাবি করলেই ওরা মেনে নেয়না। ওরা ডিএনএ টেস্টে পাঠায়। ডিএনএ টেস্ট করে সন্তান প্রমাণিত হলেই ভিসা দেয়, নতুবা আবেদন বাতিল। যদিও ডিএনএ টেস্টও সবসময় শতভাগ সমাধান দিতে পারেনা। কখনো কখনো প্রকৃত আবেদনও বিলম্বিত হয়, হয়রানির শিকার হতে হয়। এই অবস্থার জন্য আমাদের অতি উদ্ভাবনী মস্তিষ্ক দায়ী। পারিবারিক অশান্তি এবং ভুল বুঝাবুঝির সীমাহীন দুর্গতির কথা বলা বাহুল্য।
আজ একটি মর্মান্তিক ঘটনা জানতে পেরে এই লেখার সূত্রপাত। এরকম ঘটনা আরো কয়েকটি দেখেছি। কোনো এক প্রবাসী তার স্ত্রীকে বিদেশে নিয়ে যেতে দেরী করেছেন তবে নিয়মিত দেশে যাওয়া আসা করতেন। তাদের একটি সন্তানও হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে যাবার আবেদন করেছেন, যেহেতু তিনি সেই দেশের নাগরিক সেহেতু তার সন্তানও পৈতৃক সূত্রে সেদেশের নাগরিক। সবকিছু ঠিক থাকলেও বাঁধ সেধেছে সেই ডিএনএ টেস্ট। পিতার সাথে সন্তানের ডিএনএ ম্যাচ করেনা। আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিবেশি দেশ ভারতের দুটি আলাদা ল্যাব থেকে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে আনা হলেও ফলাফল একই। পিতার সাথে সন্তানের ডিএনএ ম্যাচ করেনা। আবেদন বাতিল উল্টো প্রতারণার মামলা খাবার ভয় আছে।
এই সন্তান তাহলে কার? ওনার স্ত্রী কি তাহলে ওনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন? নাকি বিজ্ঞান কোথাও ভুল করছে?
এই পাজলের একমাত্র সঠিক উত্তর জানেন তার স্ত্রী। তিনি কি দোষী? যদি নির্দোষ হয়েও থাকেন আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে তার অবস্থান কোথায়? তাকে কে বিশ্বাস করবে? কী অসহনীয় পারিবারিক গোলযোগ তৈরি হয়েছে ভাবতে পারেন? স্বামী বেচারা এতটাই বিধ্বস্ত হয়েছেন যে যেকোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। কেউ কেউ সেই স্ত্রীকে চরিত্রহীন বলে গালি দিচ্ছেন- হতে পারে তিনি প্রতারণা করেছেন, আবার নাও হতে পারে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপাদমস্তক অসৎ একটি সমাজে তিনি কি বিচ্ছিন্ন কেউ?
মনসুর
সাউথ আফ্রিকা।
মনসুর আলম, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী সাহিত্যিক ও এডমিন, মহীয়সী
আরও পড়ুন