Ads

ইসলামী ব্যাংকিং : তিন দশকে যেভাবে বুঝেছি (পর্ব-২)

।। নূরুল ইসলাম খলিফা ।।
অর্থনীতি (২য় পর্ব )
চিন্তা , কর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে অর্থনীতিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয়। বর্তমানে প্রচলিত অর্থনীতিকে সাধারণত: তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন পুঁজিবাদী অর্থনীতি বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি যেখানে ব্যক্তিকে সম্পদের নিরংকুশ মালিকানা দেয় এবং ব্যক্তি তার মেধা , যোগ্যতা ও শ্রম মুলধন বিনিয়োগ করে তার উপার্জিত সম্পদ ইচ্ছা মাফিক ভোগ ব্যবহার করতে পারে। এখানে রাষ্ট্র ও সমাজ কোনো হস্তক্ষেপ করে না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় রেনেসাঁ আন্দোলনের সাথে এ্যাডামস্মীথের লেইজে ফেয়ার অর্থাৎ অবাধ ব্যক্তি মালিকানার ধারণা সম্বলিত পুঁজিবাদী এই অর্থ ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করে। রেনেসাঁ আন্দোলনের পথিকৃত হবস , লক ,রুশো , ভল্টেয়ার প্রমুখ যেমন খ্রিষ্টিয় চার্চের গোঁড়ামীর মোকাবেলায় ধর্মকে জীবন থেকে নির্বাসিত করার আন্দোলনে ঘি ঢেলেছেন এবং মানুষের যে একটি নৈতিক স্বত্তা আছে সেটি অস্বীকার করেছিলেন , ঠিক তেমনি ক্লাসিকাল অর্থনীতিবিদ মার্শাল , এ্যাডামস্মীথ প্রমুখ অর্থনীতিতে নৈতিক মূল্যবোধের ধারনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের বক্তব্য ছিল মানুষকে তার স্বার্থেই অবাধ মালিকানা ও কাজের সুযোগ দিলে মানুষের কর্মতৎপরতা বাড়বে এবং ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার মাধ্যমেই সামষ্টিক বা সমাজের স্বার্থ অর্জিত হবে। এটা ঠিক যে পুঁজিবাদ তার প্রাথমিক ধারনায় নেই এখন , কেননা ব্যক্তি স্বার্থ যে সামষ্টিক স্বার্থ রক্ষা করে না , সেটি প্রমান হয়ে গেছে। ফলে এর অনেক সংশোধনী এসেছে এবং এটাই এখন মিশ্র অর্থনীতিতে রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তি মালিকানা থাকবে কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থের জন্য রাষ্ট্রও প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারবে।

 

নিরংকুশ ব্যক্তি মালিকানা তথা নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিবাদের ফলে সম্পদের এক কেন্দ্রিকতা তথা আয় ও সম্পদের চরম বৈষম্যের প্রতিক্রিয়ায় আর একটি চরমপন্থা এলো সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নামে। মার্কস , এ্যাংগেল এর মস্তিস্ক প্রসুত এ অর্থনৈতিক মতবাদে ব্যক্তির মালিকানাকে পুরোটাই অস্বীকার করা হলো। ব্যক্তিকে অনেকটা খোঁয়ারের প্রাণীর মত মনে করা হলো যে , সে শুধু কাজ করবে , উৎপাদনের মেশিন হবে এবং সব সম্পদ জমা হবে রাষ্ট্রের কাছে। ব্যক্তিকে প্রয়োজন মাফিক বরাদ্দ দেয়া হবে কিন্তু সম্পদের মালিকানা থাকবে রাষ্ট্র বা সমাজের কাছে। আসলে এই ধরনের চিন্তা যা পুরোটাই কল্পনা বা ভাবাবেগপ্রসুত যা বাস্তবে একদিনের জন্যও প্রতিষ্ঠিত হয়নি । তবে এই চিন্তার আলোকে লেনিন- মাওজে দং( মাওসে তুং) এর নেতৃত্বে রাশিয়া , চীন ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে যে বিকৃত সমাজ তান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল তাও যে বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না তা ইতোমধ্যেই সমাজতন্ত্রের আত্মহত্যা থেকে মানব জাতি বুঝতে পেরেছে।আসলে মানুষের প্রকৃতি বিরোধী কোনো মতবাদই বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না ইতিহাস সে কথাই বলে । আমরা কৈশোরে একটা শ্লোগান শুনতাম বেশ লোভনীয় ‘লাঙল যার জমি তার’। বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীরা এই শ্লোগান দিতেন এবং কৃষকদেরকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করতেন। শুনতে হঠাৎ করে মন্দ লাগতো না। ঠিকই তো লাঙল হাতে যারা জমিতে ফসল ফলায় , তারাই যদি জমির মালিক হয়ে যেত কত ভাল হতো ! আসলে লাঙল , জমি এবং ফসল কোনোটার উপরই কৃষকের কোনো অধিকার নেই এই মতবাদে।সর্বহারাদের সেই কথিত স্বর্গে কী ভাবে গুটিকয়েক মানুষ মানুষের প্রভু হয়ে লাগামহীন ভোগ ও বিলাসে মত্ত থেকে বাকি সমস্ত মানুষকে সর্বহারা করে ফেলতে পারে তা সেখানের গণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে । যা হোক মৃত এই মতবাদ নিয়ে তেমন আলাপ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

 

মিশ্র অর্থনীতির আওতায় কল্যাণ রাষ্ট্র , উন্নয়ন অর্থনীতি ইত্যাদি ধারনাগুলোর উদ্ভব হয়েছে এবং চেষ্টা হয়েছে মানুষের কল্যাণে কিভাবে অর্থনীতিকে প্রবাহিত করা যায়। কিন্তু আজকের পৃথিবী সাক্ষ্য দিচ্ছে যে , এটি কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। সম্পদের যে পাহাড় পরিমাণ বৈষম্য আজকের দুনিয়ায় আমরা দেখছি যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় মারাত্মক আকার ধারন করেছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে যে সম্পদের নিরানব্বই শতাংশই মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে কেন্দ্রিভুত হয়ে গেছে এবং গোটা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রন গুটি কয়েক মানুষের হাতে চলে গেছে। ফলে সীমাহীন অপচয়-অপব্যয়ের নজীর যেমন আমরা দেখছি , বাজার মূল্য পড়ে যাওয়ার ভয়ে উৎপাদিত ফসল পুড়িয়ে দেয়া বা সাগরে নিক্ষেপের ঘটনা দেখছি একই সাথে বুভুক্ষ মানুষের মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত হতে দেখছি। আফ্রিকার কংকালসার মানুষের ছবি দেখছি, একই সাথে ত্রান সহায়তা নিয়ে ধনিক শ্রেণীর হাঁক ডাকও শুনছি। সবটাই মানবতার সাথে এক নিদারুন পরিহাস মনে হচ্ছে।

 

পুঁজিবাদী-ধনতান্ত্রিক কিংবা বাজার অর্থনীতি , মিশ্র বা কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা অথবা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সবার কিন্তু শ্লোগান একটাই আর সেটা হচ্ছে মানব কল্যাণ। সবাই মানুষের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু তারা কি তা দিতে পেরেছে ? শুধু বস্তুগত সম্পদ দ্বারাই মানুষের কল্যাণ সম্পন্ন হয় না ; মানুষ শুধু পেট নিয়েই জন্মায় না , তার একটি মন আছে, একটি আত্মা আছে। পরিপূর্ণ কল্যাণের জন্য পেটের তথা দেহের প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি মনের প্রয়োজন পূরণ করাও দরকার। কিন্তু উপরে বর্ণিত অর্থনৈতিক মতবাদগুলো শুধু দেহের প্রয়োজনের কথাই বলেছে এবং সেটা পূরণের রাস্তা খুঁজেছে। তারপরও তারা কিন্তু সেটুকুন করতেও নিদারুনভাবে ব্যর্থ হয়েছে। উন্নত বিশ্ব বলুন , উন্নয়নশীল বিশ্ব বলুন অথবা তৃতীয় বিশ্ব যে নামেই পৃথিবীকে বিভক্ত করা হোক না কেন , কোথাও সকল মানুষের এই বস্তুগত প্রয়োজনটুকুও এ যাবত কেউ পুরন করতে পারে নি। নিরন্ন , গৃহহীন, বুভুক্ষ , চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের লম্বা সারি নেই এমন কোনো ভূখন্ড খুঁজে পাওয়া যাবে না একুশ শতকের এই আলো ঝলমল পৃথিবীতে। সম্পদ বন্টনের স্বার্থবাদী ব্যবস্থার কবলে পড়ে একদিকে যেমন কিছু মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমেছে , অপর দিকে নিরন্ন মানুষের দীর্ঘ সারি আজকের দুনিয়ার বাস্তব চিত্র যেমনটি উপরে বলেছি। সুতরাং এই মতবাদের প্রবক্তারা স্বীকার করুক আর নাই করুক , বস্তুতান্ত্রিক কল্যাণ করতেও যে তারা ব্যর্থ হয়েছে এ সত্য লুকোবার কোনো সুযোগ নেই।

 

উল্লেখিত অর্থনৈতিক মতবাদগুলোর বিপরীতে ইসলামের একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে । ইসলাম একটি বিশ্বজনীন ও পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যা এ বিশ্বের স্রষ্টা তাঁর মনোনীত নবী রাসূলদের মাধ্যমে মানব তথা সমগ্র সৃষ্টি জগতের কল্যাণের জন্য দান করেছেন। মানুষের জীবনের পরিধি যতটা বিস্তৃত , ইসলামের ব্যাপকতাও ততটাই। আর্থিক কর্মকান্ড যেহেতু মানব জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সিংহভাগ তৎপরতা এই অর্থনৈতিক কর্ম ঘিরেই আবর্তিত হয় ; তাই এখানেও ইসলামের রয়েছে একটি সুস্পষ্ট ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা। সুতরাং আমরা সংক্ষেপে এভাবে বলতে পারি যে ,জ্ঞানের যে শাখাটি ইসলামের বিধিবিধান অনুসারে মূল্যবান সম্পদের উৎপাদন , বরাদ্দ , বন্টন ও ভোগ-ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সেটাকে বলা হয় ইসলামী অর্থনীতি। ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন অনেক প্রথিতযশা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ। এদের মধ্যে রয়েছেন ড. এম উমর চাপরা , প্রফেসর খুরশীদ আহমদ , ড.নেজাত উল্লাহ সিদ্দিকী , প্রফেসর ড. এম এ মান্নান , এস এম হাসানুজ্জামান প্রমুখ। আমার মূল আলোচ্য বিষয় যেহেতু ইসলামী ব্যাংকিং ,তাই আমি এসমস্ত সংজ্ঞা এখানে উদ্ধৃত করে কলেবর বৃদ্ধি করছি না। আগ্রহী পাঠক এ সমস্ত স্কলারদের লেখা বইগুলোর উপর চোখ বুলাতে পারেন। ভাষা ও শব্দের কিছু পার্থক্য বাদ দিলে এ সমস্ত সংজ্ঞার মূল সুরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ সমস্ত সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট সম্পর্কে নিম্নরূপ ধারণা পাওয়া যায় :

 

১) ইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশনা তথা ইসলামী শরীয়ার পূর্ণ অনুসরণ।
২) উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে ইনসাফ বা ন্যায়পরায়নতা নিশ্চিত করা ।৩) ব্যক্তির স্বাধীনতার অহেতুক হস্তক্ষেপ না করা।
৪) ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থের সমন্বয় করা।
৫) পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখা।
৬) মানব কল্যাণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া।
ইসলামী ব্যাংকের সবগুলো সংজ্ঞাই এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছে যে , এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার সহায়ক ভূমিকা পালন করবে । সুতরাং একজন ইসলামী ব্যাংকারকে সব সময়ই সতর্ক থাকতে হবে যে , তিনি ব্যাংকিং কর্মকান্ড দ্বারা ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার উল্লিখিত বৈশিষ্টগুলো বাস্তবায়ন করছেন কিনা । এটি নিশ্চিত করা না গেলে , সেটি সুদবিহীন ব্যাংকিং হলেও হতে পারে , কিন্তু ইসলামী ব্যাংকিং হবে না ।
এর পরে আমরা ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার বিশ্বদর্শনের উপর সংক্ষিপ্ত একটি ধারণা দিয়ে আমাদের মূল আলোচনা ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে ফিরে যাব।
( চলবে )

 

 

লেখকঃ সাবেক ডেপুটি ম‍্যানেজিং ডিরেক্টর , ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড 

আরও পড়ুন