Ads

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক 

(ভ্রমণ কাহিনী, পর্ব-১১)

 – নুরে আলম মুকতা
তোমরা হজ্বে এলে আমার সাথে দেখা কোরো আর মদিনায় কিছু সামান কিনে নিও,মনে রেখ মদিনার কোন বস্তুকে খারাপ মন্তব্য কোরো না। “
পরদিন সকাল সকাল আমি আর আপা হাম্মাদ ভাইয়ের দোকানে গেলাম। মিশফালাহ ওভার ব্রীজের পাশে,আলমানসী  ফাইভস্টার হোটেলের ঠিক উল্টোদিকের গলিতে রাস্তার  ধারে দোকান। ভাই, ছেলেমেয়ে নিয়ে দোকান চালায়। সুন্দর  ফুটফুটে তিনটি ছেলেমেয়ে।  বাড়িতে একটি কোলে আর একটি পেটে। অনেকগুলো সন্তানের জন্য ও বেজায় খুশি। ওর জনবল দরকার। ওরা নিজেদের মধ্যে পশতু বলছে।
আমাদের সাথে অনর্গল হিন্দি – উর্দুর মিশেলে বলছে।
আপা ওর স্ত্রীর ছবি দেখতে চাইলে পকেটে রাখা ফোনটি আপার দিকে মেলে ধরলো হাম্মাদ। আমি দেখতে চাইলে হেসে বলল, জোয়ান হাজী পরের  জেনানা দেখবে? আমি বললাম,মানুষ দেখবো , জেনানা দেখবো না। তুমি বলো, ও কাবুলি  কিনা। বলল হাঁ,খাঁটি অাফগান।
আমার চোখ ছানাবড়া। ওর বয়স তো খুবই কম। এতগুলো ছেলেমেয়ে!
ততক্ষনে আমাদের বেশ কিছু জায়নামাজ, টুপি,হিজাব আর রুমাল পছন্দ হয়ে গিয়েছে। দামও কম। বহন করে নিয়ে আসাটা সমস্যা। আমাদের দেশে দাম অনেক বেশি আর মান প্রশ্নবিদ্ধ। জায়নামাজ গুলোর মূল্য আট রিয়াল থেকে পনেরো  রিয়ালের মধ্যে উঁচু মানের। এর চেয়েও বেশি দামী নিতে পারেন। কম্বল আর সিনথেটিক প্রায় সব পন্যই টার্কিশ। চায়নীজ গুলো আমার কাছে ভালো মনে হয়নি। এখানে রুচির তারতম্য হতে পারে। অন্য দোকানে আমাকে যেতে হয়েছে কিন্তু মক্কায় হাম্মাদের দোকানে পুরো কাফেলার বাজারের জন্য বার বার যেতে হয়েছে। ওর ন্যয্য মুল্য আর আতিথেয়তা ভোলার নয়। পরে আমার ছোট বোন ওর দোকান খুঁজে পেয়েছিল।
হাম্মাদ আমাকে ভোলেনি।
মক্কা ত্যাগ করার কদিন পূর্ব  থেকে ওর দোকান যাওয়া হয়নি। ওরা তো জানে একসময় আমরা চলে যাব। হেলাল ভাই মারফত ও আমাকে ওর দোকানে ডেকে পাঠিয়েছিলো।
দেখ,চলে তো যাবেই, সবাই চলে যায়! তোমরা বাংলাদেশের মানুষ এত প্রেমময় আর ভালোবাসতে পারো?
হঠাৎ হাত ওপরে করে বললো, “হে আল্লাহ আমার ভাইকে ভালো রেখ,ও যেন আবার তোমার কাছে ফিরে আসে,আমার সাথে দেখা নাও যদি হয়।”
আমি রেগে বললাম,তুমি ঐ প্রার্থনা কেন করলে? আমি
আসবো, তুমি থাকবেনা?  দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাম্মাদের জবাব,
কাবুলে আমার মা-বাবা আছে, বহুদিন ওদের দেখিনি,যেকোন সময় আমি যেতে পারি। আমাকে একটি চমৎকার কাঁধ ব্যাগের মধ্যে কিছু তসবীহ আর একটি টুপি দিয়ে বলল,মনে রেখ।
হাম্মাদের চোখে অশ্রু, সুন্দর আর রক্তিম মুখাবয়ব বিষন্ন !
মক্কার সময় ফুরিয়ে যাবার আগে পশু বাজারে যেতে হবে। হেলাল ভাই এ বিষয়ে অভিজ্ঞ। দেশী ভাইয়ের কাছ থেকে গরু কিনে ও একবার পশুটিই হারিয়েছে। সকাল নয়টার সময় আমাদের নিকটের পশুর বাজার টার্গেট  করে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। দুপাশে পাহাড়। প্রচন্ড তাপে আর পারলাম না। রাস্তার ধারে এক খেজুর বাগানে আশ্রয়  নিলাম। আনুমানিক আরো আট কিলোমিটার যেতে হবে। সাথে থাকা পানিও ফুরিয়ে গেল।
টুটুল আর হাঁটবে না। ও প্রাইমারীর প্রধান শিক্ষক,আমার বন্ধু। শরীরের রং আমার চেয়েও কালো, দীর্ঘকায়।
আফ্রিকান রা তো পারে,তুই পারবি না,আমি সাহস দিলাম। ও কিছুতেই রাজী হচ্ছে না।
মক্কার সময় ফুরিয়ে যাবার আগে পশু বাজারে যেতে হবে। হেলাল ভাই এ বিষয়ে অভিজ্ঞ। দেশী ভাইয়ের কাছ থেকে গরু কিনে ও একবার পশুটিই হারিয়েছে। সকাল নয়টার সময় আমাদের নিকটের পশুর বাজার টার্গেট  করে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। দুপাশে পাহাড়। প্রচন্ড তাপে আর পারলাম না। রাস্তার ধারে এক খেজুর বাগানে আশ্রয়  নিলাম। আনুমানিক আরো আট কিলোমিটার যেতে হবে। সাথে থাকা পানিও ফুরিয়ে গেল।
টুটুল আর হাঁটবে না। ও প্রাইমারীর প্রধান শিক্ষক,আমার বন্ধু। শরীরের রং আমার চেয়েও কালো, দীর্ঘকায়।
আফ্রিকান রা তো পারে,তুই পারবি না,আমি সাহস দিলাম। ও কিছুতেই রাজী হচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত টুটুলের জন্য একটি গাড়ি নিতে হলো। মাত্র দশ মিনিট রাইডে পনের রিয়াল গচ্চা দিলাম। হাঁটলে কষ্ট  পেতাম,চল্লিশ মিনিট লাগতো।
মরুদ্যানের মধ্যে পশুর বাজার। চারিদিক ধূ ধূ করছে। বেশ কয়েকটি পথ রাজ্যের বিভিন্ন দিক চলে গিয়েছে। পশুর বাজার গুলো শহরের একদম বাইরে। বিশাল পশুর সমাহার। কোরবানি শুরু হয়নি এজন্য  লোক সমাগম কম।
ব্যবসায়ীরা সব পরিস্কার  করে পশু জমা করছে। কেনা-বেচা  শুরু হয়নি। আমাদের মতো দর্শনার্থী দেখলাম। কোরবানীর সময় মিনা তে অনেক ভীড় হয়। ওখানে বারগেইনিং প্রায় চলেনা চলেনা। তখন সারাবিশ্বের হজ্ব যাত্রী একত্রে থাকার জন্য অনেক পেরেশানিতে পড়তে হয়। শরীরে শক্তিও পাওয়া যায় না। হজ্বের মুল পর্ব সারার পর শরীর বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এ তথ্যটি সব হজ্ব যাত্রীদের মনে রাখতে হবে।  আমরাতো তখন মিনাতে থাকবো।
পাকা বেস্টনীর মধ্যে সব পশু জমা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রজাতির দুম্বা,মেষ আর ছাগলের সমাহার।  উট নেই। সৌদি রাজ উট কোরবানী নিষিদ্ধ করেছে। গরু ও নেই। আমদানী বন্দ। তাই আমাদের দুম্বা আর ছাগলের ওপরই নির্ভর করতে হবে। মূল্য আমাদের কাছে দেশের মতোই মনে হল এজন্য আমরা খুশি। কিন্তু আমাদের বাড়ির কেয়ার টেকার দেশী মালেক, হেলাল ভাইয়ের সাথে ভিন্ন চুক্তি চাইছে।
ও বলছে,আমি ওদের চেয়ে বিশ রিয়াল কম রাখবো। আর তোমরা ইচ্ছে মতো নিজের হাতে জবাই কোরো। আমি ঈদের রাতে বাড়ির চার তলায় পশু জমা করে রাখবো। সমস্ত  প্রক্রিয়া হবে সৌদি পুলিশ কে ফাঁকি দিয়ে।
মালেকের যুক্তি হলো,তোমরা বাজারে করলে সরকারি স্লটারিং এ করতে হবে আর বেশির ভাগ পশুর বডি তোমরাতো নিবে না। এখানে করলে আমরা আমাদের  দেশী প্রবাসীরা ভাগ করে নেব। কিছু তোমাদের বাবুর্চিখানায় দিয়ে আসবো।
আমি চারতলার ছাদে প্রায় উঠতাম রাতের পাহাড়ের শীর্ষ  উপভোগ করার জন্য। এক কোনায় দেখেছি পশু রাখার জায়গা। কাপড় শুকানোর জন্যে তো উঠতেই হতো।
কোরবানী দেয়ার আরেকটি ব্যবস্থা হলো সৌদি রাজের ব্যাংক আল রাজী অথবা সৌদি সরকারি পোষ্ট অফিস সৌদি  পোষ্টে নির্দিষ্ট টাকা জমা দেয়া। এক্ষেত্রে টেনশন মুক্ত, পেরেশানি মুক্ত। সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হবে সৌদি রাজের সরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর। নিজে কিছু দেখা যাবেনা,ছোয়াও যাবেনা।
আজ বায়তুল্লায় সৌদী রাজের নারী পুলিশ বাহিনী চোখে পড়লো গভীর রাতে।
হেরেমের ভেতরে আর বাইরে অসংখ্য মহিলা পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। সহজে চেনা যায়। ওরা সাধারনত মহিলাদের  সার্বিক নিরাপদ চলাফেরার নিশ্চয়তা বিধান করে। আপাদমস্তক কালো বোরখা আবৃত,হাতে কালো গ্লাভস। মাঝে মাঝে ওয়াকিটকি কোমরে আটকানো। দলবেঁধে থাকে ওরা। সমস্যা হলে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে। পদ্ধতিটি দারুন কৌশলী আর কার্যকর মনে হয়েছে আমার কাছে। নিয়ন্ত্রনের বাইরে গেলে মূহুর্তেই পুরুষ পুলিশ কে কল করবে।
ওরা স্পটে সবাই নিরস্ত্র।
(চলমান)
লেখকঃ সাহিত্যিক,শিক্ষক ও সহ-সম্পাদক,মহিয়সী।
আরও পড়ুন