Ads

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক 

ভ্রমণ কাহিনী পর্ব-১৪

– নুরে আলম মুকতা

কাফেলার পক্ষ থেকে খানার ব্যাবস্থা করা হয়েছে,তাঁবুতে ফিরে গেলাম। ইতিমধ্যে হজ্বের খুৎবা শুরু হয়ে গিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কিন্তু পিনপতন  নীরবতা! খুৎবা শেষে যার যার মতো এবাদত বন্দেগী শুরু। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে।
এবার আপাকে নিয়ে বের হলাম আরাফার প্রান্তরে। একজন তাজিক যুবতি মহিলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ভাইবোনের সাথী হয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করলে সাথে নিলাম। আরাফার একটি গেটে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলো ওর দামী আর শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে।
বেশি দূর এগোতে পারলাম না। তাঁবুর রাস্তা হারিয়ে ফেললে আপাকে নিয়ে ফিরে আসা মুশকিল হয়ে যাবে। বেলা গড়াচ্ছে কিন্তু লেশমাত্রও তাপ কমছে না।
আরাফার ময়দানে অবস্থানের সময় শেষ হয়ে আসছে।
একটি গাছ ধরে আপা ডুকরে কেঁদে উঠলো…
হে বৃক্ষ তুমি সাক্ষী আমরা এ ময়দানে এসেছিলাম,এর ধুলা-বালি অঙ্গে মেখেছি। মহা হিসাব-নিকাশের সময় আমাদের জন্য তুমি মহাপ্রভুর কাছে ফরিয়াদ কোরো। আমাদের সমস্ত গোনাহ আর পাপ যেন আল্লাহ ক্ষমা করে দেন,সারা বিশ্বের মুসলিমদের সাফায়াত আর নাজাতের জন্য তোমরা তোমাদের সাক্ষ্য দিও। তাজিক মহিলাও কাঁদছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে বললাম,আল্লাহুম্মা আমীন….
আমিও নিজেকে সংবরন করতে পারলাম না।
হজ্বের সময় কোন প্রানী হত্যা করা যাবে না। গাছের পাতাও ছেড়া যাবে না। আমাদের এক ভাই ভুল করে মেশওয়াকের জন্য পাতলা একটি নীমের শাখা ভেঙ্গে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। অনেক বুঝিয়ে থামালাম। কুরবানীর সাথে ওকে দম দিতে হবে। আর একটি প্রাণী বেশি কুরবানি করতে হবে।
ফজরের পরই আমরা আরাফার ময়দানে চলে এসেছি। শুকনো যা কিছু খাবার আর পানীয় ছিলো সব শেষ করে ফেললাম সূর্য ওঠার এক ঘন্টার মধ্যেই।  আপাদেরও একই অবস্থা। এতদিন আমরা খাদ্যাভাব বোধ করিনি। ওয়াসরুমের পানি গরম। ওগুলো মুখে দেয়া যায়না। সারাদিন কাটানোর কথা ভেবে শিউরে উঠছি। কারবালা প্রান্তরের কথা মনে হচ্ছে। হায় আল্লাহ! তুমি সহায়…
কিছুক্ষণ পর দেখি হেলাল ভাই মাথায় করে বিশাল এক পানীয় জলের কার্টুন বহন করে আনলো। তৃষ্ণায় ওর জিহ্বা বের হয়ে আসছে। ওতো সোনার চামুচ মুখে করা বিত্তশালী মানুষ। কিন্তু দ্বীন আর ইসলামের জন্য নিবেদিত। আমি বিস্মিত! রাস্তার পাশে সৌদী রাজের খাদ্য সাহায্যকারী ট্রাকের কাছে আমিও গেলাম। পেছন ফিরে দেখি এসপি আর সিভিল সার্জন। ওরা আমার চেয়ে বয়সী, দূজনই সদ্য অবসরপ্রাপ্ত। খুব আন্তরিক। ভিন্ন জেলার কিন্তু একই কাফেলার যাত্রী।
আপনারা পারবেন না..
আমি বলার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো দুজনেই,
এ আরাফার ময়দান সাক্ষী আমরা মানুষের সেবার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।  আপনি একাই সওয়াব হাসিল করবেন?  আল্লাহর রহমতে আমরা পারবো,একথা বলে তিনটি কার্টুন তিনজন মাথায় নিলাম।
আহা কি মনোরম দৃশ্য! ওনেক ওপরে মার্তন্ড তাপ ঢালছে আর নীচে আদম সন্তান পিপাসার্ত ভাইবোন দের জন্য একটুকরো ইহরাম শরীরে মাথায় পানির বোঝা নিয়ে ছুটে চলেছে। তপ্ত মরু প্রান্তরে!  হে আল্লাহ,তুমি সাক্ষী আমরা নিজের জন্য এ কাজে প্রবৃত্ত নই। তুমি আসমান-জমীনের মালিক কেয়ামতের ময়দানে আমরা সর্বস্ব ত্যাগ করে দিতে চাই।  এদৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয় না,এ দৃশ্য কেনা যায় না!
কিছুক্ষণ হাঁটার পর তিনজনেরই আর শরীর চলছে না। রাস্তার ধারে একটি নীমগাছের তলায় বসে গেলাম। এ অবসরে জানিয়ে রাখি বাংলাদেশের এ মহামুল্যবান নীমগাছ গুলোকে আরবীয় রা ভালোবেসে নাম দিয়েছে জিয়া ট্রি। এক ইউরোপীয় মহিলা সাহায্যের হাত বাড়ালে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ দিলাম। সি এস কে বললাম,বস আল্লাহু আকবার বলে আর একবার রিস্ক নিলেই আমাদের তাঁবু পৌছে যাবো ইনশাআল্লাহ । এস পি সম্মতি দিলে আমরা তাই করলাম।
শুধু  আমাদের তাঁবু নয় পাশের তাঁবু আর মহিলাদের সব পানীয় বিলিয়ে দিলাম। একটি জুস আমরা তিনজন ছাড়া কেউ পান করতে পারছে না। এগুলোকে আমার রিয়াদ প্রবাসী মামতো ভাই মাঠা বলেছিলো। ও বলেছিলো এগুলো প্রচন্ড তাপে পানি আর শক্তি দুটোরই যোগান দেয়। ক্রীমড মিল্কও না আবার ঘোলও না হওয়ার  জন্য আমাদের দেশের লোক এগুলোতে অভ্যস্ত নয়।
শুধু  আমাদের তাঁবু নয় পাশের তাঁবু আর মহিলাদের সব পানীয় বিলিয়ে দিলাম। একটি জুস আমরা তিনজন ছাড়া কেউ পান করতে পারছে না। এগুলোকে আমার রিয়াদ প্রবাসী মামতো ভাই মাঠা বলেছিলো। ও বলেছিলো এগুলো প্রচন্ড তাপে পানি আর শক্তি দুটোরই যোগান দেয়। ক্রীমড মিল্কও না আবার ঘোলও না হওয়ার  জন্য আমাদের দেশের লোক এগুলোতে অভ্যস্ত নয়।
আজ ৯ জিলহজ্ব। চারিধারে মানুষের ঢল। এত মানুষ! কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। আন্তরিক আর বিমূর্ত ভালোবাসার এ বন্ধন। শাশ্বত চিরন্তন মুক্তি আর সমর্পনের আশ্চর্য নজির ! লাব্বাইক  লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত আকাশ বাতাস। এ এক অপার্থিব মেলবন্ধন। বিশ্বাসীদের বিশ্বসম্মিলন। হযরত মুহম্মদ(সাঃ) এর উম্মতের সম্মিলন। পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত শুধু লা শরীক সৃষ্টি কর্তা যাকে দিব্য দৃষ্টিতে দেখা যায়না তার আনুগত্যের জন্য মহা মিলন। কোন বয়সের মানুষ নেই এখানে !  শিশু কোলে মাতা,সন্তান কাঁধে পিতা,বৃদ্ধ-বৃদ্ধা,যুবক-যুবতী।  সাদা-কালো, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া সারা বিশ্বের। পৃথিবী  নামক গ্রহের বাসিন্দা জ্বীন ও ইনসান আজ কিয়ামতের ময়দানে। এখানে সৃষ্টি এখানে ধ্বংস এখানে উত্থান। নেই
কোন ভেদাভেদ, নেই কোন শ্রেনী পেশার বৈষম্য । হুঙ্কার দিয়ে উঠছে মহা প্রভুর জয়গান। লা শরীক রাহমানুর রহীম আল্লাহর নাম। বিস্ময়কর দৃশ্য! সারা পৃথিবীর দেশের নামে নামে আরাফার ময়দানে তাঁবু। এখানে মিনার মতো আয়োজন নেই । তপ্ত বালুকাময় ধূ ধূ প্রান্তরে  মাথার ওপর সামিয়ানা আর ভূপৃষ্ঠে কার্পেট বিছানো। নেই ফ্যান,নেই এসি। নিজের বেডসীট বিছিয়ে সারাদিন কাটাতে হবে।
তাপ সহ্য করা কঠিন। আমাদের তাঁবুতে কাফেলার আয়োজনে  আমাদের দেশ বরেন্য একজন মাওলানা বয়ান করে চলেছেন। মাঝে মাঝে মানুষ আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠছে।
মিনা থেকে আসার পর গাড়ী থেকে আপার হুইল চেয়ার সহ নেমেছিলাম। পরে ওটা আর খুঁজে পেলাম না। আমারই ভুল। ওটাতে মার্কার দিয়ে মার্ক করলে হারাতো না। সদকায়ে জারিয়াহ বলে মাথা থেকে ঐ চিন্তা বাদ দিলাম।
বাবা আদম আর মা হাওয়ার মিলন স্থল আরাফার তিনদিকে তিনটি পাহাড় বেষ্টিত। তার মধ্যে  জাবালে রহমতে ওঠে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর বিদায় হজ্বে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ  ভাষন দান করেছিলেন। আরাফার ময়দানে হাজীদের  অবস্থান ফরজ। এ ময়দানের নামিরাহ মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ  আর চমৎকার স্হাপনা। এখানে অনেক নবী রাশুল নামাজ আদায় করেছেন। মসজিদটি ময়দানের শেষপ্রান্তে হওয়ার জন্য সবার দ্বারা এক আজানে  আর দুই ইক্বামতে একসাথে যোহর আর আসর পড়া সম্ভব হয় না। তাঁবুতে আলাদা  আলাদা পড়তে হয়। মাগরিব কাজা করে এশার সাথে মুজদালিফায় পড়তে হবে। ৯ জিলহজ্বের দিন ছাড়া নামিরার গেট সারা বছর বন্দ থাকে।

 

লেখকঃ সাহিত্যিক,শিক্ষক ও সহ-সম্পাদক,মহিয়সী।

(চলমান)
আরও পড়ুন