Ads

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক 

ভ্রমণ কাহিনী, পর্ব- ১৫
– নুরে আলম মুকতা
এখানে গ্র্যান্ড মুফতি হজ্বের ঐতিহাসিক খুৎবা পাঠ করেন। হে আল্লাহ তোমার পরীক্ষায় উত্তীর্ন প্রিয় নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আর মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রতি শত কোটি  দরুদ ও সালাম।
মিনায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছি পাহাড়ের ওপর দিয়ে দ্রুতগামী  ট্রেন চলে যাচ্ছে। নয়নাভিরাম  দৃশ্য! এ রেল যোগাযোগ  আরাফা-মিনা-মুজদালিফার মধ্যে। তিনটি স্থানে তিনটি করে ষ্টেশন। কিন্তু প্রচন্ড ভীড়। আমাদের উপমহাদেশের লোকজন ব্যবহার করেনা। ইউরোপ সহ অন্যান্য দেশের মানুষ এ রেল হজ্বের সময় বেশি ব্যবহার করে।
হাঁটতে হাঁটতে কিং ফাহাদ ওভার ব্রীজের কাছে চলে এসেছি। অনেক মানুষ এর নীচে শুয়ে-বসে। সবাই হজ্ব যাত্রী। বেশির ভাগ আফ্রিকান, ইউরোপীয়, আমেরিকান,চীনা,জাপানীজ। এরা সবাই মক্কা-মদিনায় ফাইভ স্টার হোটেলের আবাসিক। সওয়াবের আশায় মুল হজ্বের চার-পাঁচ দিন একদম পবিত্র মাটিতে। এরা কোন এজেন্সি ব্যবহার করেনা। নিজ দায়িত্বে  হজ্ব পালন করে।  মিনা,মুজদালিফা,আরাফায় বিশাল আকারের আর নির্দিষ্ট দূরত্বে রাস্তার ধারে ধারে গন শৌচাগার। এগুলো সবসময় পরিচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে। এগুলোতে বড় স্পেসের বাথ রুম আছে। পর্যাপ্ত হ্যান্ড ওয়াশ,লিকুইড সোপ আর টিস্যু রাখা আছে। যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। হাজী ছাড়া কেউ তো যাবার কথাই নেই। এ বিল্ডিং গুলোর একপাশ পুরুষ আর উল্টোদিক মহিলাদের জন্য।
পরদিন দুপুরে আমি আর টুটুল মহিলাদের প্রান্তে চলে গিয়েছি এমন সময় আফ্রিকান সুইপার কিশোরী দৌড়ে এসে পথ রোধ করে চিৎকার  করে ওঠে….
হাজ্জা হারাম হারাম….ফিমেল ফিমেল। ওর পরনে জিন্স প্যান্ট আর টি শার্ট। টুটুল ভড়কে গিয়েছিল… আমি বললাম, এক্সট্রিমলি সরি।
আমাদের মাথা তাপে ঠিকমতো কাজ করছিলো না মনে হয়।  পুরুষের পাশে গিয়ে আমরা গোসল সেরে আরেক সেট ইহরাম পাথরের ভুমিতে শুকাতে দিয়ে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে  রইলাম।
দশমিনিট পরে শুকিয়ে গেছে। ফিরে আসার সময়, একদল ছেলে-মেয়ে আমাদের  ঘিরে ধরলো। ওরা আমাদের রক্ত চাপ আর ডায়াবেটিস চেক করতে চায়। ছাড়বেনা কোনমতেই। টুটুলকে বললাম,তুই দেখিয়ে নে। আমি নিজে নিজে ওদের যন্ত্র ব্যবহার করলাম এজন্য ওরা খুব খুশি। ওরা রেকর্ড রাখছে। কিন্তু গনহারে করছে, সাবধানতার সঙ্গে করছে না। অনেকটা দায়সারা ভাব। বিষয়টি আমার কাছে ভালো লাগেনি। ওরা প্রফেশনাল না। হজ্বের মৌসুমে  মেডিক্যাল স্বেচ্ছাসেবী।
এখানে তো আর কেহ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই।
তাই এক দুলাভাইকে পটিয়ে তাঁবুর পাশের দোকানে নিয়ে গেলাম। দুলাভাই বিমান বাহিনীর  অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ফর্সা আর দীর্ঘদেহী। কালাদের দোকানে যায় না। বায়তুল্লাহ তে কালো মহিলার ধাক্কা ভুলতে পারছে না।
চা খেয়ে ফিরছি এমন সময় ঐ  আফ্রিকান যুবতী দোকানী দুলাভাই এর পথরোধ করলো। ইতিপূর্বে ওর সাথে আমার বেশ আলাপ জমেছিলো।
কি ব্যাপার?
দুলাভাই চা পান শেষে নির্দিষ্ট  স্থানে কাপ রাখেনি, তাই দৌড়ে এসেছে সতর্ক করতে। পুলিশ দেখে ফেললে ওর অনেক রিয়াল দিয়ে লিজ নেয়া দোকান ক্লোজড হয়ে যেত।
ওর প্রতি দুলাভায়ের মুখভঙ্গি দেখার মতো!
সন্ধ্যের পর ওর দোকানে বসে চা পান ভোলার নয়! কাপ হাতে বিস্তীর্ন এলাকার দিকে তাকিয়ে থাকা…শুধু পাহাড় আর পাহাড়। দূর দিগন্তে কোথাও একটু আলো আর প্রায় ফাঁকা রাস্তায় পুলিশের সাঁ সাঁ গাড়ীর শব্দ। একদম মরুভূমির মধ্যে।
মাশআরুল হারামে বা মুজদালিফায় অবস্থান সম্পর্কে  পবিত্র কুরানে সুরা বাকারায় স্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এখানে সাময়িক অবস্থান ওয়াজীব, আরাফাহ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময়। বিশাল পাহাড়ের পাদদেশে একটি সমতল ভূমি। মসজিদে মাশআরুল হারাম নামে একটি মসজিদ আছে মুজদালিফায় । হজ্বের সময় এ মসজিদে নামাজ আদায় করা কষ্টসাধ্য কাজ। জায়গা পাওয়া যায়না। মুজদালিফার স্থান বড় নয়। চারিদিকে পাহাড় বেষ্টন করে আছে। পাহাড়ের ওপর দিয়ে রেল লাইন।
মাঝ বরাবর বিশাল স্তম্ভ দাঁড়িয়ে। বড় করে লেখা আছে মুজদালিফা।
ওখানে অনেক নর-নারী শুয়ে বসে,কেউবা এবাদতে মগ্ন। কিন্তু সবাই বিধ্বস্ত । হজ্বের সময় জায়গাটি এত বেশী নোংরা আর আবর্জনায় ভর্তি হয়ে যায় যে অবস্থান করা মুশকিল। এক বেলাতেই ঐ অবস্থা। ওর মধ্যেই  সওয়াবের আশায় মাগরিব আর এশা পড়লাম। আপাদের ওয়াস রুমের প্রয়োজনে একটি গেটের বাইরে বেরিয়ে ওয়াসরুম পেলাম। বিশ্রামের  জন্য ভালো জায়গা।
মুজদালিফা
মুজদালিফায় দুটি প্রশ্বস্ত গেট আছে দুই পাশে। আপাদের ব্যাগে কিছু খাবার পাওয়া গেল আর ঠিক ঐ সময়ে একজন মহিলা একটি করে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। সুবহানাল্লাহি অবি হামদিহি!  কলা,রুটি,খেজুর আর পানি। শুকরিয়া,আনন্দে চোখে জল আসে।
পকেটে তো রিয়াল আছে কিন্তু  কিনে খাবার সময় কই।
চারিদিক ফর্সা হয়ে আসছে, কখন সুবহে সাদেক হয়ে গিয়েছে  বুঝতে পারিনি।
আপাদের বসিয়ে রেখে শয়তানকে মারার জন্য পাথর কুড়াতে গেলাম। অশ্রু সংবরন করতে পারছিনা। হযরত ইব্রাহিমের (আঃ) প্রিয় সন্তান  ইসমাঈল (আঃ) কে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানী করার ঘটনা মনে হচ্ছে । কাল্পনিক  ভিজ্যুয়াল ছবি চোখের সামনে চলে আসছে। দুজন মহিলা আর আমার জন্য কমপক্ষে একুশটি করে কঙ্কর বা ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে নিলাম।
ফজর শেষে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে  কাফেলার সাথীদের খোঁজে বের হলাম। ফোনের চার্জ প্রায় শেষ। যোগাযোগ করতে পারলাম না।
তিন ভাইবোন দলছুট হয়ে গেলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কাউকে পেলাম না। অস্থির হয়ে খুঁজলাম।
ওরা কি আমাদের খোঁজার চেষ্টা করছে না? আমরা দু’ভাইবোনকে  না খুঁজুক? আরেকজনের স্ত্রী তো আমার সাথে।
এখানে আর ভেবে কাজ নেই। সামনে অনেক কাজ।
আমাদের যে ভাবেই হোক জামারায় পৌঁছাতে হবে।
কয়েকবার রিং দিতেই ফোন বন্দ হয়ে গেল। সবাই জামারার রাস্তায় চলে যাচ্ছে। আমরা কি করবো তিন ভাইবোন মিলে পরামর্শ করার জন্য রাস্তার পাশে একটি খেজুর গাছের তলায় বিধ্বস্ত শরীরে শুয়ে পড়লাম।
(চলমান)

লেখকঃ সাহিত্যিক,শিক্ষক ও সহ-সম্পাদক,মহিয়সী।

আরও পড়ুন