Ads

সন্তানদের বন্ধু বানান

(এটি ষষ্ঠ পর্ব, বন্ধু দয়া করে পড়ুন)
– নুরে আলম মুকতা
জৈষ্ঠ্য মাস। প্রচন্ড তাপ। বাইরে বেরুনো যাচ্ছে না। গনগনে ফুলকি যেন শরীরে বিধছে। আমরা কি সত্যিই মরু আবহাওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছি? খোদা না করুন এরকম অবস্থা হোক ! চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া !
ততদিনে মনে হয় আমরা আর এ গ্রহে থাকবো না, যখন চারিদিকে শুধু খাঁ খাঁ রোদ্দুর, পিপাসায় পথিকের ছাতি কাঁপে দুদ্দুর! হাঁ আল্লাহ তুমি সর্ব শক্তিমান!  এরকম দিনে মাকে নিয়ে একটি বিশেষ কাজে গিয়েছিলাম। যত দ্রুত সম্ভব কাজটি সেরে ফিরে আসছিলাম। রাস্তায় তবুও জ্যাম। অবাক লাগে! লক ডাউন, করোনার আতঙ্ক চারিদিকে। কিন্তু মানুষের প্রয়োজন তো কোনকিছুরই পরোয়া করে না। আমি যেমন বেরিয়েছিলাম। মনে হয় এভাবেই সবাই বেরিয়েছে। মধ্য দুপুর। মাথার ওপরে সুর্য। মা হঠাৎ বলে ওঠলো ঐযে আব্বু, ওখানে দেখো আম্মু বলছিলো। ততক্ষণে আমাদের গাড়ি ঐ স্থান পেরিয়ে গিয়েছে। কি করবো ?  সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। মুখে মাস্ক, মাথায় টুপি, দরদর করে ঘামছি। এক বন্ধুর কথা আমার মাথায় এমন করে ঢুকেছে যে , আমার জীবন-দর্শন পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। ও বলেছিলো, তোমার সাধ্যের মধ্যে  যা কিছু হালাল তার সব কিছু করার চেষ্টা করো। নয়তো সময় পাবে না। মুহুর্তের মধ্যে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। গেলাম স্পটে। তাল শাঁস!  আমরা কেউ কেউ তাল পানি বা তালকুর বলি। বাঙ্গালীর রসনা মেটায় এ কষ্টকর আহরিত ফলের শাঁস। আমরা ভেবে দেখিনি এটি আহরন থেকে মুখে পুরে দেয়া পর্যন্ত কত কষ্ট করতে হয়! আজকের বিষয়টি একটু ভিন্ন। আমরা সাধারণত এরকম দৃশ্য আজকাল দেখি না। পান দোকানীর মাথাতেও একটি শেড থাকে। কিন্তু তাল শাঁস কেটে কাজ করছে যে মানুষটি তার মাথায় কোন ছায়া নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ি কোথায়?
স্যার , বজরাটেক।
তুমি কি নিজে এগুলো গাছ থেকে নামিয়েছো?
জ্বী স্যার, হামি আর হামার ছেলে।
তোমার ছেলে কি রকম সাহায্য করেছে?
গাছের নীচে একটি থোক্কা নাইমা গেলে আর একটার জন্যে দড়ি খুইলে দিয়াছে।
এতটুকু বাচ্চা ও থোকা সরাতে পারে?
পারতেই হইবে স্যার।
কে কোরবে?
এগুলোর তো ওজন কম না?
জ্বী স্যার, ওজন ম্যালাই বেশি। তুমি বাজারের শেডে যাওনি কেন? জাগা খারাপ হইছে এজন্যে হামাকে পার্শের দোকানদার বসতে দেয়নি।
এজন্য একদম খোলা আকাশের নীচে?
আমার প্রশ্নের আর উত্তর না দিয়ে বলে,আপনাকে হামি চিনি স্যার। হামার বেটি আপনার পরামর্শে নার্সিং পড়ছে। ওর নার্সিং উচ্চারনে আমি থতমত খেয়ে যাই। এদিকে ছোট্ট মায়ের দৃষ্টি অন্য কিছু আবিস্কার করে ফেলেছে। শাঁস তোলার কাজে ব্যস্ত বাবার মাথায় একটি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে গনগনে সূর্যের তাপ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে সন্তানটি। নিজে রৌদ্রস্নাত। বাচ্চাটির ফর্সা উজ্জ্বল মুখাবয়ব রক্তিম হয়ে গিয়েছে। আমি তাল শাঁস নিয়ে ঐ জায়গা থেকে সরে গেলে যেন বাঁচি এরকম তাপ। মা আমাকে থামিয়ে দিলো। আব্বু আমরা কি একটি কাজ করতে পারি না?
ওদের বাজারের টিনের নীচে চলে যাবার বিষয়ে সাহায্য করতে পারি না ? দেখ এত ছোট ছেলে নিজের মাথা না ঢেকে বাবাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে! আমরা যদি ওদের বাজারে নিয়ে যাই তবে বাবা ছেলে দুজনই বাঁচে।
আমি স্তব্ধ, অনড়। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। মাকে বোঝানো যাচ্ছে না, ওদের পশরা, মাল সামান নিয়ে আবার টানাটানি হবে। এখানে বেশ খদ্দের জমেছে। ওখানে নাও যেতে পারে।
এ ঘটনার অবতারনা করলাম এজন্য যে, আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অজস্র ছোট ছোট ঘটনার এটি একটি। আমি যদি মাকে সাথে না নিয়ে ঘুরতাম তাহলে সুকোমল হৃদয় নিঃসৃত এ বিষয়টি আমাকে পড়াতে হতো। হাতে-নাতে প্রমান করার জন্য পাত্র-পাত্রী কি আর সবসময় পাওয়া যায় ?
মানবিক গুণাবলি তৈরি করা আর দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নের জন্য আমাদের পথে নামতে হবে। পুঁথিগত বিদ্যায় মানুষ হওয়ার আশা করা আমার মনে হয় আমাদের নিরর্থক চেষ্টা।
আমি সবসময় বলি প্রিয় বন্ধু, আসল বিদ্যা কিনে পাওয়া যায় না। বাবা মাকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা প্রজন্ম সৃষ্টি করার জন্য কত ফিকির করছি ! কিন্তু প্রজন্ম যদি মানুষ না হয় তবে অমানুষ হওয়ার দায় আমাদের নিয়ে এ গ্রহ থেকে বিদায় নিতে হবে। প্রিয় সন্তানেরা অমানবিক হোক আমরা কেহই কামনা করি না।
(চলমান)
লেখকঃ সাহিত্যিক,শিক্ষক ও সহ-সম্পাদক,মহিয়সী।
আরও পড়ুন