Ads

সিগনেচার

প্রাইমারিতে তো বটেই এমনকি হাইস্কুলে পড়ার সময়ও আমরা ক্লাসে একে অন্যের খাতা নিয়ে টানাটানি করতাম। কেন করতাম জানেন? ক্লাস ওয়ার্কের খাতায় আমাদের স্যার কী মন্তব্য লিখলেন? কতটা সুন্দর সিগনেচার দিলেন সেটি নিয়ে আমরা প্রতিযোগিতা করতাম। আমি স্যারের সিগনেচারের উপর আদর করে চুমো খেতাম। ভুলবশত স্যার যদি সাইন নাকরেই খাতা ফেরত দিতেন আমরা স্যারের পেছন পেছন দৌড় দিতাম – স্যার, সিগনেচার প্লিজ। কী ছিলো সেই সিগনেচারে? ছিলো ভালোবাসা, আদর, প্রশান্তি, স্বীকৃতি আরও অনেককিছু। একদিন খাতা চেক করে দেখি স্যারের সিগনেচার নেই, পরেরদিন দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম খাতা খুলে স্যারের সিগনেচার নেবার জন্য। মনের মধ্যে জেদ স্যার ক্লাস শুরু করার আগেই গতকালের কাজে সিগনেচার নিতে হবে।
আমার পরিচিত একটা বাচ্চার ঘটনা বলি:
সে স্কুল থেকে এসেই লুকিয়ে লুকিয়ে তার মায়ের ক্রিম, পাউডার নিয়ে সাজগোজ শুরু করে দেয়। বেশ কিছুদিন এরকম দেখার পরে মা জিজ্ঞেস করলেন – তুমি এরকম কেন করো?
সে খুবই মন খারাপ করে জবাব দিলো – আমার টিচার আমাকে ভালোবাসেন না। ক্লাসে আরেকটি মেয়ে আছে যার গায়ের রঙ খুবই ফর্সা, টিচার ওকে সবচেয়ে বেশি আদর করেন। আমার গায়ের রঙ কালো তাই আমি ফর্সা হবার চেষ্টা করছি।
কী সাংঘাতিক কষ্ট তার মনে! মেয়েটির আক্ষেপ শুনে আমার মনের ভেতরে একটি ঝড় বয়ে গেলো। এইটুকু মেয়ে! কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। কতটা গভীরে বিশ্লেষণ করে সে বুঝতে পেরেছে টিচার বিশেষ একজনকে বেশি আদর করেন এবং কেন করেন সেই কারণও চিহ্নিত করেছে।
একাধিক সন্তানের মা/বাবারা ব্যালেন্স করতে হিমশিম খেয়ে থাকেন। সকল সন্তানের মনে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করা যে, “আমরা তোমাদের সবাইকে সমান ভালোবাসি” এটি সবসময় এত সহজ হয়ে উঠে না। বাচ্চাদের মন; কখন যে কী ভেবে বসে থাকে একমাত্র আল্লাহ্ই ভালো জানেন।
যারা শিক্ষকতা করেন বিশেষকরে ছোটো বাচ্চাদের যারা পড়ান তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাচ্চাদের বিশ্বাস অর্জন করা। কাজটি এত সহজ নয় কিন্তু, সেই কাজটি আপনাদেরকে করতে হবে প্রচুর ধৈর্য্য সহকারে, নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে এবং সর্বোপরি মনঃস্তাত্বিক এক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে প্রতিনিয়ত।
দুই/তিনটি সন্তানের মা/বাবা যখন এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে থাকেন তাদের আপন সন্তান দ্বারা যে – তোমরা আমাকে কম ভালোবাসো কিংবা ওকে বেশি ভালোবাসো। ছেলে বেশি আদর পায় কিংবা মেয়ে বেশি আদর পায়। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! ভাবতে পারেন? আপন মা/বাবা যদি সকল সন্তানদের কাছে সমান বিশ্বাস অর্জন করতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন সেই জায়গায় এক‌টি শ্রেণীকক্ষে ৩০/৪০টা বাচ্চার আস্থা অর্জন করা কী অসাধ্য সাধন কল্পনা করতেও ভয় লাগে। বছরের পর বছর যারা এই ম্যাজিক দেখিয়ে আসছেন তাদের সবাইকে সালাম। গোটা শিক্ষক সমাজের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
দুই/তিনটি সন্তানের মা/বাবা যখন এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে থাকেন তাদের আপন সন্তান দ্বারা যে – তোমরা আমাকে কম ভালোবাসো কিংবা ওকে বেশি ভালোবাসো। ছেলে বেশি আদর পায় কিংবা মেয়ে বেশি আদর পায়। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! ভাবতে পারেন? আপন মা/বাবা যদি সকল সন্তানদের কাছে সমান বিশ্বাস অর্জন করতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন সেই জায়গায় এক‌টি শ্রেণীকক্ষে ৩০/৪০টা বাচ্চার আস্থা অর্জন করা কী অসাধ্য সাধন কল্পনা করতেও ভয় লাগে। বছরের পর বছর যারা এই ম্যাজিক দেখিয়ে আসছেন তাদের সবাইকে সালাম। গোটা শিক্ষক সমাজের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করি
সকল শিক্ষকদের কাছে কড়জোড়ে মিনতি করে একটি নিবেদন রাখতে চাই। আপনি শিক্ষক হননি, আপনাকে শিক্ষক হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আপনাকে নির্বাচন করেছেন কোমলমতি এইসব বাচ্চাদের আর্কিটেক্ট হিসেবে। হাজার হাজার বাচ্চার জীবনের স্থপতি আপনি। আপনার সামান্য একটু আদর, একটি ছোট্ট মন্তব্য, একটি চাহনি, একটু স্পর্শ কোনো কোনো বাচ্চার মনে ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে অথচ আপনি জানেনই না আসলে কী হচ্ছে? কারণ, আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ভেদাভেদ হয়তো করেননি। আপনার অজান্তেই সেটি হয়ে যাচ্ছে। আপনার এক‌টি অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্য এক‌টি বাচ্চার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার শক্তি রাখে।
হয়তো একটা বাচ্চা বেশি কিউট – আপনি একটু আদর করে দিলেন, গালটা একটু টিপে দিলেন, মাথার চুল এলোমেলো করে দিলেন অথবা ছোট্ট একটি মন্তব্য করলেন ‘স্মার্ট’ বলে। আপনি করলেন আদর অথচ পাশে বসে থাকা আরেকটি বাচ্চা হয়তো নিজেকে ইনফিরিয়র ভেবে মনে কষ্ট নিয়ে বসে থাকলো। আপনাকে অনেক বেশি কৌশলী হতে হবে, আবেগ প্রকাশের চেয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হবে বেশি। সকল বাচ্চাদের মনে আস্থা অর্জন করতে হবে নির্মোহভাবে। বাচ্চারা মা/বাবার চেয়েও টিচারকে বেশি অনুকরণ করে। বাসায় এসে সারাক্ষণ টিচারকে নিয়ে গল্প করে – আমার টিচার এমন, আমার টিচার তেমন। আমার মেয়ের টিচারের জন্মদিন নিয়ে তার যতটা উচ্ছ্বাস, এক্সাইটমেন্ট দেখেছি তার নিজের জন্মদিন নিয়েও ততটা দেখিনি। আপনাদের প্রতিটি মুভমেন্ট তাদের মুখস্ত।
আপনি জানেন কি বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে তাদের টিচার নিয়ে প্রতিযোগিতা করে? কাকে টিচার বেশি ভালোবাসেন? টিচারের জন্মদিনে কে, কী গিফট দিবে সেটি নিয়েও প্রতিযোগিতা হয়। হোমওয়ার্ক বইয়ে টিচার কার জন্য, কী কমেন্ট লিখেছেন সেটি নিয়েও ওদের মধ্যে তুমুল আলোচনা চলে। টিচার ভুল পড়ালেও ওরা মানতে রাজি হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না টিচার নিজে বলবেন এটি ভুল হয়েছিল এমনকি আমরা স্বামী/স্ত্রী উভয়ই শিক্ষক হওয়া স্বত্বেও আমাদের মেয়ে টিচারের ভুল মানবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না টিচারকে দিয়ে বলিয়েছি।
বাচ্চাদের সাইকোলজি বুঝতে পারা কোনো সহজ ব্যাপার নয়। এই অসম্ভব কঠিন কাজটি যারা প্রতিদিন করে আসছেন সেইসব শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সমাজের সবাইকে হাজারো সালাম। আপনাদের কাছে আমরা প্রতিটি মা/বাবা আজীবন ঋণী। সবাইকে শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা।
মনসুর আলম
সাউথ আফ্রিকা প্রবাসী,লেখক ও সহ-সম্পাদক,মহীয়সী।
আরও পড়ুন