নাসিমা খান
বিয়ের দুবছর না যেতেই মারিয়া আমাকে ছুটি দিয়ে চলে গেলো, রেখে গেলো একবছরের মিনাকে ।স্ত্রী বিয়োগের শোক আমাকে মুহ্যমান করে রেখেছিলো, ছ’মাস । নির্লজ্জের মত বলতেই হচ্ছে মিনার জন্য একজন মায়ের যতটা না দরকার ছিলো, আমার দরকার ছিলো একজন বউয়ের । যে টেবিলে নাস্তা রেডি করে বসে থাকবে, আমার অফিস যাবার আগে আমার প্যান্ট শার্ট স্ত্রী করে রাখবে, হাতের কাছে ঘড়িটা, বেল্টটা এনে ধরে রাখবে , আমাকে কোট পরিয়ে দেবে । এই অভাব গুলো আমাকে প্রতি মুহূর্তে তাড়া করে ফিরছিলো, বাবাকে বলতে পারছিলাম না, মাকেও না ।
মায়ের কোমর ব্যথা, সকালে কাজের বুয়ার হাতের নাস্তা, চা এগুলো আমার অপছন্দ হতে শুরু করলো। বাবা মা সারাদিন মিনাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে ।
হঠাত একদিন শিউলির সাথে দেখা । চমকে উঠেছিলাম, লিকলিকে শিউলি, নাদুস নুদুস হয়ে উঠেছে, একটি স্কুলে পড়ায় । চোখের ইশারা দিয়ে অনেক কিছু বলতে পারেও ।
বসলাম যাত্রী ছাউনির নীচে । বললাম,-বল, কেমন আছিস ?
ভালো, তুই ?
এই যে মারিয়ায় চলে গেলো ।
মানে ? মারিয়া নেই ? কবে ? কী হয়েছিলো ?
জ্বর, না বলেই, মিনাকে রেখে গেলো ।
শিউলি চুপ হয়ে গেলো । ওর চোখে বেদনা ভর করেছে কালো মেঘের মত ।বললাম,- বাদ দে, তোর কথা বল ।
আমার কথা ? আছি ।
মানে ? তোর বর ?
ঐ যে হুস করে প্লেনে চড়ে চলে গেছে শুনেছি সেখানে বিয়ে সাদী করেছে, বাদ দে, এই ভালো আছি ।
দে তোর মোবাইল নম্বর দে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম বাস চলে এসেছে । এই বাস ?না, আমারটা আসেনি, ফোন দিস ।
আমি দ্রুত বাসে উঠে বসলাম । অফিস যেয়ে কাজের ফাঁকে বার বার শিউলিকে মনে পড়ছিলো । লাঞ্চ আওয়ারে ফোন দিলাম ।
কী করছিস ?
খেলাম, বসে আছি ।
বিয়ে সাদীর কথা ভাবছিস না ?
ভাবছি, কিন্তু মনের মতো মানুষ কোথায় বল ? কে এই তালাকপ্রাপ্তা নারীকে বিয়ে করবে বল ?
যদি কিছু মনে না করিস, আমি তোর কথা , মাকে বলতে পারি ।
শিউলি আবার থেমে গেলো । তারপর ফোন কেটে দিলো ।
অশস্তিতে ভুগছিলাম । বাসায় গিয়ে বাবাকে বললাম,- বাবা, আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করেছি, ওকে মিনার মা হিসাবে এ বাড়ীতে আনতে চাই ।
বাবা কপাল কুঁচকে তাকালেন । তার কথাটা পছন্দ হলো না। মা বললেন,- মেয়েটিকে দেখা, দেখি । কী করে ?
ওর বিয়ে হয়েছিলো, স্বামী বাইরে যেয়ে আবার বিয়ে স্বাদী করেছে, ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে ।
বাবা চিৎকার করে উঠলেন অসম্ভব হতে পারে না ।
কেনো , বাবা ?
ওর একবার বিয়ে হয়েছিলো।
আমারও হয়েছিলো ।
মিনাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, সেকী আমার মিনাকে মেয়ের মত জানবে ?
বাবা, ওখুব ভালো মেয়ে ।
মা হেসে বললেন, চিন্তা করিস না, আমি তোর বাবাকে ম্যানেজ করবো, তুই মেয়েটিকে, ওর গার্জিয়ানের সাথে কথা বলতে বল ।
রুমে এসে ফোন দিলাম, শিউলি ।
বল, শুনছি ।
তোর অভিভাবক কে ?
আমার বাবা মা ।
ওদের আমি বলবো ?
না, আগে আমি বলি ।
ওকে, গুড নাইট, ঘুমা ।
খুব অল্পদিনে সব ম্যানেজ হয়ে গেলো । শিউলি মিনাকে মেয়ের মতই বুকে টেনে নিলো । কিন্তু বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না শিউলিকে, ও মিনাকে ঠিকমত খাওয়ায় না, তার স্কুল নিয়ে বিজি থাকে, বৌমাকে চাকুরী ছাড়তে বল।
শিউলি শুনে অবাক হয়ে বললো, এটা সম্ভব নয়,অলি ।
কেনো নয় ? আমি যথেষ্ট টেক কেয়ার করি, কিন্তু চাকুরী ছেড়ে নয় ।
দেখতে দেখতে আরও একবছর পার করলাম ।
বাবা মিনাকে শিউলির কাছে ঘেষতেই দেন না, শিউলি বললো, আমি মা হতে চাই, অলি ?
ওকে ।
কিছুদিন যেতেই শিউলি গর্ভবতী হলো । বাবা শুনে খুব উদবিগ্ন হয়ে ঘুরতে লাগলেন । আমাকে ডেকে বললেন,-ঠিক করোনি, অলি ।
কেনো বাবা, ওতো মেয়ে, মাতৃত্বের স্বাদ ওরও পেতে ইচ্ছে করে ।
ঠিক আছে, কিন্তু এমনি নজর দেয়না মিনার প্রতি এরপর তো দুজন দুজনের শত্রু হয়ে যাবে ।
না, বাবা তুমি ওদের মিশতে দাও ।
বাবা ক্ষেপে উঠলেন, আমি মিশতে দিই না ।
না, বাবা , ঠিক ওভাবে বলছিলাম না ।
বাবা আরও তিক্ষ্ম স্বরে বললেন, বুঝে নিয়েছি সব আমি, আমার সব সমপত্তি আমি মিনার নামে লিখে দেবো ।
বাবা, এরকম সিদ্ধান্ত কেনো নিচ্ছেন ?
তোর জানবার দরকার নেই ।
শিউলি সব শুনে চুপ হয়ে গেলো ।ভালো মন্দ কিছুই বললো না ।
রাত গভীর ছিলো । কেউ কোথাও জেগে নেই, আমি ঘুমাচ্ছিলাম ।
হঠাৎ করে জেগে গেলাম, দেখি পাশে শিউলি নেই ।
বারান্দায় যেয়ে দেখছি, আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে গভীর দৃষ্টি । ঘাড়ে হাত দিলাম, কী হয়েছে , শিউলি ? ঘুম আসছে না ?
শিউলি তাকালো , কোনো কথা না বলে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো ।
পরদিন যথা নিয়মে সব কিছু হলো, শিউলি, কথা বললো না । তিনদিন চলে গেলো। আমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠলাম,শিউলি কী হয়েছে ?
শিউলি খুব শীতল কণ্ঠ বললো, আমি বাচ্চাটাকে ফেলে দিতে চাই ।
কেনো ?
ওকে আমি চাই না, তাই ।
তুমিই তো চাইলে মা হতে ?
চেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা ভুল ছিলো ।
পরদিন মিনার জ্বর। বাবা বললেন, আজ শিউলিকে ছুটি নিতে বল অলি ।
বাবা ওর স্কুলে ইন্সপেক্টর আসবেন্ন ইন্সপেকশনে, ছুটি হবে না ।
মিনার জ্বর ।
বাবা, তুমি , মা দরকার হলে আমিও ছুটি নেবো ।
বাবা রুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন । বললেন, জানি , জানি, নিজের মেয়ে হলে কী করতো ?
শিউলি ধীর পায়ে এসে মিনাকে কোলে তুলে নিলো, বললো, আমি হেড মিশট্রেজকে বলে ছুটি নিয়েছি ।
কখন বললে,-ফোন করেছিলাম ।
আমি বললা, তাহলে তো আমার থাকার দরকার নেই, বাবা, মা আছে ।
মার প্রেসারটা হথাত বেড়ে গেলো । বাবা বললেন, তোর মাকে নিয়ে হাসপাতাল যাচ্ছি, দেখিস সব ।
শিউলি আমার কাছে এসে বললো,তুমি কী জন্য থাকবে, অফিস যাও, আমি মিনাকে সামলাবো, ওষুধ তো সব আছে ।
আমিও তাই ভাবলাম ,বললাম,-শোনো, জ্বর বাড়লে আমাকে ফোন দিও ।
ঠিক আছে, চিন্তা করো না ।
অফিসে কাজ করছিলাম, মনটা মা আর মিনার জন্য খারাপ ছিলো, হঠাত শিউলির হেড টিচার ফোন দিলো, অলি ভাই, শিউলি স্কুলে আসেনি কেনো, ওর কী হয়েছে ?
মানে , ও আপনার কাছ থেকে ছুটি নেয়নি ?
নাতো ।
আচ্ছা , আমি দেখছি । ফোন দিলাম শিউলিকে, ফোন বন্দ ।
দ্রুত অফিস থেকে বাসায় আসলাম । দরজায় নক করলাম। খুললো না,কেউ । ডাকলাম, শিউলি, শিউলি ?
কোনো সাড়া নেই । দরজা ভাঙ্গবো, দরজায় কয়েকটা লাথি দিতেই খুলে গেলো । দেখলাম শিউলি চুপচাপ খাটের উপর বসে আছে ।আমি বললাম, মিনা কোথায় ?
শিউলি আমার হাত ধরে দোতলায় নিয়ে গেলো , নিচের ড্রেনের পাশে একটা গাছের পাশে রক্তাক্ত মিনার দেহ পড়ে আছে । শিউলি, শান্ত কণ্ঠে বললো, আমি ওকে ফেলে দিয়েছি ।।