শেলী জামান খান
এই ২০২০ সালটি নানা কারনে আমাদের মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি বিশেষ বছর হিসেবে স্মরনীয় হয়ে থাকবে। প্রতি একশত বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা যেমন ভয়াবহ সব মহামারির ভেতর দিয়ে গিয়েছেন, তেমনি ভয়াবহ আরেকটি মাহামারির ভেতর দিয়ে আমরাও যাচ্ছি। বছর জুড়ে চলা মহামারির আক্রমণে কুপোকাত আজ মানুষের জীবন।কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিপন্ন মানব সভ্যতা।ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে পরাজিত বিজ্ঞান ও গবেষকদলের প্রচেষ্টা। একটি প্রতিষেধক ও কার্যকরী ভ্যাকসিনের জন্য মানুষের আহাজারি। পৃথিবী জুড়ে লকডাউন আর মৃত্যুমিছিল।জনশূন্য মৃত্যপুরী নগরী। লাশের স্তুপ!
এই বছরই আমরা অবলোকন করতে যাচ্ছি, আরও একটি অস্বাভাবিকতা! আরও একটি চমক।আমরা প্রত্যক্ষ করবো ‘ওয়ান্স ইন এ ব্লু মুন’ নামে একটি অসাধারণ ‘নীল চাঁদ’! এই বছর ঘটবে মোট তেরটি ‘পূর্ণচাঁদ’ বা ‘ফুলমুন’ পুর্নিমা। এরমধ্যে আছে দুটি সুপারমুন, একটি হ্যালোইন এর ফুলমুন।
এই বছরের অক্টোবরকে ‘মুন ইভেন্ট’ বা ‘চন্দ্র প্রদর্শনী মাস’ও বলা যায়। কারন, পহেলা অক্টাবর এবং ৩১ অক্টোবর হ্যালোইন রাতের ‘ফুলমুন’সহ এই মাসটিতে দুটি পূর্ণচাঁদ দেখা যাবে। এর উনিশ বছর পর ২০৩৯ সাল পর্যন্ত যারা পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে, তারা হয়তো দেখতে পাবে এমনি আরেকটি মাতাল করা হ্যালোইন পূর্ণিমা। কৃষক আলমানাকের অনুসারে সর্বশেষ হ্যালোইন পূর্ণিমার চাঁদটি পৃথিবীতে দৃশ্যমান হয়েছিল ১৯৪৪ সালে।
এবারের হ্যালোইন পূর্ণিমায় উদিত হবে একটি “নীল চাঁদ”। কারণ এটি একই মাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমা।নাসা’র মতে সাধারণত প্রতিটি মাসে কেবল একটি পূর্ণিমা থাকে। তবে মাঝেমধ্যে দ্বিতীয় আরেকটি উঁকি দেয়। পূর্ণচাঁদগুলো ২৯ দিনের দ্বারা পৃথক করা হয়। যখন বেশিরভাগ মাস ৩০ বা ৩১ দিনের হয় তখন এক মাসেই দুটি পূর্র্ণচাঁদ ফিট করা সম্ভব হয়। এটি গড়ে আড়াই থেকে তিন বছর পরপর ঘটে।
কৃষক আলমানাকের মতে, নীল চাঁদের একটি বিকল্প সংজ্ঞা আছে। একক মওসুমে যখন চারটি পূর্ণ চাঁদ থাকে, তখন তৃতীয়টিকে নীলচাঁদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
আঠারো শতকের আয়ারল্যান্ডকে হ্যালোইন উত্সবের জন্মস্থান বা সূতিকাগার বলে মনে করা হয়। প্রায় দুই হাজার বছর আগে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে কেল্টিক নামে এক জাতি বাস করতো। নভেম্বরের প্রথম দিনে তারা নববর্ষ বা ‘সাহ উইন’ পালন করতো। এ দিনটিকে তারা গ্রীষ্মের শেষ আর শীতের শুরু মনে করতো। অক্টোবরের শেষ দিনটিকে তারা মনে করতো অন্ধকার রাত। যে রাতে সকল অতৃপ্ত আত্মা ও প্রেতাত্মারা আবারও লোকালয়ে ফিরে আসে। ফিরে আসে ফেলে যাওয়া জীবন ও মানুষের কাছে। স্কটিশ শব্দ ‘অল হ্যালোজ ইভ’ থেকে ‘হ্যালোউইন’ শব্দটি এসেছে। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে ‘হ্যালোজ ইভ’ শব্দটি হ্যালোউইনে রূপান্তরিত হয়েছে। হ্যালোউইন শব্দের অর্থ ‘পবিত্র সন্ধ্যা’।
অতৃপ্ত আত্মারা ফিরে এসে মানুষের ক্ষতি করতে পারে, কেল্টিক জাতি এটা বিশ্বাস করতো। অতৃপ্ত আত্মাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা তাই বিভিন্ন করমের ভূতের পোশাক, মুখোশ পরে অক্টোবরের শেষরাতটিতে আগুন জ্বালিয়ে, মন্ত্র পড়তো। এভাবেই অশুভ আত্মার অশুভ শক্তি থেকে পরিবার ও সমাজের সবাইকে রক্ষা পাবে বলে বিশ্বাস করত কেল্টিকরা। কালক্রমে কেল্টিক জাতির নববর্ষের আগের রাত ‘’অল হ্যালোজ ইভ’ বা সাহ-উইন উৎসবই এখনকার হ্যালোউইন উৎসব হিসেবে সবার মাঝে জায়গা করে নেয়।
তাই বলা যায়, ‘হ্যালোইন’ পুরানো কেল্টিক উত্সব, ‘সা-উইন’ ইভ থেকে তার শেকড় সংগ্রহ করেছে।কেল্টিকদের গভীর বিশ্বাস ছিল, পৃথিবী’র জীবিত এবং মৃতদের মধ্যে যোগসূত্র খুবই শক্তিশালী। ‘সা-উইন’ মানে গ্রীষ্মের সমাপ্তি ও ফসলের উত্সব। এবং মূলত আসন্ন কষ্টকর শীতকালটি ভালোভাবে কাটিয়ে ওঠার জন্য অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে সাহায্য ও সমর্থন চাওয়ার সময়।
কেল্টিক হ্যালোইন ঐতিহ্য আজও আয়ারল্যান্ডে প্রচলিত রয়েছে।উনিশ শতকের আইরিশ অভিবাসীদের দ্বারা এই উৎসবটি আমেরিকায় এসে পৌঁছেছিল। এই অদ্ভুত আচরণের কারণেই ভীতিজনক এবং ঐতিহ্যবাহী হ্যালোইন উৎসবটি প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় উৎসবে পরিনত হয়েছে।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, যখনই একক মাসে দুটি পূর্ণ চাঁদ দেখা দেয় যা গড়ে প্রতি আড়াই থেকে তিন বছর অন্তর ঘটে। এই দ্বিতীয় পূর্ণ চাঁদটির নাম দেয়া হয়েছে “ব্লু মুন”। তবে হ্যালোইনের রাতে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকালে, এটিকে নীল রঙের দেখা যাবে তা’ কিন্তু না। তবে খুব অসাধারণ কিছু একটা দেখা যাবে। হ্যালোইন এমন একটি পূর্ণচাঁদ প্রতি উনিশ বছরে প্রায় একবার ঘটে। এটি একটি রূপ যা ‘মেটোনিক চক্র’ নামে পরিচিত।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ সালে এই সুপরিচিত চন্দ্রচক্রটি আবিষ্কার করেছিলেন মেটন নামের একজন গ্রীক।যিনি ছিলেন এথেন্সের বাসিন্দা।তিনি ধারনা করেছিলেন যে উনিশ বছর কেটে যাওয়ার পরে, চাঁদের পর্যায়টি একই তারিখে পুনরাবৃত্তি হবে। মেটনের নামানুসারে এই সূত্রের নামকরন করা হয়। ‘মেটোনিক চক্র’। হ্যালোইন পূর্ণিমার জন্য, বিশ শতাব্দীর প্রথমদিকে মেটোনিক চক্রটি ভালভাবে কাজ করেছিল।১৯২৫ এবং ১৯৪৪ সালে। তবে, ১৯৬৩, ১৯৮২ এবং ২০০১ সালে মেটোনিক চক্রটি পরিবর্তিত হয়ে একদিন পরে অথাৎ পহেলা নভেম্বর হয়েছিল। এবার ২০২০ সালে, এটি আবারও ৩১ অক্টোবরে ফিরে আসল।সত্যিই আমাদের জন্য এটি হবে একটি বিশেষ ও বিরল ঘটনা দর্শন করা।
মজাদার ঘটনা হল, এই বছর, ৩১ শে অক্টোবর চাঁদটি প্রযুক্তিগতভাবে “পূর্ণ” হবে। এটি হবে একটি ‘ব্লু মুন’। কারণ চন্দ্রচক্রটি বা লুনার সাইকেলটি কেবল ২৯.৫ দিন দীর্ঘ।অবশ্য “ব্লু মুন” এর আরেকটি বিকল্প সংজ্ঞাও আছে, যখন একক মওসুমে চারটি পূর্ণচাঁদ হয়, তখন তৃতীয়টিকে “ব্লু মুন” হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
মেটনিক চক্রের উনিশ বছরের প্যাটার্ন অনুযায়ী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, ২০২০ সালের পর আমরা একশত ভাগ আলোকিত হ্যালোইন পূর্ণচাঁদ দেখতে পাব যথাক্রমে ২০৩৯, ২০৫৮, ২০৭৭, এবং ২০৯৬ সালে।
সাধারণ সংজ্ঞায় ‘ফুল মুন’ মানে পূর্র্ণচাঁদ। পরিস্কার, স্বচ্ছ আকাশে ১৮০ ডিগ্রী অবস্থানের ঠিক এ সসময়টিতে চাঁদকে পুরো আলোকিত দেখা যায়।পূর্নিমার এই
চাঁদের আলো মানুষের মন, আচার-আচরণ, ব্যবহারের উপর আসলেই কি কোন প্রভাব বিস্তার করে? হয়ত করে। কারন আমরা আমাদের নিজের, পরিবারের সদস্যদের, বন্ধু-বান্ধব এবং পরিচিত অনেকের জীবনে, আচরণে পূর্নিমারাতের প্রভাব প্রত্যক্ষ করি।
প্রকৃতির সাথে প্রকৃতির সন্তান মানুষের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট। তাইতো দেখা যায় প্রকৃতির অপার্থিব সৌন্দর্য, বিশালতা আমাদের মানুষের মনে দারুনভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তাই পূর্নিমার রাতে, বিশাল সাগর বা সুউচ্চ পাহাড়ের সামনে আমাদের মনে একটি হাহাকার সৃষ্টি হয়।প্রকৃতির বিশালতা অপার সৌন্দর্যর সামনে মানুষ তার ক্ষুদ্রতা সীমাবদ্ধতা যেন মর্মে মর্মে অনুভব করে।এতবড় সৌন্দর্য, বিশালতা ধারন করার ক্ষমতা মানুষের নেই। তাই তার মন বিষন্ন হয়ে ওঠে।অনেকের মধ্যে পাগলামীর লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে।
ফুল মুনের সাথেও তাই মানুষের আচরণে, ব্যবহারে নানা অদ্ভুত, অস্বাভাবিকতা, আত্মহত্যা, সহিংসতার যোগসূত্র দেখা যায়।প্রেমিক প্রেমিকাদের কাছে ফুলমুন আসে একটি ভিন্ন আবহ নিয়ে। রোমান্টিসিজম এবং যৌনতার সাথেও ফুল মুন সম্পর্কিত। প্রেমিক প্রেমিকাদের মনে ‘ফুলমুন’ নিয়ে অনেক উচ্ছ্বাস কাজ করে।
ভরা জোছনার রাতে মানুষের মন ভালো হয়ে যায়। মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত শক্তি পাওয়া যায়। সৃষ্টিশীল মানুষ নাকি আরও বেশী করে সৃষ্টিশীল কাজের অনুপেরণা পায়। পূর্র্ণচাঁদের রাতে কবিদের মাথায় কবিতা এসে ভর করে।লেখকদের মনে ঘোর তৈরি হয়। ভাবুকরা ভাবের জগতে হারিয়ে যায়।
কিছু মানুষ তাদের গুপ্ত বাসনা চরিতার্থ করতে উন্মাতাল হয়ে ওঠে।অনেক ঘাতক তার খুনের মোটিভ হিসেবে ভরা পূর্নিমা বা অমাবশ্যার রাতকে বেছে নেয়।আবার পূর্নিমা বা অমাবশ্যার রাতকে কেন্দ্র করেই অশরীরীদের আগমণ ঘটে এমন বহু গল্প প্রচলিত আছে। মানুষের মন ও শরীরের উপর চাঁদের প্রভাব নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক রহস্যময় এবং লোমহর্ষক কাহিনী। নানা দেশে, নানা সমাজে সেইসব গল্পের মাঝে প্রচুর যোগসাজস লক্ষ্য করার মত।এইসব কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গা ঝমঝম করা ভৌতিক সিনেমা, নাটক।লেখা হয়েছে হরর উপন্যাস, গল্প।
আমেরিকার কৃষকরা শরতের পূর্ণ চাঁদকে ‘ফুল হারভেস্ট মুন’ বা ফসলের ফুলমুন বলে থাকে। চন্দ্রালোকিত রাতে তাঁরা ফসলের মাঠে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে পারে।তাই কৃষকদের জন্য এটা খুব কাংখিত আনন্দময় সময়। তারা গান গাইতে গাইতে ফসল কেটে ঘরে তোলে।
চন্দ্রমাসের হিসেব অনুযায়ী প্রতি মাসে একবার এ ফুলমুন থাকে। কিন্তু প্রতি উনিশ বছর পরপর এর ব্যাত্যয় ঘটে। যেমন এই বছর। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে হচ্ছে দুইটি ফুলমুন। প্রথমটি ফুলমুনটি হয়ে গেল অক্টোবরের এক তারিখে। দ্বিতীয়টি হতে যাচ্ছে অক্টোবরের শেষদিন। অথাৎ ৩১ অক্টোবর, হেলোইনের রাতে। একই মাসের এই দ্বিতীয় পূর্ণচাঁদ বা ফুলমুন’কে ডাকা হবে রহস্যময়ী নীল চাঁদ বা ‘ওয়ান্স ইন এ ব্লু মুন’ নামে।
রহস্যময়ী ঐ নীল চাঁদনীরাত আমাদের জন্য কী বার্তা নিয়ে আসছে আমরা এখনও তা জানি না।চন্দ্রকন্যা পৃথিবীবাসীর জন্য পাঠাবে কী কোন শুভাশীষ? ঐ স্বর্ণালীসন্ধ্যায় সোনাঝরা আলো মানুষের শরীরে বুলাবে কী কোন আশির্বাদের পরশ?
নাকি খুব অসময়ে পৃথিবী ছেড়ে, প্রিয়জনদের ছেড়ে চলে যাওয়া অতৃপ্ত আত্মারা ফিরে আসবে তাদের ক্ষোভ, বেদনা, কষ্ট আর পুন্জিভূত অভিমান নিয়ে। কেমন হবে তাদের সাথে আমাদের যোগসূত্রের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি?
নিশ্চয়ই আমরা ভালোবাসা ও সহানুভূতির সাথে সেইসব মৃতদের স্মরণ করব।মোম ও আগরবাতির নরম সুবাসিত আলোতে তাদের অভিবাদন জানাব। সবিনয় অনুরোধ করবো শান্ত, শান্তিময় অন্যভূবনে ফিরে যেতে। বলবো, “তোমরা যারা চলে গেছো, তোমাদের পথ ধরে আমরাও আসবো তোমাদের কাছে।দেখা হবে, অন্যভূবনে। তোমরা ফিরে যাও। তোমরা শান্তিতে ঘুমাও।”
এই মহামারি কবলিত দাহকালের পৃথিবীতে সব মানুষের জন্য ফুলমুনের শুভেচ্ছা ও অজস্র ভালোবাসা জানিয়ে, কান্ট্রি মিউজিকখ্যাত গায়ক আর্ল টমাস কনলি’র বিখ্যাত গানের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও গাইব,
Nine times of ten, she’s right and I am wrong
When I won’t give in she just goes along ……..
Every once in a blue moon
I’ll do something right
Once in a blue moon…!
শেলী জামান খান কবি ও সাহিত্যিক।