(মহীয়সীর কলাম)
#বিবর্ণ বন্দনা#
” দস্তার চেয়েও সস্তা সে যে
বস্তার চেয়েও ভারি
মানুষ হয়েও সঙের পুতুল
বঙ্গদেশের নারী ” ?
– নুরে আলম মুকতা
আমি আমার জন্মের পর থেকে যা দেখেছি সবাই তাই দেখেছে। কম বেশি হতে পারে। কিন্তু দৃশ্যের মঞ্চায়নটি প্রায় একই রকম। আমার মা-বাবার প্রেম ভালোবাসা , জীবন-সংগ্রাম, ভাইবোনদের বড় হয়ে ওঠা আমি দেখেছি। বোনেরা আবেদনময়ী সুশ্রী আর অসম্ভব মেধাবী হওয়া সত্বেও ওদের বিয়ে দেয়ার পেরেশানি আজো আমার হৃদয় ক্ষরণের কারন। একটি বোন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার জন্য এই আমি , রাতের পর রাত কেঁদেছি। আমাদের সমাজ ধরে নিয়েছিলো মনে হয় ওকে দিয়ে সমাজ আর দেশের কাজ আর যাই করানো হোক, অন্তত ঘরের বৌ বানানো যায় না । কিন্তু ওই আবার একজন পুরুষের প্রেমময়ী স্ত্রী হয়ে ওর সন্তান-সন্ততি গর্ভে ধারন করেছে। চাকুরি করছে সফলতার সাথে। স্তন্য দান করেছে। সন্তান লালন-পালন করে স্বামীর সামনে পরম মমতায় খানার প্লেট এগিয়েছে । আমার প্রশ্নটি আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার দিকে আনি। নারী কি শুধুই নারী, মানুষ নয় ? আমি ভাবি। কোন কিনারা করতে পারিনি। মানুষ স্বাভাবিক সুস্থ ধারায় বিকশিত হলে ভাবনার কি থাকে ? আমরা জানি মানব জীবনে জৈবিক বিষয়গুলো অপরিহার্য । কিন্তু দায়বদ্ধতা কেন আসে ? আমাদের দায় সৃষ্টিকর্তা, সমাজ আর রাষ্ট্রের কাছে। মমতাময়ী কন্যার জন্য পিতা দায়গ্রস্ত কেন হবে ? কলম ধরলেই বলে বিষয়টি অনুভুতি প্রবণ। কেন? ভাবনার সাগরে সাঁতার দিয়েছি। সদুত্তর পাইনি। বেশ কিছু লেখা হাতড়িয়েছি। সাময়িক জয়গান ব্যতীত আর কিছু নেই। কিন্তু কেন বিষয়টি অনুভুতি প্রবণ হলো তা আমার বোধগোম্য নয়। এ বিষয়ে বিস্তৃত বিতর্ক ছড়ানো আর ডালপালা গজানোর লোকেরও অভাব নেই। আমি জানি এ লেখাটিরও টুঁটির ওপর বসে কেউ নাচতে পারে। নাচুক। আমরা বলতে থাকি। আমি বলি কথার জবাব কথাতেই সীমিত হোক,লেখার জবাব লেখাতেই থাক। আমার মা আমার বাবার প্রেয়ষী ছিলেন। আমার সন্তানের মা আমার প্রেয়ষী। সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টিতে কোন ভুল নেই। যে মেয়েটির জন্য আমার সন্তান গভীর রাতে ফোন হাতে করে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নেতিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার মেয়েটি যে ছেলের জন্য স্বপ্ন দেখা শুরু করবে কদিনের মধ্যে। তাদের আবেগ আমি কেমন করে , কোন যাদুবিদ্যা দিয়ে প্রশমিত করবো? আমার জানা নেই। গোপনীয়তারও কিছু নেই। রাখ রাখ, ঢাক ঢাকেরও কিছু নেই । সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি সুন্দর। অপ্রতিরোধ্য। বিষয়গুলো প্রশমণ করার উপায় কারো জানা থাকলে উপকার করবেন। একটি বিষয় আমার মাথায় আসে না যে,আমি একটি কন্যার গর্বিত পিতা হওয়া সত্বেও কেন দায়গ্রস্ত হলাম? সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে দায় ছিলো কি? কেউ কি নারী কিংবা পুরুষ ছাড়া প্রজন্ম তৈরী করতে পারবে ? আমাকে একটি পূর্নাঙ্গ জরায়ু আর একটি পূর্নাঙ্গ শুক্রাণু দিন আমি আপনাকে কুর্নিশ করবো। কিন্তু ক্ষমতা নেই কোন মানুষের এ সৃষ্টির ধারে কাছে যাবার। কুহক-মায়া-মন্ত্র সৃষ্টির সেরা বিষয়। এ বিষয়গুলোতে মানব সমাজের কিছু করার আছে বলে আমার মনে হয় না। এখানে আবেগের বিষয়টি আপেক্ষিক। সাম্য ছাড়া বাঁচার পথ নেই। ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। সৃষ্টিকর্তা না করুন যে, আমাদের পৃথিবী থেকে বায়ুর অক্সিজেন, জল আর নারী বিলুপ্ত হয়ে গেলো ! তখন কি অবস্থা হবে ? পৃথিবীর যে সকল স্থানে পুরুষের আধিক্য তাদের অবস্থা ভয়াবহ। ওরা সৃষ্টির প্রতি অন্যায় আচরনের ফল ভোগ করছে। আমরা ভাগ্যবান এজন্য যে, আমাদের এখনো আনুপাতিক হারটি সঠিক রয়েছে। আমি আমার প্রাণপ্রিয় মায়ের প্রদর্শনী চাই না। অশ্রুবিসর্জিত যৌতুক দিতে চাই না। অহর্নিশ যাকে স্বপ্নে লালন করেছি তাকে কোন লজ্জায় যৌতুকের বিনিময়ে বুকে ধারন করি ? চিরকালীন এ লজ্জা আমার পৌরুষত্বে কালিমা লিপ্ত করবে। এটি হয় না। হবার নয়। আমি যখন পড়ি ” দস্তার চেয়েও সস্তা সে যে, বস্তার চেয়েও ভারি, মানুষ হয়েও সঙের পুতুল বঙ্গ দেশের নারী ” তখন আমার হৃদয় ক্ষরণ হয়। হৃদযন্ত্রে কালো দাগ যুক্ত হয় । আমি আমার পরম প্রিয় গর্ভধারিনীর ছবি দেখতে দেখতে অশ্রু বিসর্জন করি। আমার বাবার তালি দেয়া পাঞ্জাবী আর সেলাই করা লুঙ্গী আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। এ বিষয়ে লেখা হোক নতুন নতুন কাব্য ভালোবাসার। মহীয়সী মা বেগম রোকেয়া তোমাকে সালাম। বিশ্বের সকল সংগ্রামী বাবা-মায়ের শরীরের ঘামের বিনিময়ে রচিত হোক অসংখ্য বিনিদ্র রজনীর জয়গাঁথা।
২৩.০৯.২০২০খৃঃ
০৫.১০.১৪২৭ বঃ