Ads

রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তা

ওমর ফারুক

রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে মোটাদাগে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে।রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে তেমন সমালোচনা নেই।যতটুকু আছে সেটা ধোপে টেকে না।এর কারণ তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞ, বিশাল ব্যক্তিত্ব। হালে রবীন্দ্র চর্চা বেড়েছে নানা কারণে। রবীন্দ্রনাথের যুগ জিজ্ঞাসা, ধর্ম, তৎকালীন সমাজ বিনির্মাণে তাঁর সম্পৃক্ততা, জাতীয়তা ইত্তাকার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা -সমালোচনা হচ্ছে।এতে করে রবীন্দ্রনাথ আরও বেশি উদ্ভাসিত হচ্ছেন আপন আলোয়।

রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন ১৮৬১ সালে।সময়ের হিসেবে সেটা ব্রিটিশ যুগ।ব্রিটিশরা তখন এদেশে জেঁকে বসেছে।তাদের বিতারণের জন্য ইতোমধ্যে ১৮৩১ সালে নারিকেল বাড়িয়ার বারাসাতে বিদ্রোহ হয়েছে, ফকির- সন্ন্যাসী বিদ্রোহ হয়েছে, ১৮৫০ সালে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্বেই এসব বিদ্রোহ, আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।ঠাকুর পরিবারের ১৪ তম সন্তান রবীন্দ্রনাথ। বাবা-মায়ের আদরের। বড় ভাই, বোন সবাই সাহিত্য -সংস্কৃতি এবং সমাজ সংস্কার নিয়ে পড়ে থাকতেন।জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়াতে সমাজ নিয়ে কাজ করার সুযোগ ছিলো অফুরন্ত। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাদের নজর ছিলো না।অল্প বয়সে মা মারা যাওয়াতে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার সঠিক দেখভালও হয়নি।

ঠাকুর পরিবারের লোকজন একেশ্বরবাদ চর্চা করতেন। তাদের বাড়িতে নিয়মিত ধর্মসভা হতো, থিয়েটার হতো। তারা ছিলেন পীরালী ব্রাহ্মণ।ঠাকুর পরিবার ব্রিটিশ বিরোধী ছিলেন না।তাদের পরিবারের কেউ বিপ্লবীও ছিলেন না।রাজশক্তির সাথে সমন্বয় করে তারা ভারতবর্ষের উন্নতির স্বপ্ন দেখতেন।এটা এক ধরনের অভিযোগ। এই অভিযোগ অনেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই দলে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মহাত্মা গান্ধী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জগদীশ চন্দ্র বসু, বেগম রোকেয়া প্রমুখ।

রবীন্দ্রনাথ পরিবারের ধারা বজায় রেখেছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ব্রিটিশ যুগে, কলোনির মধ্যে।তাঁর পরিচয় তিনি ভারতীয় কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিক। আর এ পরিচয় নিয়েই ১৯১২ সালে তিনি বিলেত গিয়েছেন।ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবেই ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছে। ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবেই ১৯১৫ সালে নাইট উপাধি পেয়েছেন।আবার ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে জালিওয়ালানাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ জাপান গিয়েছেন, জর্মান গিয়েছেন, ইতালি গিয়েছেন, রাশিয়া গিয়েছেন, আর্জেন্টিনা গিয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে। ইতালির মুসোলিনীর সাথে কথা বলেছেন, তার প্রশংসা করেছেন। আবার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও বলেছেন।

আসলেই কি রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ছিলেন, নাকি ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন? এ প্রশ্নের সমাধান রবীন্দ্রনাথ নিজেই করে গিয়েছেন।আমরা জাতীয়তা বলতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা কিংবা দেশের সীমানাভিত্তিক পরিচয়কেই বুঝি।যেমন ভারতবর্ষের অধিবাসী ভারতীয়, বাংলাদেশের অধিবাসী বাংলাদেশি।কিন্তু ব্রিটিশ যুগে এরকম ধারণা জন্মেনি।আর রবীন্দ্রনাথের নিকট ন্যাশনের ধারণা ব্যাপক এবং বিস্তৃত। আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবী ছিলেন না। তাঁর সমগ্র সাহিত্যে ইংরেজি বিতারণের ছাইটুকুও নেই।তিনি ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি আসক্ত ছিলেন।ইউরোপীয় কৃষ্টি, কালচারের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভক্তি, মোহ ছিলো। তিনি ইংরেজি বিতারণে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ইংরেজের কাছ থেকে ভালো কিছু নেবার পক্ষপাতি ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সীমা নেই।তিনি নিজেকে গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ মূলত আন্তর্জাতিকতাবাদকেই প্রতিনিধিত্ব করে।তিনি ছিলেন বিশ্ব নাগরিক, বিশ্ব মানব।বৃহৎ পরিসরে বলতে গেলে তিনি ছিলেন বিশ্ব পরিব্রাজক। তাঁর বিচরণ সমগ্র বিশ্বব্যাপী। কোনো নির্দিষ্ট মানচিত্র তাঁর জন্য নয়।তবে রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদী ছিলেননা। তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি বিশ্বের সাথে ভারতবর্ষের একটা যোগসূত্রের চেষ্টা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ যখন যুবক তখন ভারতবর্ষে ইংরেজি বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। দেশে নানা বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠেছে। কেউ কেউ প্যারামিলিসিয়া বাহিনী গঠন করে ইংরেজি বিতারণে সচেষ্ট। আবার কেউ গোপন অনুশীলন সমিতি গঠন করে চোরাগুপ্তা হামলা করছে।১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলো, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো। নানা জায়গায় নানা সভাসমাবেশ হলো, রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি এখানেও বিপ্লবীর নয়।অসহযোগ আন্দোলন, বিলেতি পণ্য বর্জন আন্দোলন কোথাও রবীন্দ্রনাথ নেই।রবীন্দ্রনাথ কেন নেই এই প্রশ্ন জাগতেই পারে।তবে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ শক্তি সম্পর্কে সজাগ ছিলেন।বর্হিবিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তিনি ভাবতেন।১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল অবধি ঘটে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে তিনি ছিলেন সজাগ।

রবীন্দ্রনাথ “ন্যাশনালিজমের ” নাম দিয়েছেন “জিওগ্রাফিক্যাল ডেমন। ” তবে তাঁর এ ধারণা প্রথম দিকের নয়।তিনিও সবার মতোই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা লালন করতেন।প্রথমদিকে তাঁর ধারণা ছিলো “নেশন একটি মানস” পদার্থ। কিন্তু পরে তাঁর এ ধারণা পরিবর্তন হয়।পরে তিনি নেশনকে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে দেখেছেন, যা জনগণকে “যান্ত্রিক প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ করে।” রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের উপলব্ধি ছিলো পরিপক্ক। তিনি বলতেন,” ভারতবর্ষে ন্যাশনালিজম খাটবে না।কারণ ইউরোপে শাসক -শোষিতের যে ভেদ ঘটেছিল,সেটা জাতিগত বিভেদ নয়; শ্রেণিগত ভেদ।কিন্তু ভারতবর্ষে ভেদ ধর্ম ও জাতির নামে।রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, ” দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জাতি গঠনের চেষ্টা এসব ভেদবুদ্ধিকে আরো বাড়িয়ে দেবে।”

রবীন্দ্রনাথের এই যে বিশ্ব নিয়ে ভাবনা,ন্যাশনালিজম নিয়ে ব্যাখ্যা এটা অনেকে মনে করেন উত্তর আধুনিকতা।রবীন্দ্রনাথ তাঁর যুগ থেকে, তাঁর সময় থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন।তাঁর নির্দিষ্ট জাতীয়তা নেই।তিনি বিশ্ব নাগরিক।এজন্য তাঁকে ধারণ করা এক জীবনে সম্ভব নয়।কারণ তিনি হলেন ” কবি সার্বভৌম। ”

লেখকঃ কলাম লেখক 

আরও পড়ুন