Ads

শিক্ষক থেকে স্থপতি

 

উৎসর্গ : আমার হাইস্কুল জীবনের সকল স্যারদের চরণে উৎসর্গ করতে চাই ছোট্ট এই লেখাটি।

আমার সৌভাগ্য যে আমরা একদল আনস্মার্ট শিক্ষকদের ছাত্র ছিলাম। আমার স্যারদের কারো এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি ছিলো না কিন্তু, সেই আনস্মার্ট স্যারদের ছায়ায় থেকেও আমরা বৃত্তি পেতাম, বোর্ডে স্ট্যান্ড করতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হতাম। আনস্মার্ট না হলে কেউ মাসের পর মাস বিনা বেতনে ক্লাস নেয়?

আমাদের স্যারেরা আমাদেরকে কেবল ভালোবাসা আর স্নেহমমতা গুলিয়ে শরবত পান করাতেন না, পাশাপাশি পাঠদানও করাতেন। নূর স্যার ইংরেজি পড়াতেন- আমার জীবনের সেরা শিক্ষক হিসেবে আমি যাকে মানি। ক্লাসে ঢুকেই আগে কঠিন সব শব্দগুলোর অর্থ বোর্ডে লিখে দিতেন। এমনভাবে বুঝাতেন মনের গভীরে গেঁথে যেতো। স্যার লিখতেন খুব ধীরে, একটু বাঁকা করে অনেকটা ইটালিক ফন্টের মতো। আমরা মনে করতাম আমার স্যার তো আনস্মার্ট দ্রুত লিখতে পারেন না। আসলে আমার স্যার প্রয়োজনের চেয়েও বেশি স্মার্ট ছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে লিখতেন যাতে করে ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে একসাথে নোট নেয়া শেষ করতে পারে, কেউ যেনো পেছনে পরে না যায়। ক্লাসের কেউ, কারও জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। সবাই একসাথে নোট নেয়া শেষ করতাম। সাম্যের কী সুন্দর দৃষ্টান্ত! স্যারের কোনো পড়া কোনোদিনই বাড়িতে করতে হয়নি – ক্লাসই যথেষ্ট ছিলো অন্তঃত আমার জন্য। বিদেশে এসেও ইংরেজির উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছি, নিজে শিক্ষকতা করেছি কিন্তু, স্যারের শিক্ষা দেয়া সেই বৃত্ত এখনও ছুঁতে পারিনি, কোনোদিন পারবও না।

বাজারের দোকান সরিয়ে নিয়ে টিনশেডের দুই রুমের একটি দালানে স্কুল। মেঝেতে বিশাল বিশাল গর্ত, গর্তগুলো এতটাই বড় যে ফুটবল গড়িয়ে দিলে গর্তে ঢুকে বসে থাকতো। মাঝখানে কোনো পার্টিশন নেই। বাঁশের খুঁটির সাথে চাটাই বেঁধে আমরা ক্লাসরুম আলাদা করতাম। পরীক্ষার সময় আসলে সেই বাঁশের খুঁটি স্যারেরা নিজের হাতে তুলে আবার হলরুম বানাতেন পরীক্ষার জন্য। সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন আমাদের মুজিব চাচা – স্কুলের ঘন্টা, স্যারদের দেখভাল করা সবকিছু উনি একা সামলাতেন। কমনরুমে বসার জন্য কাঠের শক্ত চেয়ারও পর্যাপ্ত ছিলো না। দুপুরে লাঞ্চের জন্য এক কাপ চা আর একটি সিঙ্গারা নাহয় আধুলি সাইজের একটি কেকও নিয়মিত জোটতো না স্যারদের কপালে। এরপরও সারাদিন হাসিমুখে ক্লাস নিতেন – কতটা আনস্মার্ট ছিলেন!

সারাদিন ছাত্র পড়িয়ে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা খেয়ে তো পেট ভরবে না। একটু হলেও খাবার তো চাই পেটে, সংসার ও আছে না? বেতন তো আর মিলে না, পেটে কী দিবেন? ছাত্রদের সালাম খেয়ে পেট ভরবে? আমার সেই আনস্মার্ট স্যার ভোরবেলা উঠে আগে ধানক্ষেতে কাজে যেতেন তারপর আবার সময়ের আগেই স্কুলে এসে হাজির হতেন খেয়ে নাখেয়ে। সময়ানুবর্তীতা আর শৃঙ্খলাবোধের এক জ্যান্ত উদাহরণ ছিলেন। জীবনে একদিনও দেরী করে আসেননি; না ক্লাসে, না স্কুলে। আমরা কেউই স্যারের কাছ থেকে কোনদিন ধমক খাইনি, একবারও গলার আওয়াজ বাড়তে দেখিনি। স্যার স্কুলে আছেন – এটিই যথেষ্ট, পুরো স্কুল শান্ত। কোনো বিশৃঙ্খলা নেই।

আমরা স্যারদেরকে ভয় পেতাম না, তবে শ্রদ্ধা করতাম। আমি বাইসাইকেল চালাতাম। দূর থেকে যখন দেখতাম কোনো স্যার আছেন রাস্তায়, সাইকেল থেকে নেমে যেতাম। সার পাস করে দূরে চলে গেলে আবার সাইকেলে চড়তাম। নূর স্যার ছিলেন আমাদের ক্লাস টিচার। রোল কল করতেন আমরা দাঁড়িয়ে বলতাম ‘প্রেজেন্ট স্যার ‘। একদিন আমাকে ডেকে বললেন তুমি বড় বেশি আস্তে বলো, আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। আমি কেবল তোমার নড়াচড়া টের পাই। আরেকটু জোরে বলবে।

আমাদের স্যারেরা এতটাই আনস্মার্ট ছিলেন – একেতো বেতন পান না তারউপর আবার এক্সট্রা ক্লাস। এইটের বৃত্তি পরীক্ষার্থী, মেট্রিক পরীক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি ক্লাস নিতেন সম্পূর্ণ বিনা টাকায়। শুধু কি তাই? রাতে বাড়িতে বাড়িতে চক্কর লাগাতেন পড়ার আওয়াজ আসছে নাকি আড্ডা চলছে। নিজেদের পেটে নাই খাবার এরপরও আমাদের জন্য বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। আমরা খেলাধুলার পাশাপাশি আবৃত্তি করতাম, বিতর্ক করতাম, সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা হতো, গানবাজনাও করতাম। যেমন খুশি তেমন সাজতাম আরও কত কী ছিলো! একটি মানসম্পন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতা পরিবেশন করার জন্য রাত দিন পরিশ্রম করে স্ক্রিপ্ট তৈরী করতেন, রিহার্সেল দেয়াতেন। আমরা শুধু শুকনো মুখে সালাম দিতাম আর স্যারেরা সেই সালাম খেয়েই আমাদের পেছনে লেগে থাকতেন সারা বছর, বিনা বতনে। বড্ড বেশি আনস্মার্ট না হলে ছাত্রদের পেছনে এভাবে কেউ নিজেদেরকে পুরোপুরি বিলিয়ে দেয়?

আমার সেই আনস্মার্ট স্যার বিয়ের দিন বরযাত্রীর গাড়ি থামিয়ে, বিয়ের শেরোয়ানি পরা অবস্থায় গাড়ি থেকে নেমে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ‘মনে কষ্ট পেয়ো না, আমি তোমাকে একা করে বরযাত্রী নিতে পারি না, আমার অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরা মনে কষ্ট পাবে। একারণে তোমাকে বলিনি আর সবাইকে নিয়ে যাওয়াও অসম্ভব।” আমি আনন্দে মাথা নীচু করে মনেমনে বললাম, ‘আপনি কি চাচ্ছেন এই রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করি আর কেঁদে বন্যা ভাসিয়ে দেই?” কতটা ভালোবাসা অন্তরে লালন করলে বিয়ের বর গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে ছাত্রকে কাতর স্বরে কৈফিয়ৎ দেন! এরকম আনস্মার্ট শিক্ষকদের ভালোবাসা পাবার সৌভাগ্য আমাদের ছিলো।

সেইসব স্যারদের জীবনে এখন পরন্তু বিকেল। ওনারা ক্লান্ত, শ্রান্ত। এখনও আমাদের মাথার উপর তাদের ভালোবাসার হাত আর আদ্র চোখে আবেগের স্ফুলিঙ্গ। আপনাদরকে সম্মান দেখানোর কোনো যোগ্যতাই আমার নেই। তবে যদি প্রশ্ন করেন, কতটা ভালোবাসি?

তার উত্তরে বলবো- যদি সম্ভব হতো, যদি বাস্তবতা সুযোগ দিতো তাহ‌লে আপনাদের দুই পা জড়িয়ে ধরে বলতাম দয়া করে আমার সন্তানকে পড়ানোর দায়িত্ব নিন। আপনাদের মতো এত স্মার্ট শিক্ষক এই পৃথিবীতে আর কোথাও পাবো না যাদের কাছে নিশ্চিন্তে নিজের সন্তানকে সমর্পন করতে পারি।

আপনাদের কাছে দোয়া চাওয়াও বেয়াদবি। আমরা না চাইলেও আপনাদের দোয়া আমাদের সাথে আছে। আপনাদের চাহনি, গলার স্বর সবকিছুতেই দোয়া আর ভালোবাসা উপচে পরে, আমি সেটা টের পাই।

লেখকঃ মনসুর আলম, এ্যাডমিন মহীয়সী প্যানেল,কবি ও সাহিত্যিক।
সাউথ আফ্রিকা।

আরও পড়ুন