Ads

হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে নজরুল

হাসান ওয়াহিদ

নজরুল ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালি। তাঁর অশ্রান্ত পদচিহ্ন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অগণিত জনপদে লেগে আছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যিনি হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান তারুণ্যের উদভ্রান্ত প্রতীক। মানবতার স্বপক্ষে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে তাঁর জীবনপরিধি বারেবারে বন্ধন মোচন করে উজ্জীবিত থেকেছে। পরিকল্পিত যাপনরীতি তাঁর সাংসারিকতায় কোনও নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। বিদ্রোহী, প্রতিবাদী, সুন্দরের উপাসক এই স্বভাবতরুণ কখনও ছকবাঁধা বিবেচনাশীল জীবনকে বরণ করেননি। তাঁর একহাতে ছিল মোহনবাঁশি, আর একহাতে রণতূর্য। তাঁর জীবিতকালে যতটা সসয় তিনি সুস্থ ছিলেন, ততদিন জনাদরে, উন্মাদনায়, গানে, ভাষণে, লেখনে ও আড্ডায় ছিলেন সমকালীনদের মধ্যমণি আর প্রেরণার উৎসমূল। এমন সোনার মানু্ষ দুশ্চিকিৎসা, নিরাময়হীন এক অনির্ণীত ব্যাধি মধ্যজীবনে আকস্মিকভাবে এসে নজরুলকে করে দিয়েছিল বোধহীন, বাক্যহীন, অসহায় আর পরনির্ভর। জীবনের প্রথম চল্লিশ-একচল্লিশ বছরে তিনি নানা ধরনের জীবিকায় জড়িয়েছিলেন নিজেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ, ফিরে এসে অগণিত গান,কবিতা,বজ্রগর্ভ গদ্য রচনা করেছেন।নাট্যমঞ্চ-ফিল্ম-রেডিও-রেকর্ডের গণজ্ঞাপনে অধিনায়কত্ব করেছেন। প্রেম, বন্ধুসঙ্গ,আপনজনের অকৃতজ্ঞতা,পত্র-পত্রিকার শত্রুতা সবই তাঁর কপালে জুটেছিল। তাঁর অভিভাবকরা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, দুখনগরই হবে তাঁর খাসতালুক,তাইতো দুখু মিয়া নাম রেখেছিলেন।
একচল্লিশ বছর পর্যন্ত সুখে দুখে, কর্মে ও উত্তেজনায় উদ্দাম ও আপসহীন প্রাণের দুন্ধভি বাজিয়ে হঠাৎ ১৯৪১ সালে হয়ে পড়লেন জড়বুদ্ধি, প্রায়োন্মাদ ও নির্বাক। সে সময়ে বাংলার রাজনীতিবিদরা তাঁর সাথে করেছিলেন বিশ্বাসঘাতকতা। এই তালিকায় বাংলার বাঘখ্যাত এক নেতার নামও জ্বলজ্বল করছে। অন্যের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসার মানু্ষ এজগতে বিরল। এক্ষেত্রে নজরুল অনন্য দৃষ্টান্তের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেলে নজরুল অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে একটি প্রাণস্পর্শী কবিতা লেখেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে তাঁর দরাজকন্ঠে আবৃত্তি করেন।
নজরুলের মতো এমন অতিপ্রজ ও বিচিত্রধর্মী প্রতিভা কারও ছিল না। যদি তাঁকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের সুযোগ দেয়া যেত তবে তাঁর সৃষ্টিশীল লেখায় বাংলা ভাষা আরও সমৃদ্ধ হতো। স্বদেশবাসীর প্রতি অন্যায়, অবিচার তাঁকে বিচলিত করেছিল। অন্যদের মতো তিনি ব্রিটিশের সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিভৃতে সাহিত্যচর্চায় মত্ত থাকেননি।
নজরুলের মতো একজন বিচিত্র উদাসী রাজভিখারির জীবনী সঠিকভাবে রচিত হয়নি। তাঁর জীবনীতে প্রচুর মিথ্যা আর অসত্য তথ্যের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে কতিপয় স্বার্থান্বেষীর প্ররোচনায়। অসহায় কপর্দক শূন্য প্রতারিত নজরুলের শেষ জীবন কতটা বঙ্গীয় নেতাদের কূটনীতি, ধর্মচারীদের রক্তচক্ষু ও রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রেরর ট্রাজিক অন্তর্ঘাতে বেদনার্ত ও ভাগ্যাহত।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মজ্জাগত রবীন্দ্র উৎসাহে নজরুল ওদেশে হতমান ও অব্যবহৃত হয়ে রয়ে গিয়েছেন। এমন কী ওদেশে শুদ্ধভাবে নজরুল সঙ্গীত শেখানোরও সুসমঞ্জস আয়োজন নেই। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্র রচনাবলীর মতো নজরুলের গ্রন্থাদি সহজলভ্য নয়। উচ্চশিক্ষায় বিশেষত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে ওদেশে নজরুলের স্থান নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে কিছুটা থাকলেও তার মধ্যে অনাদর আর অবহেলার পরিমাণ অনেক বেশি।
নজরুলকে নিয়ে লিখতে গেলে প্রাণ কাঁদে। হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে যে-কজন দীপ্র প্রতিভার বঙ্গসন্তানকে আমরা বেদনার্ত রক্তিম অভিবাদনে বিদায় দিয়েছি, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে মুখর ও প্রখর ব্যক্তিত্ব ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
লেখকঃ সাহিত্যিক ও  কলাম লেখক
আরও পড়ুন