বইঃ একা
লেখক : মৌলী আখন্দ
প্রকাশক : ভূমিপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : তিনশত টাকা মাত্র।
এই উপন্যাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে যেটা আমার মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন নিয়ে অনবদ্য বর্ণনা।
“প্রেগন্যান্সির সময়ে মেয়েদের শরীরে প্রোজেস্টেরন অনেক বেশি থাকে। ডেলিভারির পরে সেটা হঠাৎ করে কমে যায়। সেই জন্য কিছু সমস্যা হয়। কেউ কেউ অকারণ উগ্র আচরণ করে। নিজের বাচ্চাকেও সহ্য করতে পারে না কেউ কেউ।”
আজকাল আমাদের প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে কম বেশি এইধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে। মানুষ দেখেও দেখে না, বুঝেও বুঝতে চায় না। কিন্তু এটা যে কতটা ভয়াবহ আর কতটা বাস্তব তা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোই কেবল উপলব্ধি করতে পারে হৃদয় দিয়ে, জীবন দিয়ে।
কিছু কিছু উক্তি তো পুরোপুরি মিলে যায় আমাদের আশেপাশের অনেকগুলো জীবনের সাথে।
“আমাকে এসব ঢংয়ের কথা বলিস না।
আমার কি বাচ্চা হয় নি?”
“না,এমন মা আর দেখিনি!
কোনদিন বাচ্চার জন্য একটু মায়া লাগে না?
কেন পেটে ধরেছিলি?”
“তুমি ট্যাক্টফুললি সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করা শেখোনি।
মানিয়ে চলা শেখোনি।
যেটা মেয়েদের শিখতে হয়।”
এই উপন্যাসের একটা গল্পকেও মনে হবে না যে এটা কাল্পনিক। সব ঘটনাই আমার, তোমার, তার ঘটনা। দেখার মতো চোখ, লেখার মতো হাত, বুঝার মতো মন না থাকলে প্রথম উপন্যাস হিসেবে এত গ্রহণযোগ্য লেখা উপহার দিতে পারতেন না লেখক।
করোনার এই দুর্দিনে বহুদিন কিছু পড়তে না পারা পাঠকও এই বই হাতে নিলে রাখতে পারবেন না সহসাই। শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পাবেন না, এমনকি শেষ করেও শান্তি পাবেন না।
পেয়ে হারানোর যে বেদনা, আশা নিরাশার দোলাচলে যে দোদুল্যমানতা, তা উপলব্ধি করতে হলে এই বই পড়াই লাগবে – একবার না বারবার। সব ঘরে ঘরে সব নারী পুরুষ সবার পড়া হলে হয়তো কিছু পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন এর পেশেন্টের পরিবারগুলো সামান্য হলেও সচেতন হবে।
একজন একজন করে হলেও যদি পরিবারের মানুষগুলো সচেতন হয়, তাহলেই ভয়ংকর অসহায় সেই মায়েরা সামান্য হলেও সাপোর্ট পাবে। এই বই পড়ে অন্তত একজন মাকেও যদি কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলেও লেখকের লেখা স্বার্থক। একটা জীবন বাঁচানো, একজন মায়ের জীবন রক্ষার এই গুরুদায়িত্ব চিকিৎসক মৌলী আখন্দ এর পাশাপাশি লেখক মৌলী আখন্দও করে গেলেন যুগ যুগান্তরের জন্য। এ বই তার স্বাক্ষী। আল্লাহ লেখককে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
রূপকথাদের গল্পের অস্তিত্ব যেন আর বাস্তবে না আসে কারো জীবনে। রূপকথার গল্প যেন গল্প হিসেবেই থাকে। মুক্তিদের মতো চরিত্রগুলো যেন সবসময় পাশে থেকে সাহস দিয়ে যেতে পারে তাদেরকে।
“কখনো চলা থামিয়ে দেওয়া চলবে না।
সব বন্ধ ঘরেরই একটা দরজা আছে।
না থাকলে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে।
তাও না থাকলে কেটে জানালা তৈরি করে নিতে হবে।
কিন্তু হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না।”
যে মাটিতে পড়ে মানুষ তার উপর ভর দিয়েই আবার তাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। হিরোইনখোরের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে তৃপ্তিদেরকে তৃপ্ত করতে পারতে হবে। শিক্ষার সুযোগ কেউ স্বেচ্ছায় না দিলে তা তৈরি করে নিয়ে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চেষ্টা করে যেতে হবে।
নিজেকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। কখনো হাল ছাড়তে হয় না। যত ঝড় ঝঞ্জাই আসুক না কেন, আত্মপ্রত্যয় নিয়ে, ন্যায়নীতি নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। নিজের বিবেকের কাছে নিজে পরিষ্কার থেকে কাজ করে যেতে হবে একাগ্রতার সাথে। সাফল্য তখনই ধরা দিবে এসে তার দোরগোড়ায়।
ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে রূপকথার গল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটবে যেটা কারোই কাম্য নয়। একাকীত্বকে দুর্বলতা না ভেবে তাকেই হাতিয়ার বানাতে হবে। স্রষ্টার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলেই কেবলমাত্র এই একাকীত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে তৃপ্তি পাওয়া সম্ভব।
নূরী, রওশন, জরী, রূপকথা আর জয়ী। এই পাঁচ প্রজন্মের বেশ কিছু গল্প মিলিয়ে একা উপন্যাসের পটভূমি। নূরী আর জয়ীর ঘটনা তেমন উল্লেখযোগ্য ভাবে না এলেও ওদের নাম দুটোকেই যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে।
নূর হচ্ছে আলো। আর সেই আলোচ্ছটায় আলোকিত হল রওশন। তার তাতেই জরির মত চিকমিক ঝিকমিক করে ওঠে জরী। জরীর জীবনের এক অধ্যায় রূপকথা যে তাকে রূঢ় বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে তার জীবনে উপহার হিসেবে এনে দেয় জয়ীকে।
আপাতদৃষ্টিতে জয়ের যে জোয়ার আমরা এ উপন্যাসে দেখেছি তার আড়ালে রয়ে গেছে একাকীত্বের এক হাহাকার। যা শুধু চোখে দেখে আর বইয়ে পড়েই বোধগম্য হওয়ার নয়, বরং হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করার।
“হৃদয় ভেঙে যাওয়ার কোন শব্দ হয় না।
হলে সেই শব্দে পৃথিবী বিদীর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা।”
এই গল্পের প্রতিটি চরিত্রই এই একাকীত্বের সাথে প্রতিনিয়ত লড়ছে। একাকীত্ব একেকজন মানুষকে একেকসময় একেকভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নি:শেষ করে ফেলতে চাইলেও সেই একাকীত্বকেই আসলে শক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে মানুষ। এটাই জীবন হওয়া উচিত।
ফিনিক্সের মতো করে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও আবারও নতুন করে জন্ম নেওয়ার মতো মানসিকতাই আসলে মানুষকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। শুধু সুদৃঢ় মনোবল আর কঠোর পরিশ্রমের সাথে লড়ে গেলেই আল্লাহর অপার কৃপায় জয়মুকুট এসে ধরা দেয় জীবনে।
এই উপন্যাস একাকীত্বের মধ্যে থেকেই জয়ী হবার শিক্ষা দেয় নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে। এখানে নারী চরিত্র প্রাধান্য পেলেও মূলত: এটা নারী পুরুষ সবার পড়ার মতো একটা বই। শুধু এই প্রজন্মের পুরুষ নয়, আগের প্রজন্মের পুরুষরাও এই বই পড়লে তাদের নতুন করে বোধ হবার কথা, ‘এভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি!’
বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে।একা উপন্যাসের এটাই উপজীব্য।
জয়নব ফেরদৌসী রুমু,
ঢাকা, বাংলাদেশ।