Ads

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ বাংলাদেশের স্বপ্নচোখ

জুয়েল মল্লিক

বইঃ বাংলাদেশের স্বপ্নচোখ
লেখকঃ রউফুল আলম
প্রকাশনীঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
পাঠকনন্দিত বই ‌‌‍’একটি দেশ যেভাবে দাঁড়ায়’ এর লেখক রউফুল আলম এর দ্বিতীয় বই “বাংলাদেশের স্বপ্নচোখ” ৷ বইটির মাধ্যমে দেশের প্রচলিত শিক্ষা, গবেষণা ও তারুণ্যের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ অত্যন্ত সহজ-সরল এবং ঝরঝরে লেখায় তুলে ধরেছেন ৫২ টি অনুপ্রবন্ধের মাধ্যমে। পঞ্চাশ বছর বয়সী একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বপ্নচোখে মূল ফোকাস কি হওয়া উচিত দিয়েছেন তার নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট রপরেখা ৷ প্রবন্ধগুলো আকারে ছোট কিন্তু চিত্তাকর্ষক এবং মগজের কারফিউ ভাঙার জন্য অত্যাবশ্যক ৷

লেখক তার প্রথম অনু প্রবন্ধটির নাম দিয়েছেন, ‘প্রিয় বঙ্গবন্ধু’ ৷ না তিনি অতি পরিচিত স্তাবকদের মতো কারও অনুগ্রহে লাভের জন্য তাঁকে এড্রেস করেননি ৷ বরং অকপটে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের নিকট বলেছেন তাঁর আক্ষেপের কথা ৷ বলেছেন বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শের নাম ভাঙিয়ে কি নিদারুণ অনিয়ম ও লুটপাটতন্ত্র কায়েম হয়েছে গোটা সমাজ ব্যবস্থায় সে কথা ৷ পরবর্তী অনু প্রবন্ধ ‘সত্যেন্দ্রনাথের দীপ্তি’ ও ‘ওয়াজেদ মিয়া এক অসাধারণ মানুষ’ পড়ে মোহিত হয়েছি ৷ সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষকদের একজন ৷ তাঁর সময়ে দেশে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, গুগল ও দ্রুতগতির টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো না ৷ কিন্তু জ্ঞানই যার ক্ষুধা তাকে রুধে কে ? সত্যেন্দ্রনাথ শতবর্ষ পূর্বে ঢাকায় বসে দুনিয়ায় গবেষণার খবর রাখতেন, চালিয়ে গেছেন নিজের গবেষণাকর্ম ৷ দূরপ্রান্তের এই সত্যেন্দ্রনাথ বোসকে তখন কেইবা চেনে ! আইনস্টাইন তখন সাইন্টিফিক হিরো ৷ বোস তার গবেষণা আর্টিকেলসহ চিঠি লিখলেন আইনস্টাইনকে ৷ একজন জিনিয়াসই আরেকজন জিনিয়াস কে চিনতে পারে ৷ আইনস্টাইন শুধু বোসে’র চিঠির জবাবই দেননি বরং তার গবেষণা আর্টিকেল জার্মানীর খ্যাতনামা জার্নালে অনুবাদ করে ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন ৷ এরপরই তাকে চিনতে শুরু করে ইউরোপের শ্রেষ্ঠতম মেধাবীরা ৷ বোসের সাথে একে একে পরিচয় ঘটে আইনস্টাইন, মারি কুরি, অটো হান, ফ্রিৎজ হাবারসহ অনেকের ৷ তার জ্ঞানের সেই দীপ্তি ঠিকরে পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের সেই আলোর দখল এখন নষ্টদের হাতে ৷ অনুরূপ ক্ষণজন্মাদের আরেকজনের নাম ওয়াজেদ মিয়া ( প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী)।

‘এই দশকটা বাংলাদেশের’ প্রবন্ধে লেখক আমাদের এই দেশটা নিয়ে তার স্বপ্নের কথা বলেছেন কিন্তু সেই স্বপ্নটা কল্পনার নয় বাস্তবতার ৷ কারণ স্বপ্নবাজ তরুণদের একটা বড় অংশ ইউরোপ আমেরিকার নামকরা প্রতিষ্ঠানে নানাবিধ বিষয়ে লেখাপড়া করছে এবং তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের দক্ষ জনশক্তি ৷ তাদের একটা অংশ সেসব দেশে স্থায়ী হলেও নানান প্রতিবন্ধকতা স্বত্তেও একটা বড় অংশ দেশে ফিরবেই ৷ আর এক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় তাহলে তো কথাই নেই ৷ সেই ফিরে আসা মেধাবীদের একটা দৃশ্যমান প্রভাব আমাদের সমাজে পড়বে ৷ অপেক্ষা শুধুই সুবুদ্ধি আর সময়ের ৷

‘দ্বিধান্বিত হওয়ার সাহস’ অনু প্রবন্ধটি মুগ্ধ করবে যেকোন পাঠককে কারণ দ্বিধান্বিত হওয়ার সাহসই মানুষকে নতুন পথ দেখায় ৷ যে সমাজে দ্বিধান্বিত হওয়ার মতো মেধাবী তরুণ নেই সে সমাজ স্রোতহারা নদীর মতো ৷ মহাকাশ গবেষণায় পথিকৃৎদের মাঝে বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী জর্জ লিমেট্টি’র নাম উল্লেখযোগ্য ৷ তিনিই প্রথম বলেছিলেন “বিগ ব্যাং” থিউরির কথা কিন্তু তার এই বক্তব্য আইনস্টাইনের মতামত দ্বারা শুরুতে রিজেক্টড হয়েছিল ৷ কিন্তু তাতে কি বিজ্ঞানে তো কারও পূজা-অর্চনা চলে না চলে মতামতের স্বপক্ষে প্রমাণ ৷ জর্জ লিমেট্টি মহাকাশ গবেষণায় এক দ্বিধান্বিত তরুনের নাম যার দীপ্তি আজও জ্বাজ্জল্যমান ৷

আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি যেখানে অযোগ্যরা মূল্যায়িত হচ্ছে আর যোগ্যরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের নায্য পাওনা থেকে ৷ একটা রাষ্ট্রের প্রোডাক্টিভিটি তথা এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করে মেধাবীদের মূল্যায়নের উপর ৷ ব্যক্তির প্রোডাক্টিভিটির উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্টিভিটি আর প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্টিভিটি এগিয়ে নেয় রাষ্ট্রের নেট প্রোডাক্টিভিটিকে ৷

কিন্তু আফসোস সেই উৎপাদনশীলতাকে ত্বরান্বিত করার মতো যোগ্য মানুষেরা অবমূল্যায়িত হচ্ছে সর্বত্র ৷ এদেশে শিক্ষা-গবেষণায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাব থাকলেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ খরচ করে খিচুরি রান্না শিখতে যাওয়া, শুটকি মাছের উৎপাদন অথবা পুকুর কাটা শেখার নাম করে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ গমনে কখনই অর্থের অভাব হয় না ৷

এছাড়াও বেকার তারুণ্যের দুর্ভোগ, বিশ্বমানের বিদ্যাপীঠ, দ্য ল্যান্ড অব অপারচুনিটি, বিসিএস সর্বোচ্চ দেশে, উদ্ভট চিন্তা উদ্ভট আইডিয়া এবং যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি প্রতিটি অনু প্রবন্ধই আমার চিত্তকে মোহিত করেছে, আমি স্বপ্নাবিষ্ট হয়েছি ৷ লেখকের ন্যায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মানের এমন স্বপ্ন হররোজ দেখে এদেশের কোটি মানুষ ৷ জানিনা সেই সুদিন কবে আসবে, তারপরও আমরা আশা নিয়ে বাঁচি ৷ কারণ স্বপ্নই তো মানুষকে বাঁচতে শেখায় !

পুনশ্চঃ বইটি প্রকাশ করেছে জ্ঞানকোষ প্রকাশনী আর প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী মিস্ত্রী ৷ প্রচ্ছদ অসাধারণ হলেও অসংখ্য বানান ভুল প্রকাশনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রুফ রিডারদের দ্বায়িত্বশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে আমার মনে হয়েছে ৷ আসা রাখি পরবর্তী সংস্করণে তা পরিমার্জিত হবে ৷ সর্বোপরি পাঠকরা কেন পড়বে বইটি এর জবাবে বলতে চাই একটি ভালো বই মানুষকে সময় জ্ঞান ভুলিয়ে দেয়, ‘বাংলাদেশ স্বপ্নচোখ’ সেই সময় জ্ঞান ভুলিয়ে দেয়া বইয়ের নাম সেকারণেই এটা পড়া জরুরি ৷

জুয়েল মল্লিকঃ লেখক ও ব্যাংকার

অন্যান্য বুক রিভিউ-

বুক রিভিউঃ পিতা-পুত্রের চিঠি

বই পর্যালোচনাঃ অর্ধেক নারী অর্ধেক ইশ্বরী

পিতামহ- আরবের প্রাচীন ইতিহাসের কথা বলে

আরও পড়ুন