Ads

বুক রিভিউঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা

আহমদ ছফা একজন সাহসী লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা। জন্ম ৩০জুন ১৯৪৩ সালে, মৃত্যু ২৮জুলাই ২০০১ সাল।

প্রথমেই বলে রাখি, বইটি পড়ার সময় নিজেকে উম্মুক্ত পাঠকের ভূমিকায় রাখবেন। “বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা” অত্যন্ত সাহসী নির্মোহ বিশ্লেষণধর্মী একটি বই। বাংলাদেশের জন্মবৃত্তান্তের সংঘাতময় ইতিহাস ও স্বাধীনতার চুল-ছেঁড়া তথ্য-উপাত্ত নির্ভর বই মনে হয়না কেউ এত খোলাখুলি ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এর আগে। ছোট্ট একটি ভূখণ্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে যে নোংরা গেঁয়ো রাজনীতি আন্তর্জাতিক ময়দানে খেলা হয়েছে তা পড়তে গেলে প্রচণ্ড দুঃখ পেতে হয়।

স্বার্থ হাসিলের জন্য দলাদলি আমাদের দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মোটেও কম হয়নি, বরং যে মানুষগুলোর নাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত, যাদের নিয়ে চিন্তাশক্তি ভাবনার রাজ্যে বিভোর থাকে, সে সব মানুষের কার্যক্রম শুনলে মাথা চরমভাবে উতরে যায়।

আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা নিয়ে লেখক প্রায়ই ব্যঙ্গ করেছেন, কিন্তু ব্যঙ্গের সেই হাসিটা তো শেষ পর্যন্ত আমাদের গায়েই এসে পড়েছে। কী অসামান্য মনোবেদনা নিয়ে তিনি এই বিশ্লেষণটি করতে বসেছেন, তা শুধু কল্পনাই করা যায়। স্বাধীনতা কোন রাজনৈতিক দলের একার অর্জন নয় মোটেও, বরং ছাত্র, কৃষক, শিক্ষাবিদ,বিভিন্ন পেশার মানুষ এবং সর্বশেষ অসংখ্য মা-বোনের সভ্রমহানি, সতীত্ব হারানো হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দেয়া অশ্রুসিক্ত নয়ন ইত্যাদি ইতিহাসের পাতাকে প্রলুব্ধ করেছে, যার ফলেই স্বাধীন বাংলাদেশ কিন্তু এই মাতৃভূমি নিয়ে নোংরা রাজনীতির নামে আত্নকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনা, ভোগ-বিলাসিতায় আমরা স্বাধীনতাকে অনেকটাই কলঙ্কিত করেছি যা লেখনিতে বার বার ফুটে উঠেছে। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ধুয়ো তোলা হয়েছিলো, তা শুধু কথাতেই রয়ে গেছে, কখনো বাস্তবায়িত হয়নি।।

পঞ্চাশের দশক থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছিল। কিন্তু তখন দশটির এই ন্যায্য দাবিকে অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমর্থন করেনি, বরং ন্যাপকে ‘ভারতের চর’, ‘নেহেরু আ্যডেড পার্টি’ এবং ‘ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু’ বলে গালাগাল দিয়েছে। ন্যাপ যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানাচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগের নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব গর্বভরে বলছেন, ‘শতকরা আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে’।

আরও পড়ুনঃ বই পর্যালোচনাঃ অর্ধেক নারী অর্ধেক ইশ্বরী

ষাটের দশকে এই পরিস্থিতি পালটে গেল। এদেশের বামপন্থী দলগুলো চীন-রাশিয়ার প্রেসক্রিপশনে রাজনীতি করে৷ মস্কোপন্থিরা তাদের মক্কা রাশিয়ায় ঘুরে আসে, চীনপন্থিরা নিজেদের কিবলা পিকিংয়ে সফরে যেতো। তাই ভারতকে ঠেকাতে আইয়ুব চীনমুখী হলে, চীনপন্থিরা ভাবলো আইয়ুবের ঘাড়ে ভর করে সমাজতন্ত্র কায়েম করে ফেলবে। মস্কোপন্থিরা অবশ্য বিপদে পড়লো। যারা আইয়ুবের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারতো, তাদের বিভক্তির সুযোগ আইয়ুব নিলেন। এ প্রসঙ্গে ছফা আফসোস করে লিখেছেন, ‘অঞ্চল-বহির্ভূত রাজনৈতিক অন্ধ-আনুগত্যের এমন বেদনাদায়ক নজির বোধ করি দুনিয়ার ইতিহাস সন্ধান করলেও অধিক পাওয়া যাবে না।’

একাত্তরে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নিজ দেশেই নানা বিপদে পর্যদুস্ত। ভারতের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে থামিয়ে দেওয়া গেল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ছফা লিখেছেন, ‘কংগ্রেসের সুচতুর প্রচারণার দরুণ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ভারতের জনগণ এভাবে বুঝেছেন যে জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্ব মিথ্যা হতে যাচ্ছে, পাকিস্তান ভাঙ্গন আসন্ন হয়ে উঠেছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশি জনগণ যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে তা মূলত কংগ্রেসের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অসমাপ্ত পর্যায়।’

ছফা মনে করেন, ভারত পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাঙতে চায়নি। কেননা ভারতের মতো বহুভাষী এবং বহুজাতিক রাষ্ট্রের নাকের ডগায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে একটি নয়া রাষ্ট্রের পত্তন হোক তা ভারতের কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে ভারতের কোনো কোনো অঙ্গরাজ্য উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে বলে ভয় ছিল ভারতের। আহমদ ছফার সাথে একমত পোষণ করে খানিকটা দ্বিমত জানাব। ভারতের চরম শত্রু পাকিস্তানকে ভাঙার এমন সুযোগ ভারত কেন হারাতে চাইবে? অবিভক্ত পাকিস্তানের চাইতে বিভক্ত পাকিস্তানকে মোকাবিলা অনেকবেশি সহজ নয় কি? দ্বিতীয়ত, ষাটের দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের স্বাধীনতাকামীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতো পাকিস্তান – এমন একটি অভিযোগ ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ তা করবে না বলেই ধরা যায়। সেদিক থেকে দেখলে পাকিস্তানকে দুর্বল করার বদলে ভেঙে দেওয়াই বেশি যৌক্তিক নয়?

ভারত রাজনৈতিক মীমাংসা চাইলেও বাংলাদেশের তা মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ ততদিনে বাঙালির একটাই লক্ষ্যে দৃঢ়বদ্ধ হয়েছিল তা হলো স্বাধীনতা। তাই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভেবেছিলেন ভারত শুরুতেই সামরিক হামলার মাধ্যমে দেশ মুক্ত করে দেবে এমন ভ্রান্তি ঘুচলে লাগলো। কেননা, ‘কার যুদ্ধ কে করে? মুসলমান কিংবা কমিউনিস্ট সকলকেই নিজের লড়াই নিজেকে করতে হয়। ‘

ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। পরিস্থিতি নাজুক। ছফা লিখেছেন, ‘এই সময় পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে এলেন। তাঁর বড় বড় হুঙ্কার দেওয়া ছাড়া করার কিছুই ছিল না।’ শেখের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে তৎক্ষনাৎ কোনো লেখক, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করেনি। নামেনি রাজপথে। ছফা এই কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করতে পারেননি। তাই লিখেছেন, ‘আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ইতিহাস এ নিয়ে একদিন প্রশ্ন উত্থাপন করবে এবং পরবর্তী বংশধর সকলকে সমানভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করবে। ‘ আহমদ ছফা শতভাগ সত্য বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দায় জাতি হিসেবে আমরা এড়াতে পারি না।

আমার মনে হয়, সত্যান্বেষী ও স্বচ্ছস্বপ্নময়ী, সাহসী -সংগ্রামী, বিশ্লেষণধর্মী, সত্য-প্রকাশে অমোঘ এমন একটি প্রজন্মের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য। আহমদ ছফা কে অসংখ্য ধন্যবাদ পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্য এমন একটি প্রামাণ্য দলিল রেখে যাবার জন্য।

এক নজরে বই পরিচিতি

বইয়ের নাম: বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা  
লেখক: আহমদ ছফা
মুদ্রিত মূল্য: ১৫০
প্রকাশকাল: মে ১৯৭৭

প্রকাশনঃ খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি
মোট পৃষ্ঠা: ৫৫

লেখকঃ মোঃ হাফিজুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন