Ads

শৈশব

আশরাফ আল দীন

আজকাল শিশুরা পিঞ্জরার ভেতর বড় হচ্ছে দেখে আমার মনে পড়ে যায়
আমাদের শৈশবের পোষা ময়নাটির কথা!

বড় যত্ন করে দেয়া হয় খাবার আর পানি,
পিঞ্জরের এদিক থেকে সেদিক নেচে বেড়ায় সে, বাটিতে রাখা পানিতে পাখা ঝাপটে গোসল সেরে
কি আনন্দ তার!
হায় রে! পাখির গোসল!
অথচ পাখিটার ওড়ার কোনো আকাশ নেই,
দোল খাওয়ার তরু-শাখা নেই;
খালে-বিলে ইচ্ছে মতো নাইবার সুযোগ নেই!
পাখিদের বাসা বানানোর তার কোন তাগিদ নেই,
উপায়ও নেই,
কারণ, কেউ তো তাকে শেখায় নি
খড়কুটো কীভাবে জোগাড় করতে হয়,
কীভাবে কাক আর ঈগলের কুদৃষ্টি এড়িয়ে
বেড়ে উঠতে হয়!

আমাদের সেই পোষা পাখিটির মতো
শিশুরাও আজকাল বড় যত্নে বড় হয়,
কি গ্রামে কি শহরে।
বাবা-মা যত্ন করে ওদের পায়ে শিকল পরিয়ে রাখে; অদৃশ্য সুতো দিয়ে বেঁধে রাখে পাখাগুলো,
যেন ওরা অনর্থক উড়াউড়ি করে বিপদ না ঘটায়! ওদের শিস দেওয়া আর বোল শেখানোর জন্য,
আর ওদের সুখাদ্য নিশ্চিত করার জন্য
উদয়াস্ত সীমাহীন খাটাখাটনি করেন বাবা-মা;
কিন্তু বড্ড সতর্ক থাকেন
অনর্থক উড়াউড়ি যেন না করে!

ওদিকে যে ছয় ছয়টা ঋতুর এসে চলে যায়
ওদের দরজার সামনে দিয়ে
তা ওরা এতটুকুও টের পায় না,
খানিক সর্দি কাশি ছাড়া।

কি ধরনের শাখায় জাম্বুরা ফল দোলে
ওরা দেখে নি কখনো;
জাম্বুরা দিয়ে যে ফুটবল খেলা যায়
তা’ও আবার কাদাপানি আর ঘাসে ভরা মাঠে,
ওরা এসব জানেওনা, শোনেওনি কখনো!
আমাদের মুখে সেই গল্প শুনলে
ওরা আজব কথা শোনার মতো অবাক চোখে তাকায়!

টিপ টিপ বৃষ্টিতে কাদাজলে একাকার হয়ে কিক দিতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যাওয়াতে কি যে আনন্দ
তা ওরা বুঝবে কিভাবে, ভাবি!
শীতের ভোরে ঘাসের কুয়াশায় পা ভিজিয়ে
শিউলি ফুল কুড়োতে ওরা কখনো যায়নি,
মালাও গাঁথেনি কখনো;
আম-পাকা গরমের হিম হিম ভোরে
ওদের কেউ জাগিয়ে দিয়ে বলে না,
‘রাতে বাতাস ছিল খুব! আম পড়েছে অনেক।
কুড়োতে যাবি না!’
ঘুম ঘুম চোখে ছেলেমেয়েরা মিলে আম-কুড়ানোর ছুটোছুটিতে কি যে আনন্দ, কিভাবে বুঝাবো ওদের!

বানের পানিতে চারিদিকে সয়লাব হয়ে গেলে,
বাড়ির উঠানেও কলা গাছের ভেলা চড়ার কথা কল্পনা কিভাবে করবে শহুরে শিশুরা!
ওরা তো খড়ের পারা দেখতে কেমন তাও জানে না!
শীতের মিঠে রোদে উঠোনের খড়ের গাদায় কুঠুরি করে ক’জন মিলে গল্প করা;
বাড়ির ধানের গোলার নিচের ফাঁকা জায়গাটাতে
ঘর সাজিয়ে হাঁড়ি-পাতিল খেলা;
রান্নাঘরের পেছনের বাগিচায় চুলো জ্বালিয়ে
ধোঁয়ায় একাকার হয়ে বনভোজনের প্রাণান্ত চেষ্টা;
কোন দিন গরম বেশি পড়ছিল বলে
স্কুল থেকে ফেরার পথে
বহির্ব্বাটীর বড় পুকুরের পাড়ে বই-খাতা রেখে
পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেক্ষণ ডুবসাঁতারের ব্যস্ত থাকার কি যে আনন্দ! কী যে স্বাধীনতা!
আবার,
মুরুব্বিদের চোখ ফাঁকি দেয়ার কি যে উৎকন্ঠা,
একালের ছেলেমেয়েদের কীভাবে বুঝাবো!

এখন বুঝি আমাদের বাবা-মা
অনেক কিছুই দেখেও না দেখার ভান করতেন
আমরা যেন নিজেদের দায়িত্ব নিতে শিখি;
হয়তো তাই, কিছু কিছু ছাড় দিতেন ধীরে ধীরে।

এভাবেই বেড়ে উঠেছিলাম ধীরে ধীরে;
সাঁঝ হতেই পড়ার টেবিলে হারিকেন জ্বালিয়ে বসতে হতো,
পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা হতো,
আর এসবের ফাঁকে
আমাদের শৈশব কোথায় যেন পালিয়ে গেল,
আমাদের তারুণ্যের যৌবনের খরা রোদে।

একালের শিশুরা কখনোই তাদের শৈশব হারাবে না! কারণ,
ওদের তো কোন স্বাধীন শৈশব ছিল না কখনো।

মিরপুর, ঢাকা, সকাল ০২/০৬/২০২০

কবিঃ কবি ও সাহিত্যিক

 

আরও পড়ুন