Ads

সে আমার মা

সেখ আবদুল মান্নান

মসজিদ থেকে ভোরের আজান,
বাঁশ বাগান থেকে প্রভাতি পাখির গান
ভেসে আসতেই ব্যথাতুর নানীর কোল
প্রথম যার বোলে হয়েছিল কলরোল,
সেই শিশু কন্যা আর কেউ নয়, সে আমার মা।

পাঠশালার পড়াশোনার বিলাসিতা ছেড়ে,
ছাগল গরুর দড়ি নিয়েছিল ধরে,
প্রজাপতির পিছনে নিরন্তর ছুটে
কলকল হেসে কাবু হয়নিকো মোটে,
আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত যে, সে আমার মা।

গোধূলির বেওয়ারিশ বৈঁচির বনে,
কোঁচড়ভরে তুলত বৈঁচি আপনমনে।
রজ রসে ভিজে যাওয়া পবিত্র ক্ষণ,
শিহরিত কিশোরীর দামাল যৌবন,
কোনও ফারাক বোঝেনিক যে , সে আমার মা।

মুণ্ডেশ্বরী পেরিয়ে দামোদরের পারে,
ছয় বেহারার কাঁধে পালকিতে চড়ে,
আঁটোসাঁটো আব্রুর কাপড়ে ছেয়ে,
লাজরাঙা বধূ হয়ে আরেক মাটির ঘরে,
এসেছিল একদিন যে মেয়ে, সে আমার মা।

দিনে দিনে আব্বার সোহাগেতে ভেসে,
হয়েছিল প্রেমবতী ভিজে প্রেম রসে।
বাগালি বালিকা হয়ে চাষি বউ
আপন করলে সবে পর রইলনা কেউ।
সংসার সংগ্রামী হলো যে মেয়ে, সে আমার মা।

দু:খের সংসারে ক’রে সুখের লড়াই,
রাতদিন মুখে তার শান্তির বড়াই।
শত কষ্ট বোঝে তার অন্তর্যামী,
দু:খের জোয়ারে ভেসে এসেছিনু আমি।
আমার দুচোখে যে বুনেছিল আশা, সে আমার মা।

আশার আশীষে যত গড়িয়েছিল দিন,
দিনে দিনে বেড়েছিল মাতৃত্বের ঋণ।
অভাব অনটনে অবিচল রণাঙ্গনে,
হয়নি হতোদ্দম হতাশার ঘানি টেনে।
তবুও দৃঢ়তা যার মানেনিকো হার, সে আমার মা।

দিনে দিনে বেড়েছিল আমাদের সংসার,
মুখ বুজে সয়েছিল সব গুরু ভার।
চার বোন আমি মিলে ছাপোষা ঘরে,
জোটেনা নুনভাত দুবেলা পেটপুরে।
ম্লান হেসে সে ক্ষুধা ঢেকে দিত যে, সে আমার মা।

সেদিন নিরুপায়ে ক্ষেতের গম কেটে ঝেড়ে,
সন্ধ্যায় হামান দিস্তায় নিল গুড়ো করে,
তুষ আর ঘুটের জ্বালে গুড়ো সেই ফুটিয়ে,
আমাদের উপোসী পেটের দহন জ্বালা জুড়িয়ে,
হেসেছিল যে তৃপ্তির হাসি, সে আমার মা।

দিন শেষে রাতে জোটা আধসের চালে,
চুলোর হাঁড়িটা মা ভরে দিত জলে।
ভাতে না ভরলে পেট আমানিতে ভ’রে,
সবাইকে খাইয়ে চুপ বসে একা ঘরে,
জল খেয়ে শুধু কাটাত যে রাত, সে আমার মা।

কষ্টের সংসারে চাষের অবলা হেলে দুটো,
সারাদিন খেটে রাতে জোটেনা খড়কুটো,
সকালে তাদের ভুখা পেটে যোগাতে জাবনা,
জোঁকে ভরা জলা থেকে কেটে কচুরিপানা,
তাদের আদর করে খাওয়াত যে, সে আমার মা।

নিজেরা অজ্ঞ হয়েও লেখাপড়া শেখাবে ব’লে,
যথাসময়ে আমায় পাঠিয়েছিল স্কুলে।
জামা প্যান্ট বই খাতার খরচ যোগাতে,
নানা জনের সাহায্য নিয়েছিল হাতে,
সন্তান সুখে যার ছিলনা সংকোচ, সে আমার মা।

লেখাপড়া শিখে যেদিন পেয়েছি চাকরি,
দুচোখে ভরেছে তার ছলছল বারি।
হাড়ভাঙা কষ্ট নিমেষেতে ভুলে,
পাঁশ ফেলে টুথব্রাশ নিয়েছিল তুলে।
এমন মানবী আর কেবা হয়, সে আমার মা।

মাঝে মাঝে ছুটিতে ঘরে এলে পরে,
মাতৃত্বের মহাসুখ তার উছলে পড়ে।
সারা পাড়া ঘুরে কিনে দুটো আন্ডা,
আমাকে খাইয়ে তার প্রাণ হতো ঠান্ডা।
এমন আবেগি আর যে হয়, সে আমার মা।

নুনভাত যতই হোক মাছে ডিমে ভরা,
গিমে আর কলমিতেই খাওয়া হতো সাড়া,
আতিপাতি খুঁজে তাই আনত জোগাড় ক’রে.
আমায় খাওয়ানোর তৃপ্তি চোখে তার পড়ত ঝরে।
এমন সন্তান সুখী হতো যে নারী ,সে আমার মা।

সন্তান থেকে আমায় বানালো তার পিতা,
পিতা-পুত্রী মাঝে উঠল গড়ে অনাবিল মিতা।
মন তার হল শিশু আমি পরিণত,
দায়িত্ব পালনে নিলাম শপথ আর ব্রত।
বেমালুম সুখী তাতে যে হল রমণী, সে আমার মা।

একদিন হলো সে শয্যাশায়ী নিয়তির টানে,
হাজার প্রশ্ন জাগে, এমন কেন হয়, কি তার মানে?
দুদিন রইল বেঘোর মহাঘুম ঘোরে,
হঠাৎ চোখ মেলে বুঝিয়ে দিলে- যাই খোকা ওরে।
কন্যা হয়ে চিরবিদায় নিল যে মেয়ে, সে আমার মা।

 কবিঃ কবি ও সাহিত্যিক, মুুুকুন্দপুর, কোলকাতা।

আরও পড়ুন