–খোশবুর আলী
এদিকে বৈদ্যপুর গ্রামে ঘটলো আরেক হৃদয় বিদারক ঘটনা। পরেরদিন মনা গরু চরাতে যায়নি দেখে সেই আহত ছেলেটির বাবা কাদের মিঞা মনাদের বাড়িতে এসে মনার খোঁজ করে বলল—
কাদের মিঞাঃ মনা কই, অ্যাজ গরু চরাতে যায়নি ক্যান?
মনার মাঃ জানিন্যা ভাই।
কাদের মিঞাঃ জানিন্যা মানে? তুমি বাড়িত থাকেন না? তুমার ভাতার ব্যাটা কুনঢে থাকে তুমি জানেন না?
মনার মাঃ না, মানে। রাতে শুত্যা নিন প্যাড়ছিনু। ওরা বাপ ব্যাটা কুনঢে চল্যা গেলঝে হামাক কিছু বুলেনি।
কাদের মিঞাঃ তাঁর মানে পালায়্যা গেলঝে নাকি? ডাঁড়া অ্যাজি মুল্লেক বিচ্যার দিচ্ছি। বলে হনহন করে চলে গেল।
কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে সারা গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ল মনা আর মনার বাপ রাতে পালিয়ে গেছে। ফলে অনেক মানুষ দেখতে এল মনাদের বাড়িতে। এক একজন এক এক মন্তব্য করতে লাগল। কেউ বলছে শালাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দে। কেউ বলছে শালারা আসোলি বদ অ্যারে এমন সাজা হয়াই উচিৎ। মানুষের চোখ আকাম কর্যাশ শালারা পাল্যালঝে।
কেউ বলল, মনার মায়েক আর ভাই বোন সবেক কাদের মিঞার বাড়িত কাজে লাগ্যায়া দে।
কেউ বলছে- ওরেক বাড়িত থ্যাকা ব্যার কর্যা দিয়্যা, বাড়ি দঘল কর্যা লে।
শুধু মাত্র একটি মানুষ আফসোস করছিল, সে হল দুলাল আলী, সে বলল-
বিচারের নামে একটা পরিবার কিভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হল। আল্লাহ য়্যারে ওপোর ব্যাজার না হইয়া পারেই না।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে একদল যুবক মনাদের বাড়ির মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। সব জিনিস পত্র বাহিরে ছুঁড়ে ফেলল। আর তাদের মধ্যে একজন একটি ম্যাচের কাঠি জ্বেলে আগুন লাগিয়ে দিল মনাদের বাড়ির ঘরের চালে। মুহুর্তের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। মনার মা ও তাঁর ভাই বোনেরা দূরে বসে শুধু কান্নাকাটি করছিল, কেউ তাদের দিকে তাকিয়েও দেখল না।
একেতো খরার দিন সব কিছু শুকনো খটখটে। ছোট্ট কুঁড়ে ঘরটি দাউদাউ করে জ্বলছিল আর সেই যুবকের দল হা হা করে হাসছিল এক পৈশাচিক হাসি।
দুলাল আলী বুঝতে পারলো ঘর পুড়ানোর পরে অরা হইতো অ্যাদের ও ক্ষতি করতে পারে , তাই সে মনার মায়ের নিকট গিয়ে বলল-
তুমরা এক্ষুণি অন্য কোন যাগাত পালাইয়া যাও, নাহিলে তুমারেকো ম্যার্যা ফেলবে ওরা।
মনার মাঃ কুনঢে যাব চাচা? হামার তো যাওয়ার কুনু যাগা নাই।
দুলাল আলীঃ তুমার কইল গাঁইয়ে বুলে কেমন বৈন ছিল।
মনার মাঃ হুঁ।
দুলাল আলীঃ তাহেলে আপাতত তাঁর কাছেই যাও, পরে অন্য কোন ব্যবস্থা হোবে।
উঠ উঠ শিগগির পালাও বলে — জামাকাপড় গুলোকে একটি পোঁটলি বেঁধে নিজেই কাঁধে তুলে নিলেন আর প্রায় জোর করেই তাদের কে কৈল গ্রামের দিকে চললেন।
তাঁরা কাঁদছিল আর বার বার পেছন ফিরে সেই সাধের জ্বলন্ত কুঁড়ে ঘরটিকে শেষ বারের মত দেখছিল, হায় রে নিয়তি।
তাঁরা পালিয়ে যাবার পর যুবকদের মধ্য কেউ একজন বলছিল-
ওরা পাল্যালো কুনঢে রে? ধর ওরেক। ধর্যাছ আগুনেত ফেলা দে।
কিন্তু তাঁরা তাদেরকে কোথাও খুঁজে পেলো না, ঘরটি সম্পুর্ণ পুড়ে শেষ হয়ে যাবার পর তারা যে যার ঘরে ফিরে গেল।
মনার মা তাঁর সন্তানদের নিয়ে কোইল গ্রামে তাঁর খালাতো বোনের বাটিতে গিয়ে উঠল। খালাতো বনের অবস্থাও খুব ভাল না। তাঁর পরও এই বিপদের দিন বোন তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
সকাল থেকে তাদের কিছু খাওয়া হইনি দেখে হাড়ির তলায় থাকা কিছু পান্তা ভাত পড়েছিল নিজেদের খাওয়ার পর, বাঁকি ভাত তাঁরা তাদের গরুকে খাওয়ায়। সেই উচ্ছিষ্ট ভাত টুকু তাদের তিন মা ছেলে কে বেঁটে দিলেন।
চোখের পানিতে আর পান্তার পানিতে একাকার হয়ে তাদের হৃদয় মাঝে বয়ে চলছিল ভরা বর্ষার দুরন্ত পদ্মা, কেউ দেখতেও পেলো না সেটি। জীবন বাঁচাতে সেই উচ্ছিষ্ট পান্তাটুকু খেয়েই তাঁরা পেটটাকে সান্তনা দিল।
একটি বেড়ার ঘরে তাঁরা তিন মায়ে ছায়ে রাত কাটাতেন আর দিনের বেলা মনার মা ইয়াসিন হাজীর বাড়িতে কাজ করতেন, কাজ শেষে যে খাবার পেতেন তা বাড়িতে এনে তিন জনে বেঁটে খেতেন। এভাবে কয়েক মাস গত হলে মনার মা তাঁর ছেলেটাকে তাঁর সাথে করে হাজীর সাহেবের বাড়িতে কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া শুরু করল। ইয়াসিন হাজী খুব দয়ালু মানুষ ছিলেন। অনেক জমা জমি তাঁর। অনেক প্যাট কৃষান থাকতো বাড়িতে সেই সাথে অনেক ফকির মিসকিন আসতো তাঁর বাড়িতে একবেলা খাওয়ার জন্য। তাই তাঁর দহলিজে সারাদিন মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকতো। প্রতিদিন ডেগ ভর্তি ডাল-ভাত রান্না হত, আর সেগুলি বাড়ির প্যাট কৃষানের সাথে অনেক মুসাফিরও খেত। সেখানে মনার মায়ের ছেলে-মেয়ে প্রতিদিনিই ভালই খাবার পেতে লাগল ফলে তাদের দিনপথ ভাল ভাবেই কাটতে লাগল। মনার মা তাঁর ছেলে টাকে ছাগল চরাবার কাজে লাগিয়ে দিলেন। আর মেয়েটা তাঁর সাথে সাথেই থাকত।খাবারের কষ্ট লাঘব হয়েছিল বটে কিন্তু তাঁর মন, মনা আর স্বামীর জন্য সারাক্ষণ হাহাকার করত। নিভৃতে নির্জনে দু’নয়নে বইতো একটি খরস্রতা নদী, কিন্তু কেউ দেখত না সেই নদীর বহতা কত কঠিন।
চলবে….
লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক।