Ads

ভ্রমণ কাহিনীঃ লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (পর্ব-০৭)

নুরে আলম মুকতা

পাহাড়টি অন্য  গুলোর মতো কালো পাথরের নয়। উচ্চতা প্রায়  দুই  হাজার একশো ফুট। ওঠা নামা সবার  দ্বারা সম্ভব নয়। ওখানে ওঠার বিষয়ে বোর্ডে  লিখে সতর্ক করার পরেও অনেকে উঠে যাচ্ছে। আমি শুধু আশ্চর্য  নেত্রে দেখেছি সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ , সুন্দরী,সম্পদশালী  নারী মা খাদিজাতুল  কুবরা এই  পাহাড়ে উঠে প্রিয়নবী কে খাদ্য  পৌঁছে  দিয়েছেন! প্রস্তরাকীর্ন পথ, বিরুদ্ধ আবহাওয়া  আর আঁধার তো ছিলই। মহীয়সী র ত্যাগ সারা বিশ্বের  সৃষ্টির জন্য!  এখন পাহাড়টির চারিদিকে  আবাসিক  ভবন বেষ্টন করে ফেলছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যেখানে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন ও গুহাটি খুবই ছোট স্পেশ। তবুও আবেগ প্রবন মানুষ ওখানে প্রবেশ করছে। ওরা বুঝতে চায়না যে আল্লাহর তরফ থেকে বিশেষ ভাবে প্রস্তুত কৃত এবং নির্ধারিত  মানুষটির  জন্যেই এটি তৈরি।

আমাদের  বাড়িটির রোডের  নাম আল হিজরাহ রোড।  মুল রাজপথ ইব্রাহিম খলিলের পাশে এটি দুই লেনের। ওখানে মুল রাজপথ সব চার লেনের।  এই রাস্তা দিয়েই  মহানবী ( সাঃ) কাঁদতে কাঁদতে প্রিয় সহচর  আবু বকর ( রাঃ) নিয়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। এজন্য  আমার গারে সাওয়ার পর্বত  দেখার বাসনা। ধূ ধূ  প্রান্তর। এখানে  লোকজনের ভীড় কম।  ইমারত তৈরী হয়নি। ছোট্ট আয়েশা আর খাদিজা র প্রশংসা করে শেষ করা যাবেনা। কেমন কষ্ট স্বীকার করে এখানে  মহানবী( সাঃ) কে  রসদ পৌঁছে  দিতেন!

আপা হাত ধরে ফেলল। এখানে আর উঠিস না ভাই। পানির জন্যে মারা যাবি। সূর্যের তেজ আর থামা যাচ্ছে না। এত প্রবল  যে শরীরে কোন ঘাম নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ।  বোতলের  পানিও শেষ। ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। শত্রুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য  বন্ধুকে নিয়ে মহানবী (সাঃ) লুকিয়ে ছিলেন তাই পাহাড়টি দূর্গম  আর রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন।

রাস্তায় কিছু কিছু স্থানে খেজুর গাছ চোখে পড়েছে। কিন্তু এগুলো রুক্ষ,সতেজ মনে হয়নি। মক্কা শহরে গাছ-পালা  নেই বললেই চলে। নিম গাছ ছাড়া আফ্রিকান একটি পাতা বহুল গাছ চোখে পড়ছে কিন্তু সংখ্যায় খুব কম।  কবুতর চত্বর আর কিছু স্থানে  ঘাস লাগানোর প্রানান্তকর চেষ্টা দেখেছি। এক দেশী প্রবাসী ভাই বলেছিল, ইয়েমেনের  সাথে সৌদীর যুদ্ধে জড়িয়ে যাবার  পর থেকে এগুলোতে পানির সরবরাহ   একদম কমে গেছে। আগে নিয়মিত পানি দেয়ার জন্য  এগুলো সতেজ ছিলো।

আমরা আসলেই  সোনার দেশের মানুষ।

বায়তুল্লাহ  আসা-যাওয়ার প্রবেশ মুখে রাস্তায় প্রায় দিনই  নজরে পড়ত বিশাল এক লরি  দাঁড়িয়ে। পাশে দীর্ঘ লাইন। বেশির ভাগ মানুষ আফ্রিকান । ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে কোন কাজ করা সম্ভব না। আমরা নৃ-তাত্বিকভাবে  ভাবে খর্বকায়। একদিন পাশে দাঁড়ালাম। এক বিশালদেহী  আমাকে সুন্দর ভাবে জায়গা করে দিল।  ভাবটি এমন যে,বাপু  দাঁড়াও আমি আছি তোমার কোন সমস্যা হবে না। মাত্র দুমিনিটের মধ্যে  সৌদি  রাজের দেয়া প্যাকেট হাতে নিলাম। খুলে দেখি চিকেন ফ্রাই আর ফ্রায়েড রাইশ।  ওলিভ ওয়েল  দিয়ে রান্না। আমাদের  চলবে না। ঘ্রান টাই অন্যরকম। যার সাথে আমরা কোনভাবেই  অভ্যস্ত না।

যোহর আর মাগরিবের পর কমপক্ষে  পাঁচটি গেটে এভাবে পর্যাপ্ত খাদ্য  বিতরন করে ওরা।কিন্তু  বাংলাদেশীরা নিতে পারেনা,খেতেও পারেনা।  তবে খানাটি পিওর।

আমাদের  কাফেলার বাবুর্চি  ভালো রান্না করে। সরবরাহ  চমৎকার। খানার বিষয়ে আমাদের কখনও বিড়ম্বনা  হয়নি।

কারো যদি সমস্যা  হয় তবে বাইরে ইচ্ছে  মতো খেতে পারেন। আমি আর আপা জুস,জমজম পানি আর খেজুর ভক্ষণ  করে কাটিয়ে দিয়েছি দিনের পর দিন। আমাদের  বাড়ীটি হজ্বের মৌসুমে তালিকাভুক্ত  এজন্য বড় ড্রামে করে জমজম পানের জন্য সরবরাহ ছিলো।

কারো যদি সমস্যা  হয় তবে বাইরে ইচ্ছে  মতো খেতে পারেন। আমি আর আপা জুস,জমজম পানি আর খেজুর ভক্ষণ  করে কাটিয়ে দিয়েছি দিনের পর দিন। আমাদের  বাড়ীটি হজ্বের মৌসুমে তালিকাভুক্ত  এজন্য বড় ড্রামে করে জমজম পানের জন্য সরবরাহ ছিলো।

রাস্তায় বেরুলে অনেক মানুষ আর সংস্থা বিভিন্ন রকম খানা হাতে ধরিয়ে দেয় কিন্তু ওগুলোতে  আমরা অভ্যস্ত নই। চকলেট  গুলো এনার্জেটিক  কিন্তু মুখে দিলে মনে হয়  উঠে আসবে। জ্বী গুলিয়ে আসে।  জুস আর পানি টা রেখে আমি আফ্রিকান ভাইবোন দের দিয়ে দিতাম।

একদিন আপাকে বায়তুল্লাহ তে  বসিয়ে আমি ওয়াশরুম গিয়েছি। এসে দেখি আপার সামনে চারটি কলা আর একটি  পাউরুটি  রাখা। আপা  কাবার দিকে মুখ করে সেজদাহ রত। আমি চুপ করে বসে গেলাম। পাশে একজন সুদর্শন  মিশরীয় যুবক ক্লীন সেভড  কাবার দিকে তাকিয়ে অনর্গল মুখস্ত পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত  করেই যাচ্ছে আর দুচোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।  ও কায়রো ভার্সিটির সিনিয়র ছাত্র। হোসনী মোবারককে নিয়ে তখন মিশর টালমাটাল।  চোস্ত ইংরেজি বলে।  আপা উঠে বসলে কলাগুলো সামনে দিলাম। অবাক! এত বড় কলা!  আমরা বিস্মিত।  কোন দেশের,কে দিল জানিনা। রুমে এসে সবাইকে দেখালাম। ভাগ করে তৃপ্ত হলাম।

মাত্র পাঁচ রিয়ালে এক কেজি ফ্রেশ আঙ্গুর।  স্বাদও চমৎকার। এক লিটার কমলা জুস পাঁচ রিয়াল। তবে আর অসুবিধা নাই। প্রায় সব ফলেরই জুস পাওয়া যায়। আপা আপেলের  জুস একদম মুখে দিতে পারত না। পাস্তুরিত  দুধ একদম সস্তা। সরাসরি  অথবা গরম করে খাওয়া যায়।

মাত্র পাঁচ রিয়ালে এক কেজি ফ্রেশ আঙ্গুর।  স্বাদও চমৎকার। এক লিটার কমলা জুস পাঁচ রিয়াল। তবে আর অসুবিধা নাই। প্রায় সব ফলেরই জুস পাওয়া যায়। আপা আপেলের  জুস একদম মুখে দিতে পারত না। পাস্তুরিত  দুধ একদম সস্তা। সরাসরি  অথবা গরম করে খাওয়া যায়।

আমাদের  সকাল বিকাল ভাইবোনের  চা না হলে চলে না।এজন্য  আমরা পর্যাপ্ত টি ব্যাগ,চিনি আর হিটার জগ নিয়ে গিয়েছিলাম। আসলে দরকার ছিল না। ওখানে সবই কিনতে  পারতাম। না জানা থাকলে যা হয়। ঘরকুনো বাঙ্গালী আমরা বেঁধে নিয়ে যাই আবার মাথায় করে নিয়ে আসি!

বাইরে এক কাপ রেড টি দুই রিয়াল। যখন হিসাব করি চুয়াল্লিশ  টাকা,মাথা নষ্ট।

ফল-মুল,শস্য  এগুলোতে ওদের  প্রচুর ভর্তুকি  আছে এজন্য  সুলভ।

মাগরিবের নামাজ পড়ে  কাবা থেকে ফেরার পথে আলমানসী হোটেলের নীচে অপরুপ দুটো শিশু,ভাই-বোন বিশাল চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে রোজ দাঁড়িয়ে দেখতাম। কথা বলার ইচ্ছে  হলো। ওদের কাছে যাওয়া মাত্র,হাজ্জা তী?

আরবীয় রা ট এর উচ্চারন ত করে। ও  কে, আমি বললাম।  ঢাউস সাইজের একটি পাউরুটি আর প্রমান সাইজের  একটি গ্লাসে ভরে দুধ চা দিয়ে দুজনই আনন্দের  হাসি হাসে। আমিও হাসি।  মক্কার রাজপথে  বসে সুদূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে চা  এ চুমুক দিলাম। অদ্ভুত স্বাদ! মায়ের তৈরী, সওয়াবের আশায় হাজীদের  জন্য  উৎসর্গ। ওরা মিশরীয় বংশোদ্ভূত  মক্কার স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের  পাশেই  বাড়ি। ইংরেজি  মিডিয়ামে পড়ে। শিশুদের  সাথে মনের ভাব বিনিময় করে আমি আনন্দিত। ওরা আমাকে বন্ধু  হিসেবে নিয়েছে মনে হলো। মক্কা ত্যাগ করার পর আপা আর আমি ওদের কথা মনে করে হৃদয়ের  ভার বাড়িয়েছি।

আগামীকাল জান্নাতুল মোয়াল্লা আর জ্বীন মসজিদ যাবার কথা আছে।

মা খাদীজাতুল কুবরা ( রাঃ) ! বিস্ময় কর এক মহীয়ষী  নারী! সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ  নারী। সুন্দরী আর সম্পদশালী।  প্রেম ভালোবাসা আর ত্যাগের মহিমায়  ভাস্বর।  ঐশী জৌতিতে কম্পমান মুহাম্মদ (সাঃ) কে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। প্রথম কলেমায়ে তৈয়বা আর শাহদৎ পাঠ করেছেন। বিশ্বের প্রথম ইসলামের  সুবিশাল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিশ্বাসী মানুষ! তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সুবহানাল্লাহি অবি হামদিহি।  আমরা জান্নাতুল মোয়াল্লায় যখন,তীব্র তাপদাহ বইছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।  কবরস্থানটি মক্কা মুল শহরের মধ্যে  পড়ে গিয়েছে।

মা খাদীজাতুল কুবরা ( রাঃ) ! বিস্ময় কর এক মহীয়ষী  নারী! সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ  নারী। সুন্দরী আর সম্পদশালী।  প্রেম ভালোবাসা আর ত্যাগের মহিমায়  ভাস্বর।  ঐশী জৌতিতে কম্পমান মুহাম্মদ (সাঃ) কে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। প্রথম কলেমায়ে তৈয়বা আর শাহদৎ পাঠ করেছেন। বিশ্বের প্রথম ইসলামের  সুবিশাল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিশ্বাসী মানুষ! তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সুবহানাল্লাহি অবি হামদিহি।  আমরা জান্নাতুল মোয়াল্লায় যখন,তীব্র তাপদাহ বইছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।  কবরস্থানটি মক্কা মুল শহরের মধ্যে  পড়ে গিয়েছে।

(চলবে)

আগের পর্ব- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (পর্ব-০৬)

লেখকঃ সাহিত্যিক,শিক্ষক ও সহ-সম্পাদক,মহিয়সী।

আরও পড়ুন