শেলী জামান খান
খাটের উপর আড়াআড়িভাবে উপুর হয়ে পড়ে আছে মেয়েটির নগ্ন শরীর। রক্তাক্ত দেহটি একটি রক্তমাখা সাদা চাদরে আংশিক আবৃত। মেয়েটির উরু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত দৃশ্যমান। দরজা খুলেই রক্ত শীতল করা এই অভাবনীয় দৃশ্য অবলোকন করে হোটেলের ম্যানেজার ও কর্মীদের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তারা খুব দ্রুত টেকনসিটি থানায় খবর দিতেই সদলবলে পুলিশ এসে উপস্থিত হল। দেখা গেল, মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো কোপানোর চিহ্ন। ধারালো অস্ত্রের কোপে ক্ষতবিক্ষত পেট, উরু ও শরীরের নিম্নাংশ। খুনের ধরন দেখেই বোঝা যায়, খুব ঠাণ্ডা মাথায়, সুপরিকল্পিতভাবেই মারা হয়েছে মেয়েটিকে। আঘাতের তীব্রতা দেখে অনুমান করা সহজ খুনের পিছনে কতটা হিংস্রতা কাজ করেছে। মৃতদেহের পাশেই পড়ে রয়েছে একটি রক্তমাখা ভাঙা মদের বোতল। ডাবল বেড খাটের আশেপাশে যত্রতত্র পড়ে আছে মেয়েলি কিছু পোশাক। শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট, পেন্টি, ব্রা।
ড্রেসিং টেবিলের উপর মেয়েদের একটি হাতব্যাগ, চিরুনী, ক্লিপ, লিপিস্টিক, কমপ্যাক পাউডার, পারফিউমের শিশি, আইব্রো এবং আইলাইনার। এসব কিছুই রয়েছে সুবিন্নস্ত করে সাজানো।ড্রেসিংটেবিলের পাশের চেয়ারের উপর পড়ে রয়েছে দুটো সাদা তোয়ালে। ব্যাবহৃত। ছোপ ছোপ রক্তের দাগ সহ, একটি ভেজা অন্যটি আধ ভেজা। সম্ভবত স্নান করার জন্য তোয়ালে দুটো ব্যাবহার করা হয়েছিল। হত্যার পর খুনি বাথরুমে গিয়ে নিজের হাতে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করেছে। শোবার রুম এবং বাথরুমের দেয়ালের নাানা জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
হোটেল রুম এবং ডেডবডি পরীক্ষা শেষ করে রাতের মধ্যেই মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছে পুলিশ। পরে পুলিশ হোটেলের অকুস্থল তিনতলার রুমটির সংলগ্ন করিডোর এবং লবির সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারন করা ফুটেজ খতিয়ে দেখলে দেখা যায় বিকেল চারটে নাগাদ এক যুবক এই রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। হোটেলের ফ্রন্টডেস্কে কর্মরত কর্মচারির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেল, মঙ্গলবার, এইদিনই দুপুর ১টা নাগাদ এই নারী এবং উক্ত যুবক এই হোটেলে আসেন। তাঁরা জানায়, তারা মেদিনীপুর থেকে এসেছে। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস যেমন নিজেদের ভোটার আইডি দেখিয়ে গেস্ট হাউসে চেক-ইন করেন দু’জনে। দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কয়েক ঘন্টা সময়ের জন্য রুমটি বুক করা হয়েছিল। তাদের নামে মোট চৌদ্দশ টাকায় গেস্ট হাউসের ২০১ নাম্বার রুমটি বুক করা হয়।
দুপুর দুটো নাগাদ লাঞ্চের জন্য দু’জনের পরিমাণ চিকেন এবং পরোটা অর্ডার করেন তারা। রুম সার্ভিসের কর্মচারী খাবার দিতে গেলে যুবকটি জানায় তারা সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যাবে। তখন মেয়েটিকে হাসিমুখে ফোন হাতে বিছানায় বসে থাকতে দেখা গেছে।
খাবার পরিবেশনের ঘন্টাখানেক পর তাদের রুম থেকে উচ্চ ভলিউমে টেলিভিশন চলার আওয়াজ শোনা গেলেও কর্মচারীরা অবাক হননি মোটেও। কারণ প্রায় সময়ই গেস্টহাউসের বোর্ডাররা উচ্চ ভলিউমে টিভি চালিয়ে থাকে।
এদিকে রাত আটটা বেজে গেলেও চেকআউটের জন্য ঘর থেকে কেউ না বেরোলে একজন হোটেলকর্মী ২০১ নাম্বারের রুমফোনে তাগাদা দিতে ফোন করেন। বার কয়েক ফোন করলেও কেউ ফোন না তোলায় কর্মীটি নিজেই তাগাদা দিতে রুমের দরজায় আসেন। অসংখ্যবার নক করার পরও কেউ দরজা না খোলায় ব্যাপারটা হোটেল ম্যানেজারকে জানানো হয়।
ম্যানেজার এসে বহু ডাকাডাকি করলেও ঘর থেকে সাড়া মেলে না। অন্যদিকে ঐসময় রুমের ভেতর থেকে ফুল ভলিউমে টিভি চলার আওয়াজও শুনতে পাচ্ছিলেন কর্মীরা। অগত্যা বিকল্প চাবি নিয়েই দরজা খোলেন হোটেল ম্যানেজার। তখনই এই লোমহর্ষক খুনের ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে। গেস্ট হাউসের ম্যানেজার মনে করেন, খুন করার সময় চিৎকার এবং ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ যাতে বাইরে না পৌঁছয়, সেজন্যই টিভির শব্দ বাড়িয়ে দিয়েছিল খুনি।
খুব দ্রুতই ঘটনার তদন্ত শুরু করে নিউটাউন টেকনসিটি থানার পুলিশ। নিউটাউনের ডিডি ব্লকের হোটেলে এক নারীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে, এই খবর শহরে চাউর হতে সময় লাগে না। খুনের ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে শহর জুড়ে। হোটেলের সামনে উৎসুক জনতার জটলা শুরু হয়। খুনের পর সম্ভাব্য পলাতক খুনীর সন্ধানে দ্রুতই নেমে পড়ে পুলিশ। মদের বোতল ভেঙে সেই দিয়েই কোপানো হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ অনুমান করে। মৃতের শরীরের একাধিক জায়গায় গভীর ক্ষতচিহ্ন ও ভাঙ্গা রক্তাক্ত বোতল তারই প্রমাণ বহন করছিল।
মঙ্গলবার রাতেই ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয় খুনের ঘটনার সন্দেহভাজনকে। পুলিশের একটানা জেরার মুখে অভিযুক্ত অমিত ঘোষ স্বিকার করে, সেই খুন করেছে চুমকি ঘোষকে। পুলিশের কাছে বয়ান দিতে গিয়ে সে বর্ণনা করে মেয়েটিকে খুন করার পেছনের কারণ। ফলে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য আসে পুলিশের হাতে। জানা যায়, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরেই ঘটে এই নৃশংস হত্যালীলা। বছর খানেক পরকিয়া প্রেমের পর বিয়ের জন্য অমিতের উপর চাপ সৃষ্টি করার কারণেই খুন হন চুমকি ঘোষ!
অমিতের সঙ্গে সে এত দূরের একটি হোটেলে কেন এসেছিল, তার সঙ্গে চুমকির সম্পর্ক, পরিচয়, খুনের কারণ ও পরিকল্পনা সবই জানা যায় অমিতের বক্তব্য থেকে।
বাইশ বছর বয়সী চুমকি ঘোষ বি এ পাশ। বিবাহিতা। চুমকির শ্বশুড় বাড়ি হল পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে। এই এলাকারই বাসিন্দা তরুণ অমিত ঘোষ। বাসে যাতায়াতের পথে চুমকির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অমিতের। সেখান থেকে ফেসবুকে, ম্যাসেন্জারে কথা চালাচালি করতে করতেই আরও গাঢ় হয়েছিল তাদের ঘনিষ্ঠতা। স্বামী এবং শ্বশুড়বাড়ির সাথে চুমকির সম্পর্ক তেমন সুখকর ছিল না।তাই অমিতকে অবলম্বন করেই সুখ খোঁজার চেষ্টা করেছিল চুমকি।
এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় দেখা সাক্ষাত করে মিলিত হত তারা। এভাবেই গত একবছরে দু’জনের সম্পর্কের গভীরতা আরও বাড়তে থাকে। বেশ চলছিল। কিন্তু কিছুদিন হল তাকে বিয়ের জন্য অমিতের ওপরে চাপ দিচ্ছিল চুমকি। কিন্তু চুমকিকে বিয়ে করা অমিতের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই ক্রমাগত সেই চাপ অমিতের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রচন্ড বিরক্ত এবং ক্ষুদ্ধ অমিত তাই এই অহেতুক গলার কাটা ফেলে দিয়ে তা থেকে রেহাই পেতেই চুমকিকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করতে থাকে। অমিতের সাথে গড়ে ওঠা এই পরকিয়া সম্পর্কই শেষপর্যন্ত কাল হয়েছিল চুমকির জীবনে।
চুমকির স্বামী চন্দন ঘোষ। পেশায় গাড়িচালক।চন্দন ঘোষ পুলিশকে বলেছেন ভিন্ন কথা। তার মতে, একটি বেসরকারি সংস্থায় রিসেপশনিস্টের চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল অমিত চুমকিকে। চন্দন মনে করেন, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে হোটেলে এনে খুন করা হয়েছে তাঁর স্ত্রীকে। চুমকির পরিবারেরও
এমনটাই দাব।
একসময় হোটেলে কাজ করতো অমিত ঘোষ। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তার এক পুরানো বন্ধু যার সঙ্গে বছর খানেক আগে একই হোটেলে কাজ করত তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে অমিত। তাকে ফোন করে জানতে পারে, সে কলকাতা লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনার নিউটাউনের ডিডি ব্লকের একটি হোটেল কাজ করে। অনেক ভেবেচিন্তেই শেষমেষ সে বন্ধুর হোটেলকেই খুনের জায়গা হিসেবে নির্বাচন করে। পরিকল্পনা মতোই চুমকিকে সে জানায় মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর তারা পালিয়ে বিয়ে করবে। বিয়ের প্লান মতই ঘটনায় আট দিন আগে পশ্চিম মেদিনীপুর শ্বশুড়বাড়ি থেকে সাঁতরাগাছিতে নিজের বাপের বাড়িতে চলে আসে চুমকি।
গত ২২ ডিসেম্বর সকালে অমিতের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে বাবার বাড়ি থেকে বেরোয় সে। অমিতের সঙ্গে দেখা করে পূর্ব পরিকল্পনা মতো দুপুর ১টা নাগাদ দু’জনে চলে আসে নিউটাউনের ডিডি ব্লকের এই হোটেলে। পুলিশকে অমিত জানিয়েছে, দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বিয়ে প্রসঙ্গ নিয়ে প্রবল ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয় দুজনের মধ্যে। এমন একটি সুযোগই খুঁজছিল অমিত। প্রচন্ড রাগে পাশেই রাখা মদের বোতল ভেঙ্গে, ভাঙ্গা বোতল দিয়ে চুমকিকে কোপাতে শুরু করে অমিত। মৃত্যু নিশ্চিত করতে চুমকির গলায় মোবাইল ফোনের চার্জারের তার পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে তার। এরপর চুমকির মৃতদেহটি হোটেলের বিছানায় সাদা রঙ্গের ব্যাবহৃত চাদরটি দিয়ে ডেকে দেয়। তারপর স্নান করে শরীর থেকে রক্তের দাগ, খুনের আলামত পরিস্কার করে সে। বিকেল চারটের দিকে খুব ধীরস্থির, স্বাভাবিকভাবেই হোটেল থেকে বেরিয়ে যায় সে। হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে অমিতকে সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল।
তদন্ত করতে এসে পুলিশ খাটের পাশ থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করে। ডায়েরির একটি ছেড়া পাতার এই চিরকুটে লেখা ছিল মাত্র একটি লাইন,
“তোকে মারতে চাইনি। মারতে বাধ্য হলাম!”
( একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। তথ্যসূত্র ভারতীয় পত্রিকা)
লেখকঃ কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, উত্তর আমেরিকা প্রথম আলো।