সাধনা চক্রবর্তী
বুরো ফসল ঘরে তুলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সুবল। এবার ভালো ফলন হয়েছে। সুবল মহাজনের ঋণ মিটিয়ে কদিন আগে ঘরের চালা সারিয়েছে। দুলালী
আর ছ’মাসের মেয়ে ময়নার জন্য শাড়ী জামা নিয়ে এসেছে। ধানের মৌসুমে দুলালী অনেক কষ্ট করে। এখন কিছু দিন বিশ্রাম নেবে সুবল। গোলা ভরা ধান চাল আছে তাই নিশ্চিন্ত ওরা।রাতে খাওয়া শেষে সুবল ময়নাকে কোলে নিয়ে আদর করছে। এমন সময় দুলালী পানের বাটা নিয়ে এসে কাছে বসে। তারপর যত্ন করে এক খিলি পান বানিয়ে স্বামীর মুখে তুলে দেয়।
দুলালী এবার স্বামী কে বলে, “একটা কথা ছিল।”
সুবল হেসে বলে, “এতো সংকোচ না করে বলেই ফেল।”
দুলালী ভরসা পেয়ে বলে, “অনেক দিন বাপের বাড়ি যাই না৷”
সুবল হেসে বলে, “এই কথা? আগামী সপ্তাহেই তোদের নিয়ে যাবো।”
একথা শুনে দুলালীর মনটা খুশীতে ভরে উঠে। মা বাবা ময়নাকে প্রথম দেখে কি খুশী ই না হবেন!
পরদিন সন্ধ্যায় বাজার থেকে ঘরে ফিরে সুবল ।হাত মুখ ধুয়ে ময়নাকে কোলে করে বসেছে। দুলালী চা ও মুড়ি ভাজা নিয়ে এসে ওকে খেতে দেয়।
একটু পরে ঘুরে এসে দুলালী দেখে চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
সুবলের চিন্তান্বিত মুখ দেখে দুলালী বলে, “তোমার কি শরীর খারাপ। কি হয়েছে খুলে বলো দেখি।”
সুবল বলে,”অনেক বড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে বৌ! পরশু দিন ঝড় আমফান তেড়ে আসছে। মরবো না বাঁচবো জানিনা!’
দুলালী চোখ কপালে তুলে বলে, “কি সর্বনাশ! ”
পরদিন সারা গ্রামে আমফানের আগমন বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। পাড়ায় পাড়ায় লোকজন জটলা বেঁধে ঝড় নিয়ে আলাপ করছে। বিপদ থেকে মানুষ রক্ষা পাবে তো!
পরদিন থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে সকাল থেকে। দুপুরের দিকে তুমুল ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টি আর বাতাসের বেগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বৃষ্টি -বাতাসে দাপাদাপি, বিদ্যুতের ঝিলিকের সাথে বিকট শব্দ যেন আকাশ ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে।
বাজ পড়ার শব্দে শরীর শিউরে উঠছে! হঠাৎ এলোপাতাড়ি বাতাসে হুড়মুড় করে গোলা ঘর ভেঙ্গে পড়তেই বৃষ্টির ঝাপটায় ঘর জলমগ্ন হতে লাগলো।
ময়নাকে কোলে নিয়ে দুলালী আর সুবল জড়সড় হয়ে বিছানায় বসে আছে। দীর্ঘ ধ্বংস যজ্ঞ শেষে ঝড়ের তাণ্ডব থেমে এলো।
ভোরের আলো ফুটতেই বাইরে মানুষের সাড়া পেয়ে সুবল এগিয়ে যায়। গৃহহীন মানুষ দল বেঁধে রওয়ানা হয়েছে আশ্রয়ের খোঁজে।
সুবল কাল বিলম্ব না করে একটা চাদরে ময়না কে জড়িয়ে দুলালীর কোলে দেয়। তারপর তিনজনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে হাটতে থাকে দলের সাথে অজানার উদ্দেশ্যে।
গ্রামের বাড়ি ঘর গুলো যেনো দ্বীপের উপর ভাসছে! জলের তোড়ে সন্তর্পনে পা ফেলে হেটে যাচ্ছে সবাই।
হঠাৎ হোঁচট খেয়ে দুলালী পড়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো। সুবল জলে ঝাপিয়ে পড়ে ময়নাকে কোলে তুলে নিলো কিন্তু ততক্ষণে ময়না……!”
সঙ্গীদের সহায়তায় দুলালী ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে ময়নাকে সুবলের কাছ থেকে টেনে নিতেই সুবল চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সন্তান হারা মা বাবার আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস!
চারদিন পর….
গাঁয়ের মানুষ ফিরে এসে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দুলালী তখন একটা ছোট বালিশ বুকে চেপে
চুমু খায় আর খল কল করে হেসে ওঠে। কখনওবা
চিৎকার করে ডাকে ময়না……আ… আ..….আ!
আমফান চলে গেছে। রেখে গেছে তার নৃশংসতার সাক্ষ্য দুলালীর গগন বিদারী আর্তনাদে!
ময়না……আ…..আ…….আ!!
লেখকঃ কবি,সাহিত্যিক ও প্রবাসী বাংলাদেশী, নিউইয়র্ক , ইউএসএ