Ads

ঠিকানা

ঠিকানা…

গত কয়েকদিন ধরে আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। শরীর টা ঠিক মতো কাজ করছে না দেখে ছেলে-মেয়েরা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। শরীরের আর কি দোষ বলুন, এই শরীরের বয়স তো আর কম হলো না। এই শরীর কতো কিছুই না দেখলো এই জীবনে। কত ঘটনার সাক্ষী এই শরীর। কত যন্ত্রনা বয়ে বেড়াচ্ছে শরীরের ভিতরের মন, বছর পর বছর ধরে।

এই দেখেন, আমার পরিচয় টাই এখনো দেওয়া হয়নি। আমি মোঃ আকবর আলী। আমার পিতা – মাতার ছোট সন্তান। ঠিকানা, হুম এই ঠিকানাই বার বার বদলাতে হয়েছে আমাকে। তবে আমার সন্তানেরা বলে ওদের বাড়ি রাজশাহী। আমি এই ঠিকানা কাগজে লিখতাম, কিন্তু মুখে বলতাম না। লিখতাম বলতে আমি তো দীর্ঘ দিন ধরে শয্যাশায়ী তাই অনেক দিন ধরে কিছুই লিখি না।

মুখে বলতাম না মানে বলতে পারতাম না! যখনই বলতে চাইতাম আমি,তখনই আমার কন্ঠ ভারী হয়ে আসতো। ভিতর থেকে একটা বাধা আসতো আর বলতো, ” এই দেশ তোমার না, এই শহর তোমার না। তুমি একজন দেশহারা, বাস্তুহারা রিফিউজি! ” হ্যা আমি দাপ্তরিক ভাষায় রিফিউজি। দেশভাগ ও পরবর্তী রাজনীতির ফলাফল আমি রিফিউজি। নিজের জন্মভূমি কে ভালো করে চিনে উঠার আগেই ছেড়ে আসতে বাধ্য হই আমি। ছেড়ে আসতে হয় আমার জন্মভূমি পাকুরিয়া। ছিমছাম ঝামেলা বিহীন শান্ত জীবন যাপন ছিলো আমাদের।

আমরা পাঁচ ভাই বোন। তিন ভাই দুই বোন আর আব্বা আম্মা, এই নিয়ে আমাদের পরিবার। না, ভুল বলছি আমাদের পরিবার আরও বড়। আমার দাদার ছিলো দশ ছেলে – মেয়ে, পাঁচ ছেলে আর পাঁচ মেয়ে। পাকুরিয়া তে থাকতো আব্বারা দুই ভাই। ফুপুদের বিয়ে হয়ে যায়, তিন ফুপুর শ্বশুর বাড়ি বর্তমান বাংলাদেশে আর দুই ফুপুর শ্বশুর বাড়ি ভারতে। তিন চাচার দুই জন চাকরি করতেন ঢাকায় আর একজন চাকরি করতেন কলকাতায়। বছরে একবার সকলে বাড়িতে আসতো। খুব আনন্দ হতো তখন। সেবছর কেউ বাড়িতে আসলো না। চারিদিকে থমথমে পরিবেশ। দেশ স্বাধীন হবে কিন্তু কোন আনন্দ কারো মধ্যে নেই। আব্বা আর চাচাকে দেখতাম খুব চিন্তিত। আমরা কোন দেশের মধ্য পড়বো, এই নিয়েই চলতো সারাক্ষণ আলোচনা। ভারত না পাকিস্তান?

আমাদের মুরুব্বিরা বলতেন আমরা পাকিস্তানের অংশ হতে পারি কিন্তু উত্তর পাড়ার অমল কাকার বড় ছেলে রুদ্রদীপ দা বলতেন আমাদের এই জেলা ভারতের অংশ হবে। আব্বাকে অবশ্য সবসময় চিন্তিত দেখতাম। আমরা ভারতের অংশ হই বা পাকিস্তানের, আমাদের পরিবার তো এবার ছিন্ন বিছিন্ন হবে। একদিন মেজো চাচা এসে বললেন, উনারা ঢাকায় চলে যাবেন। চাচীর বাবারা অনেক আগেয় ঢাকায় সেটেল করেন। উনি আর ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। কোন দিন কিনা কি হয়, বলা তো যায় না। একদিন সকালে চাচা তার পরিবার সহ ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিলেন। সেদিন আমাদের বাড়ির পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ যেনো মারা গেছে।

দিন কে দিন দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ হতে শুরু করলো। এখন সারাদেশেই সব সময় দাঙ্গা হাঙ্গামা লেগেই আছে। হিন্দুদের দেশ হবে ভারত আর মুসলমানদের পাকিস্তান। আমার ঐ বয়সে এতো কিছু বুঝতাম না। আমি ভারত চাই, না পাকিস্তান বুঝতাম না। তবে দুই দলের মিছিলের সাথে সাথে দৌড়াতাম।
আমার বন্ধু শ্যামল একদিন বললো, ” তোরা তো ন্যাড়া, তোদের দেশ পাকিস্তান।” আমি আব্বা কে এসে জিজ্ঞেস করলাম, ” আব্বা আমাদের কে ন্যাড়া বলে কেনো? আমরা কি পাকিস্তান চলে যাবো?” আব্বা সেদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। বুবু আর আপার বাইরে যাওয়া বারণ। বড় ভাই বিকেলের মধ্যেই বাড়ি চলে আসেন। মেঝো ভাই আর আমি সারাদিন বাড়ীতেই থাকি। আর আমার বয়সই বা তখন কতো? দশ কি এগারো!

একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের জীবন যাপন করতে হচ্ছিল। তবে সকাল হলেই আমি ছুটে যেতাম, বন্ধুদের সাথে খেলতে। আমার খেলার সাথী, আমার বন্ধু বিমল, প্রদীপ, কিশোর, খালেক আরও অনেকে। আমরা বুঝতাম না হিন্দু মুসলমান বিষয় টা কি! একদিন প্রদীপ এসে বললো, ” বড়দা তোদের সাথে খেলতে মানা করেছে, তোরা ন্যাড়া, তোরা ম্লেচ্ছ। ”

আমি আর খালেক সেদিন না খেলেই চলে আসি। খুব মন খারাপ হয় আমাদের। যদিও বিমল আর কিশোর প্রদীপের বিরোধিতা করেছিলো কিন্তু প্রদীপের দাদা এসে ওদের কে তাড়িয়ে দেয়। সেদিনের রাতটি ছিলো আমাদের পরিবারের জন্য এক ভয়ংকর কালবৈশাখীর রাতের মতো। সেদিন সন্ধ্যা হতেই চারিদিকে উত্তেজনা। সকলে ফিসফিস করে কথা বলছে, মা চাপা স্বরে কেঁদে চলেছে। মেদিনীপুরে নানীর বাড়ী প্রতিবেশী হিন্দুরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। মামাদের কোন খোঁজ নেই।

তখন রাত দশটার মতো হবে, বেশ কয়েজন লোক আামাদের বাড়ী আক্রমণ করে। ভাইয়া কে এক কোপে মেরে ফেলে, বুবু আর আপাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে শুনেছিলাম বুবু আর আপার লাশ পাওয়া যায় খাল পাড়ে ক্ষত বিক্ষত, চেহারা নাকি চেনাই যাচ্ছিলো না। এদিকে মেঝো ভাই কেমন ভয়ে কুঁকড় গেছে। হঠাৎ করে আমার মেঝো ভাই কেমন যেনো হয়ে গেলো। ভোর হতেই আব্বা আম্মা আর আমরা দুই ভাই আরও কয়েকটি মুসলিম পরিবারের সাথে রাজশাহীর উদ্দেশ্য রওনা দেই। দেশ স্বাধীন হয়েছে আর আমরা হয়েছি বাস্তুহারা, দেশহারা। আমরা চলেছি অচেনা এক স্থানের দিকে। পেছনে রয়ে গেল আমার প্রিয় জন্মভূমি, প্রিয় আকাশ, পুকুর, মাঠ, বিদ্যালয়, খেলার সাথী, ভালোবাসার ভাই বোনের মৃতদেহ সব। আমি আজও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে, ওদের কথা শুনতে পাই, ওদের হাসি আনন্দের শব্দ শুনতে পাই কিন্তু ওদের দেখতে পাইনা।

আমার মেঝো ভাই টাও আমার অন্যান্য ভাই-বোন এর সঙ্গী হয়ে গেলো। পদ্মানদী পার হওয়ার আগেই প্রবল জ্বরে ও আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। আমাদের হাসি আনন্দে ভরা পরিবারটা নিমিষেই একটা জীবন্মৃত পরিবার হয়ে বেঁচে রইলো। আমরা নদী পেরিয়ে রাজশাহীতে এলাম। এই শহর এখন পাকিস্তানের অংশ। আমাদের এই শহরে থিতু হতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। তবে এই শহর আমাদের ফিরিয়ে দেয়নি। আমাদের নতুন বাড়ী হয়েছে, নতুন ঠিকানা হয়েছে। ঠিকানা! এই শব্দ আমার কাছে আর নতুন কোন মানে তৈরি করে না।

সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই দেশ স্বাধীন হলো একসময়, জন্ম নিল বাংলাদেশ। তখন আমি টগবগে যুবক। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লাম। তখন একবার প্রিয় পাকুরিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন অবশ্য ওদের কাছে আমরা বিদেশি, আমরা রিফিউজি। আব্বা আম্মা অবশ্য আর কখনোই ওপারে যাননি। উনাদের কাছে ওদেশ মৃত। সময়ের পরিক্রমায় আমিও বাবা হয়েছি। সংসার ধর্মে যোগ দিয়েছি। দেখতে দেখতে পরিবারটি বেশ বড় হয়ে গেলো। ভরা সংসার কিন্তু আমার বুকের ভেতর হাহাকার। পাকুরিয়া, মাঠ, বিদ্যালয়, পুকুর, ভাইয়া, বুবু, আপা, মেঝো ভাই, কিশোর, খালেক, বিমল ওদের একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না।

কয়েকদিন ধরে শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছিলো না। ছেলে-মেয়ে, নাতি নাতনিরা আমাকে শহরের সবচেয়ে ভালো হাসপাতালে ভর্তি করেছে। আমার চিকিৎসা চলছে। আমি তিনদিন ধরে ঘুমিয়ে আছি! আমি কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। তিনদিন পরে আজকে ফজরের আজান শুনতে পেলাম। শরীরটা বেশ ভালো লাগছে, হাল্কা লাগছে। চেয়ে দেখি আমার ছোট নাতি টা ঘুমাচ্ছে। ওকে আর ডাকলাম না। নিজে নিজেই বিছানা থেকে নামলাম কিন্তু মনে হচ্ছে আমি বাতাসে ভাসছি। হঠাৎ আব্বা আম্মার কথা শুনতে পেলাম, “খোকা চল, বাড়ী যাবি!” আমি অবাক হয়ে উনাদের দিকে তাকাতেই, আব্বা বলে উঠলেন,”বাড়ীতে সকলে অপেক্ষা করছে, বড় খোকা, মেঝো খোকা, বড় খুকি, ছোট খুকি। শুধু তোর জন্য আমরা যেতে পারছিলাম না। এখন চল, বাড়ীতে যাই।”

আমরা ছুটে চলেছি পাকুরিয়ার পথে। ঐ তো নদী পার হয়ে গেলাম নিমিষেই। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ভাইয়া, বুবু, আপা, মেঝো ভাই দাড়িয়ে আছে। ঐ তো আমার জন্মভূমি, আমার প্রিয়জন।

লেখকঃ শোয়াইব আহমদ, কবি ও সাহিত্যিক।
০৮/১২/২০২০

আরও পড়ুন