লিঙ্গ বৈষম্য অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কবি কলকাতায় বসে মানসলোকে নাটোরের বনলতা সেনকে আবিষ্কার করে তাঁর চুল-চোখ-মুখমণ্ডলের এমন উপমা তৈরি করলেন যে, তা আজও মানুষের মুখে মুখে ফিরে। কি দুর্ভাগ্য! কবির চোখের সামনে সেই যুগেও আমার মতো রুটি-রোজগারের দুশ্চিন্তায় বুকের হাড় জিরজিরে বেকার যুবকরা ছিল এবং এখনও আছে কিন্তু আজ অবধি আমাদের নিয়ে কেউ দুলাইন লিখলেন না। রংধনুর আয়ূষ্কাল হোক না ক্ষণিকের! কবিদের কী এমন ক্ষতি হতো আমাদের মতো বেকারত্বেরভারে নুইয়ে পড়া যুবকদের ফুটে বেরিয়ে আসা পাঁজরের হাড়কে রংধনুর উপমায় রাঙিয়ে দু-চার লাইন লিখলে!
লিখিত পরীক্ষায় স্কোর ভালো থাকার কথা। বসে থাকা চেয়ারের ধরন-পজিশন দেখে মনে হল, ভাইভা বোর্ডের মাথা হবেন। বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন। উত্তরে রোমানিয়ান বংশ উদ্ভূত এমন একজন সমাজ বিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা শুরু করতাম যে, পাণ্ডিত্য দেখে অবাক বিস্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে প্রশ্নকর্তা দিশা পেতেন না কারণ পরীক্ষার্থী জানে কিন্তু স্বয়ং পরীক্ষকই সেই সমাজ বিজ্ঞানীর নামই শুনেন নি। আর শুনবেনই বা কি করে! সমাজ বিজ্ঞানীর নামটা যে আমারই ছদ্মনাম তা অনুমান করা যেনতেন সহজ কাজ হতো না কিন্তু সব কিছু ভূণ্ডল করে দিল হেঁচকি। মিথ্যা বলার অভ্যাস নেই। ঠোঁট ফাঁক করতেই হেঁচকি শুরু হলো। উত্তরের পরিবর্তে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে উল্টো আমাকেই প্রশ্ন করতে হল, ‘স্যার, এক গ্লাস পানি হবে?’
শুধু পানি নয়, হেঁচকির প্রতিষেধক-প্রতিরোধের উপায়ও ভাইভা বোর্ডের দুজন পরীক্ষক বাতলিয়ে দিলেন। তবে উপায় বাতলানোর বিনিময়ে চাকরির আশাটা নিয়ে নিলেন।
দুই কিলোমিটারের রাস্তা। অনলাইনে চাকরির আবেদন করে হেঁটে ফিরছি। পিছন থেকে হঠাৎ একটি রিকসা এসে পাশ ঘেঁষে থামল। আমি হকচকিয়ে দুধাপ বামে সরে গেলাম। রিকসাচালক অনুরোধের স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, যাবেন?’
ব্যাটারিচালিত নয়, পায়ে টানা রিকসা, তার উপর রিকসাচালকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও অন্যদের মতো দ্বিধায় পড়ে গেলাম। রিকসায় বসে আছি আর একজন বয়স্ক ব্যক্তি আমাকে কষ্ট করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এতে নিজের বিবেকের আছেই অস্বস্তি বোধহয়। আবার এমন ভাবনা থেকে আমরা কেউ যদি না উঠি তাহলে তার আয়-রোজগার হবে কেমন করে! আমি কিছু বলার আগেই রিকসাচালক বলে উঠল, ‘বাবা, বয়স্ক মানুষের রিকসায় সহসা কেউ উঠতে চায় না। পরপর দুদিন মালিককে জমার টাকা দিতে পারি নি। আজও যদি না দিতে পারি তাহলে মালিক এই আসগর মিঞাকে রিকসা দেওয়াই বন্ধ করে দিবে।’
অনিচ্ছা সত্বেও গন্তব্যের কথা জানিয়ে উঠে পড়লাম। হেঁটে যাওয়ার সাথে দুর্বল শরীরে পা-টানা রিকসার গতিবেগের মধ্যে তেমন ফারাক দেখতে পেলাম না।
অর্ধেক পথ এসে রাস্তার ডানে নরেনদার চায়ের দোকানের সামনে থামতে বললাম। হঠাৎ টানে মোড় নেওয়ায় পিছনের রিকসার ধাক্কা, সামলাতে না পেরে আমি সজোরে লাফ দিলাম। বাম পায়ের সেন্ডেলটা ছিঁটকে দুরে চলে গেছে। কুড়িয়ে পায়ে ঢুকালাম। পিছনে লক্ষ না করে এভাবে মোড় নেওয়ায় রিকসাচালক আসগর মিঞার উপর ভীষণ রাগ হল। রাগ করে দুএকটি কথা শোনাতে যাব কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, ‘একি! আমি হেঁচকির বরপুত্র হলে ইনি দেখছি পুরোদস্তুর আমার হেঁচকি-বাপ!’
আকস্মিক ঘটনায় হতবাক হয়ে যাওয়ায় না-কি আমি কড়া কথা বলব সেই আশঙ্কায় তা বলতে পারব না। আসগর মিঞা সমানে হেঁচকি তুলে যাচ্ছে। আমি জানি, হেঁচকির যন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা। হাত দিয়ে স্টলে ঢোকার ইশারা করে হেঁচকি-বাপকে বললাম, ‘পানি খেলে অনেক সময় হেঁচকি থেমে যায়।’
দোকানে হাতে-গোনা কয়েকটি টেবিল-চেয়ার। নরেনদার দোকানের আইটেম বলতে চা-পুরি। এক হাতেই দোকান চালায়। অসময়। লোকজন নেই। একজন খদ্দের ছিল, আমরা দুজন ঢোকার দুএকমিনিটের মধ্যে বেরিয়ে গেল।
একগ্লাস পানি খেয়ে টেবিলে রাখা জগ থেকে আরেক গ্লাস পানি ঢালতে গেলে বাধা দিলাম। নরেনদাকে দুটি করে পুরি আর চা দিতে বললাম।
মাঝে মাঝে চা খাওয়ার উছিলায় এখানে বসে সময় পার করি। নরেনদা চা দিতে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাইজান, আপনাদের কি দেরি হবে? দেরি হলে চুলার গ্যাসটা বন্ধ রেখে একটু বাড়ি যেতাম? বেশি দেরি করব না।’
দোকান আমার ভরসায় রেখে নরেনদা বাড়ি চলে গেল। আসগর মিঞা চায়ের কাপ হাতে নেওয়ার সময় বিনয়ী কণ্ঠে বলল, ‘বাবা, অনেকদিন এমন আন্তরিকতা পাই নি। অথচ বেখেয়ালে রিকসা চালানোর জন্য আপনি বকাবকি করবেন বলে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। অনুরোধ করে রিকসায় তুলেছিলাম কি-না।’
আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেলাম, ‘চাচা, এই বয়সে রিকসা চালাতে হয়, ছেলেরা দেখে না?’
আসগর মিঞা পুরি শেষ করে পানি খেয়ে চায়ের কাপটা ঠোঁটে ধরতে গিয়েও নামিয়ে রেখে বলল, ‘আমার ছেলে নেই, বাবা। সংসারে একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে আর আপনার চাচি।’
সচ্ছল মা-বাবাদেরও নিজেদের মৃত্যুর পর প্রতিবন্ধী সন্তানের কি হবে এই চিন্তায় জীবনটা নিরানন্দে কাটে। আসগর মিঞার মতো হতদরিদ্রের অবস্থা আরও করুণ। বুকের কোনো এক কোণায় যেন আসগর মিঞার জন্য আলাদা একটা মায়া সঞ্চিত হচ্ছে। আমার মুখ দিয়ে আপনাআপনি বের হয়ে পড়ল, ‘আপনার বাড়ি?’
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল, ‘দেশের বাড়ি নন্দীগ্রাম। বড় যন্ত্রণা বুকে নিয়ে জেদ করে চার বছর আগে দেশ-গাঁও ছেড়ে এই শহরে চলে আসি। রেলওয়ে বস্তিতে থাকি। কয়েকমাস আগে টাইফয়েড হওয়ার পর থেকে শরীরটা আর আগের মতো চলে না।’
আমাকে পাশের টেবিলের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে সেদিনের পেপারটা টান দিতে দেখে আসগর মিঞা বলল, ‘বেশি দূর পর্যন্ত পড়ালেখা না করলেও চায়ের দোকানে বসে আমার আবার পেপার পড়ার নেশা। ইদানিং চোখে ঠিক মতো দেখতে পাই না। পড়তে অসুবিধা হয়। চশমা নিতে হবে।’
অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিরও পেপার পড়ার অভ্যাস নেই। একজন রিকসাচালকের পেপার পড়ার নেশার কথা শুনে ভালো লাগল। জেদ করে নিজের গাঁও-গ্র্রাম ছেড়ে আসার পশ্চাতে কি এমন ঘটনা আছে তা জানতে কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু জিজ্ঞাসা করা উচিত হবে না ভেবে চেপে গেলেও আসগর মিঞার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলাম না। আমার ভিতরের কৌতূহলটা ধরা পড়ে গেছে।
আসগর মিঞা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করল, ‘নন্দীগ্রাম বাজারে কাঁচা তরিতরকারির দোকান করতাম। ছোটো দুটি বোনের বিয়ে দিয়ে নিজে বিয়ে করতে গিয়ে বাবা হতে দেরি হয়ে যায়। ময়না আমার প্রথম কন্যা। মেয়েটি আমার সত্যিই অনেক রূপ নিয়ে জন্মেছিল।’
কথা থামিয়ে আরও এক গ্লাস পানি খেল। আসগর মিঞাকে আশ্বস্ত করলাম, ‘ভাড়ার চিন্তা করতে হবে না, চাচা। আপনার রিকসায় আমি আরও দুজায়গায় যাব। তারপর?’
আসগর মিঞা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে যেতে লাগল, ‘দশ বছর আগের কথা। ময়না সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। অন্যদিনের থেকে বেশি সকালে কলেজে গেল। দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল কিন্তু মেয়ে আমার ফিরল না। নন্দীগ্রাম বাজার থেকে আমার গ্রাম অবধি রটে গেল, ময়না রশিদের সাথে পালিয়েছে। অনেকেই বলল কিন্তু মন টানল না। মেয়ে স্বেচ্ছায় গেছে, আমি থানা-পুলিশ করলাম না। তাছাড়া আমারও মেয়ের উপর অভিমান হয়েছিল। রশিদের বাবা গিয়াস চৌধুরীর অনেক জমিজমা ছাড়াও নন্দীগ্রাম বাজারে বড় হার্ডওয়্যারের দোকান। পড়ালেখা শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখত। রশিদদের দোকানের সামনের রাস্তা দিয়েই মেয়ে আমার কলেজে যাতায়াত করত। বোকা মেয়ে! অভিনয় ধরতে পারে নি। সব্জি-বিক্রেতার মেয়ে যে, বউ হয়ে রশিদদের মতো বিত্তশালী পরিবারের চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভিতরে ঢোকার ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না তা আমার মেয়ের চিন্তাতেই আসে নি। ঘটনার সাত দিনের মাথায় এশার নামায পড়ে ফিরছি। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পাশের আমবাগানের একটি গাছের আড়াল থেকে ময়নার কণ্ঠে বাবা ডাক ভেসে এলো। গত সাত দিনে বুকের ভিতরে শুকিয়ে চর পড়ে যাওয়া সুখের নদীটা মেয়ের কণ্ঠে বাবা ডাক শুনে মুহূর্তের মধ্যে বর্ষাকালের ভরা নদী হয়ে পড়ল। মায়ের ভয়ে বাড়িতে ঢোকার সাহস পায় নি। মেয়ে জানে, আমি প্রতিদিন এশার নামায পড়ে এ রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরি। অন্ধকারে আমবাগানে নিজেকে লুকিয়ে রেখে আমার জন্য অপেক্ষা করছে মনে হতেই মেয়ের সব অপরাধ ভুলে গিয়ে ডাক দিলাম, তুই বেরিয়ে আয়, মা। আমি সব দিক সামলে নিব।’
আমার মোবাইল বেজে উঠল। মায়ের ফোন। মায়ের সাথে কথা শেষ করে বললাম, ‘তারপর?’
আসগর মিঞা আমাকে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিল, ‘মেয়ের মুখ বাবার কাছে কি জিনিষ জানেন, বাবা? বাবার কাছে মেয়ের মুখ হচ্ছে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সব চেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। ময়নাবিহীন আমার বাড়িতে যেন গত সাত দিন কোনো আলো জ্বলে নি। অন্ধকারে ডুবেছিল। মেয়েকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ঢোকা মাত্র আমার বাড়িটা আবার আলোয় ঝলমল করে উঠল। আপনার চাচি প্রথমে ময়নাকে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও পা জড়িয়ে কান্নাকাটি করে ভুল স্বীকার করতে থাকলে মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে নিজেও কাঁদতে লাগল।’
আসগর মিঞাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘মেয়ে ফিরে আসার পর রশিদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেছিলেন?’
আমার প্রশ্নের এমন উত্তর দিবে ভাবি নি। আসগর মিঞা এখন আমার কাছে সামান্য রিকসাচালক নয়। চিন্তা-ভাবনায় একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘সেটা করা কি ঠিক হতো? রশিদ আমার কাছে একজন প্রতারক। কোনো প্রতারকের হাতে মেয়েকে তুলে দেয়ার জন্য মামলা করতে যাব কেন? ভাবলাম, মামলা করলে হয়তবা রশিদের জেল-জরিমানা হবে কিন্তু রশিদকে শাস্তি দিতে গেলে আমার মেয়ের সাত দিনের ভুলের দাগটা দিনে দিনে মিলিয়ে যাবার বদলে সমাজের কাছে পাকাপোক্ত হয়ে পড়বে। পড়ালেখায় ভালো ছিল। ভুল করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। মেয়েকে বললাম, পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে অনেক উপরে উঠতে হবে এবং সেটাই হবে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত। ফিরে আসার দিন পনেরো পরে থেকে মেয়ে আবার কলেজে যাওয়া শুরু করল কিন্তু তিন দিনের বেশি যেতে পারল না। এশার নামায পড়ে এসে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়েছি। মেয়ে ঘরে ঢুকে পায়ের কাছে বসে হঠাৎ আমার পায়ের তালু টিপতে লাগল। ভাবলাম, হয়তবা বাবার কাছে কোনো বায়না করবে তারই প্রস্তুতি। রশিদের বিচারের ভার আমি সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দিলেও আমার মেয়ের বিচারের ভার সমাজের কিছু মানুষ তাদের হাতের মধ্যেই রেখে দিয়েছিল। এ সমাজে কেউ একবার ভুল করলে কিছু মানুষ তাকে আর ভুল সংশোধনের সুযোগ দেয় না। কলেজ যেতে শুরু করার পর রাস্তা-ঘাটে মেয়েকে আমার অনেকেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করত। কলেজের বান্ধবীরাও এড়িয়ে চলত। দুএকজন স্যার-ম্যাডামও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সাহস যোগানোর পরিবর্তে ভর্ৎসনা করতে ছাড়েন নি। মেয়ে কোনো কথা বলার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল ঘরের পিছনে আপনার চাচির কান্নার চিৎকারে। কয়েকটি কুকুরের অনবরত ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে চোর মনে করে আপনার চাচি বাইরে বের হয়ে দেখে ঘরের পিছনের কাঁঠাল গাছের ডালে দড়িতে গলায় ফাঁস নিয়ে ময়না ঝুলছে। পায়ের তালু টিপে দেওয়ার উছিলায় মেয়ে যে আমার কাছে শেষ বিদায় নিতে এসেছিল তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি। একটি ভুলের জন্য সমাজের কানাঘুষা, বন্ধু-বান্ধবদের এড়িয়ে যাওয়া, রাস্তাঘাটে লোকের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আমার মেয়ের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই কেড়ে নিয়েছিল। এবারে আর সহ্য করতে পারলাম না। আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে রশিদের নামে মামলা করলাম কিন্তু সাক্ষীরা কাঠগড়ায় উঠে বয়ান উল্টিয়ে দেওয়ায় সে মামলা টিকল না। গিয়াস চৌধুরী সবাইকে হাত করে নিয়েছিল।’
আসগর মিঞার কথা শেষ হতেই আমি মন্তব্য করলাম, ‘বুঝেছি, এই কারণেই তাহলে পরিচিত সমাজের উপর অভিমান করে নন্দীগ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন।’
আমার মন্তব্য শুনে আসগর মিঞা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে না-সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজেকে সামলিয়ে বাকি কথা শুরু করলেন, ‘না, বাবা, সেই কারণে হলে চার বছর আগে না এসে আমি দশ বছর আগেই নন্দীগ্রাম ছেড়ে চলে আসতাম। আমার কাছে এখনও মনে হয়, আমার জীবিত মেয়ের প্রতি যে নিষ্ঠুরতা হয়েছিল তার চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতার ঘটনা ঘটে মৃত মেয়ের উপর। মেয়ের মৃত্যু তখন ছয় বছরে পড়েছে। নন্দীগ্রাম পৌরসভার নির্বাচন। রশিদ পৌরসভার নির্বাচনে দাঁড়াল। আসরের নামায পড়ে নন্দীগ্রাম বাজারে যাচ্ছি। রাস্তায় রশিদের নির্বাচনী মিছিল। রশিদ সবার সামনে। মিছিলে এলাকার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিকেও দেখতে পেলাম। মিছিলের স্লোগান— রশিদভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। বুকের মধ্যে ভেঙে খান খান হয়ে গেল। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমার মেয়ের সাথে রশিদের প্রতারণার কথা মিছিলের কারো অজানা ছিল না।’
একজন খদ্দের এসে দোকানির খোঁজ করায় বাধা পড়ল। নরেনদা দোকান বন্ধ রেখে বাড়িতে গেছে জানিয়ে খদ্দেরটিকে বিদায় করলে আসগর মিঞা আবার কথা শুরু করল, ‘রশিদের পক্ষে নিকট-প্রতিবেশীদেরকেও প্রচার করতে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। নিজেকেই প্রশ্ন করতাম, রশিদ কয়েক বছর আগে ময়নার সাথে কী ব্যবহার করেছিল তা এতো সহজে কাছের মানুষরাও ভুলে গেল? আমার মৃত মেয়ের প্রতি প্রতিবেশীদের সহানুভূতি রশিদের টাকার কাছে হেরে গিয়েছিল। আমার নিকট লোকজনের নির্বাচনে রশিদের জয় কামনা করাটা ছিল— আমার মৃত মেয়ের প্রতি সমাজের মানুষের এক ধরণের নিষ্ঠুরতা। মাথাটা কেমন আউলা-ঝাওলা হতে শুরু করল। আমার ঘরের পিছনে কিছুটা দূরে ময়নার কবর। রাতের বেলা ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলেই আমি যেন সেখান থেকে ময়নার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসার শব্দ পেতাম। মনে হতো, মানুষকে নিজের প্রতারকের গুণগান করতে দেখে আমার মেয়ের আত্মা কাঁদছে। নির্বাচনে রশিদ জিতেও গেল। জেদ চাপল, বিবেকহীন মানুষদের মাঝেই আর থাকব না। রশিদের মতো লোককে ভোট দিয়ে যারা জিতিয়ে দিল তারা আমার জানাজায় এলে আমার আত্মাও কষ্ট পাবে। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পরিবার নিয়ে আপনাদের শহরে চলে এলাম।’
জীবনে দুঃখ-কষ্ট থাকবেই। কারো দুঃখের কথা শুনলে তেমনভাবে অভিভূত হই না কিন্তু আসগর মিঞার বেলায় ব্যতিক্রম ঘটল।
মেয়ের পরোক্ষ হত্যাকারী রশিদকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে দেওয়াটা যদি আসগর মিঞার কাছে নিষ্ঠুরতা মনে হয় তাহলে আমিও সেই নিষ্ঠুর মানুষদের একজন। স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে যাই। কখনও কখনও ভালো প্রার্থীদের মধ্য থেকে কে বেশি ভালো তা বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে না, মন্দদের মধ্য থেকে যে কম মন্দ তাকে বেছে নিতে হয়। প্রতারণার ধরন অনেক রকম হতে পারে। এসব কম মন্দলোকগুলিও হয়তবা সমাজের কারো না কারো কাছে প্রতারক। আমাদের ভোটে যখন কোনও ঠগ-অসৎ-ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ-প্রতারক নির্বাচনে পাস করে তখন তার দ্বারা প্রতারিত পরিবারগুলিরও নিশ্চয় আসগর মিঞার মতো বুকের পাড় ভেঙে যায়!
আসগর মিঞার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বুকের ভিতরে তোলপাড় চলছে। নরেনদা ফিরে এসেছে। আমি নরেদাকে বিল মিটিয়ে দিয়ে রিকসার কাছে দাঁড়াতেই আসগর মিঞা উঠে এসে বলল, ‘বাবা, উঠে পড়ুন। কোথায় যাবেন বলছিলেন? আমার কথা শুনতে গিয়ে আপনার অনেকটা সময় নষ্ট হলো।’
বেকার মানুষ। পকেটের শক্তি কম। এক প্রকার জোর করেই আসগর মিঞার হাতে দুশ টাকা গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘আজ আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিব। আপনিও রিকসার জমা মিটিয়ে দিয়ে বাসায় গিয়ে আরাম করবেন।’
রিকসাটা কয়েকধাপ গড়িয়ে নিয়ে আসগর মিঞা ঘাড়ের গামছাটা হাতে নিল। মুখের ঘাম না-কি চোখের জল মোছার জন্য সেটা পিছন থেকে ঠাহর করতে পারলাম না।