Ads

আধা পাগল

।। মনসুর আলম ।।

 

আলম সাহেবের মাথাটা ইদানীং ঘনঘন বিগড়ে যায়। আগেও যে খুব একটা ভালো ছিলো বিষয়টি সেরকম নয়। আগে মাঝেমধ্যে বিগরে যেতো কিন্তু, আজকাল প্রায়শই আউলা ঝাউলা হয়ে যায়। আলম সাহেবকে পাগল বলা যেতে পারে কিন্তু, উন্মাদ বলা যায় না। ওনার মাথার গন্ডগোলের ব্যাপারটা আসলে উনি খুবই সুক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। বাথরুমের আয়নার সামনে ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় তিনি ভাষণ দেন না। যখনই মাথায় পাগলামো ভর করে তিনি চট করে বাথরুমে ঢুকে পড়েন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা একটি লেকচার দিয়ে মুখে পানি ছিটিয়ে একেবারে ফ্রেশ হয়ে বের হোন। মাঝেমধ্যে অবশ্য বউয়ের সামনে লেকচার দেবার চেষ্টা করেন কিন্তু, ওনার কপাল খারাপ – বউ বেচারি পেশায় শিক্ষক হওয়ায় সারাদিন নিজেই লেকচার দিয়ে বেড়ায়, আধা পাগল আলম সাহেবের লেকচার পুরোনো নিউজপেপারের চেয়ে বেশী গুরুত্ব পায় না। এটি আলম সাহেবের জন্য খুবই স্বস্তির ব্যাপার। গুরুত্ব না দেয়ায় আসলে ওনার মাথার গন্ডগোলের ব্যাপারটা বউয়েরও অজানা। প্রিয় বন্ধু কামরুল আরেফীন কীভাবে কীভাবে যেনো সব টের পেয়ে যায়। আপাতত বন্ধু কামরুল ছাড়া অন্য কেউ এই পাগলামির বিষয়টি টের পায়নি।

 

অল্প কয়েকদিন আগেই মাথাটা আউলা হয়েছিল। ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে যখন সিএনজি চালিত পরিবহনেও ভাড়া বেড়ে গেলো, আধা পাগল আলম সাহেব দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে একটি ভাষণ দিয়ে এসেছেন। এবার তিনি দুটি মারাত্মক ভুল করে বসেছেন- ভাষণ দেবার সময় ফোনের রেকর্ডিং অপশন চালু করে দিয়েছেন, পরবর্তীতে মাথা ঠান্ডা হবার পর সেই রেকর্ডিং আবার বাজিয়ে শুনেছেন। এরকম জঘন্য ভুল তিনি জীবনে এই প্রথম করলেন। প্রথমত নিজের বাজখাই কণ্ঠস্বর শুনে হতবাক, দ্বিতীয়ত স্রোতের বিপরীতে উজান মুখী এইসব কথাবার্তা শুনে তার নিজেরই সন্দেহ হতে লাগলো- মাথাটা বোধহয় পুরোপুরি গেছে।

 

চলুন, ওনার নিজের মুখে শুনে আসি এবারকার গন্ডগোলের কারণ:
সে অনেক বছর আগের কথা। শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছিলাম সম্পর্কের গোড়ায় পানি ঢালতে। আত্মীয়তার সম্পর্কে নিয়মিত পানি দেয়ার বদভ্যাসটা আমার ছোটবেলা থেকেই। ছুটির দিনে মামার বাড়ি যাচ্ছিলাম লোকাল বাসে চড়ে। একটি স্টেশনে হাইস্কুলের কিছু ছাত্ররা জোর করে বাসে উঠে গেলো। কন্ডাক্টর তাদেরকে উঠতে দিবে না, ছাত্ররা প্রায় ধাক্কা দিয়ে কন্ডাক্টরকে সরিয়ে দিয়ে জোরপূর্বক বাসে উঠে পড়েছে। কথা কাটাকাটি প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেছে। ড্রাইভার একপাশে বাস দাঁড় করিয়ে রেখেছে, ছাত্ররা না নামলে সে গাড়ি ছাড়বে না। ছাত্ররাও নামবে না, তাদেরকে নিতে হবে – অবশ্যই বিনা ভাড়ায়।
নিজের এলাকা, নিজের স্কুল। আমিও মেট্রিক পাশ করেছি সেই স্কুল থেকে। আমার স্কুলের ছোটো ভাইদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের বাক বিতন্ডা দেখে চুপ থাকতে পারিনি। ছাত্রদেরকে ডেকে নিজের পরিচয় দিলাম, কয়েক বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলাম বিধায় তাদের কাছ থেকে বড় ভাই হিসেবে বিষয়টি ফয়সালা করার দায়িত্ব নিলাম। সংখ্যাটা ঠিক মনে নেই, তবে ওরা ৮/১০ জন ছিলো।
– আচ্ছা, তোমাদের সমস্যা কী?
– আমরা ছাত্র, আমাদেরকে বিনা ভাড়ায় নিতে হবে। নাহলে আমরা বাড়ি যাবো কীভাবে?
– সকালে যেভাবে এসেছো সেভাবেই যাবে। সকালে এসেছো কীভাবে?
– সকালেও এভাবেই এসেছি। প্রতিদিনই এভাবে আসি, প্রায়শই মারামারি করতে হয়।
– কেন? তোমাদের অভিভাবকরা তোমাদেরকে গাড়ি ভাড়া দেন না?
– জ্বি না, ছাত্রদের জন্য ফ্রি। আমাদের গাড়ি ভাড়া লাগে না।
– তাই নাকি? আচ্ছা, তোমরা যখন দুপুরে কিছু খেতে যাও বাজারের রেস্টুরেন্টে তখন কি ফ্রি খাবার চাও? খাতা, কলম, জ্যামিতি বক্স কিনতে গিয়ে কি ফ্রি চাও? দর্জির কাছে ইউনিফর্ম বানাতে দিলে কি ফ্রি চাও? স্যারের কাছে ফ্রিতে প্রাইভেট পড়ো? অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে ফ্রি প্রেসক্রিপশন চাও? ফ্রি ঔষধ? তাহ‌লে এক‌টি প্রাইভেট বাসের মালিক কিংবা চালক তোমাদেরকে কেন ফ্রি নিবে? তাছাড়া তোমরা নিজেরাও অনেক স্বার্থপর – যাদের গায়ে জোর আছে তোমরা বাসে উঠে পরেছো, ওদিকে দুর্বল ছেলেমেয়েগুলি এখনও রাস্তার পাশে রোদে দাঁড়িয়ে আছে। তোমাদের কি দায়িত্ব ছিলো না আগে মেয়েগুলির যাবার ব্যবস্থা করা? যাও তোমরা নেমে গিয়ে তিনটা মেয়েকে পাঠাও, আর একই গাড়িতে তিনজনের বেশী উঠবে না। তোমরা নিজেরাই ঠিক করো কে আগে যাবে, কে পরে যাবে? লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকো, বাস আসলে শৃংখলা বজায় রেখে উঠবে।

 

ড্রাইভারকে বললাম, ভাই এই মেয়েগুলিকে নিয়ে নিন- ওদের ভাড়া আমি দিচ্ছি। এবার চলুন। ড্রাইভার অবশ্য আমার কাছ থেকে ওদের ভাড়া নেয়নি।
সেই একই সমস্যা নিয়ে আজও দেখি মারামারি, হাতাহাতি হচ্ছে। খোদ রাজধানীতেই পরিবহন শ্রমিকদের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ। মাথা আউলা না হয়ে পারে? আজও মাথা বিগড়ে আছে। তাই, তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়ে এলাম। আজকের ভাষণের সারমর্ম –

 

ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। সরকার ভর্তুকী দিয়ে বাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। অভিভাবক কমিটি চাঁদা তুলে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে স্পন্সর নিয়ে নিজ উদ্যোগে কিছুটা সহায়তা করতে পারে। সর্বোপরি আপনার সন্তানদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আপনার, প্রাইভেট সার্ভিসের বাস মালিকদের নয়। অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতের ব্যবস্থা করা আপনি অভিভাবকদের দায়িত্ব। বাস মালিকদের কাছে ফ্রি/হাফ ভাড়া দাবি করা কেবল অন্যায় নয় অসভ্যতাও বটে। জীবনের শুরুতেই আমরা, আমাদের সন্তানদেরকে অন্যায় আচরণ শেখাচ্ছি।

 

সরকারি যত পরিবহন ব্যবস্থা আছে – বাস, ট্রেন, বিমান, নৌ সবজায়গায় সরকার যদি ছাত্রদের জন্য বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করে সেটি সাধুবাদ পেতে পারে। আমরা খুশি হয়েই সেই ভর্তুকীতে অংশ নিবো, ওরা তো আমাদেরই সন্তান। আমরাও চাই তাদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মান করতে। তাই বলে পরিবহন সেক্টরের কাছে বিশেষ সুবিধা দাবি করে আমার সন্তানের আত্মসম্মানে আঘাত করতে হলে আমার বেজায় আপত্তি আছে। অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া যায়, আদায় করা যায় না। স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ছেলেমেয়েদেরকে একটি অপমানজনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবার দায় আমার, প্রতিটি অভিভাবকের।
যাই, বউ কিছু বুঝে ফেলার আগেই বাথরুম থেকে বের হতে হবে। একবার পাগল উপাধি পেয়ে গেলে …!

 

লেখকঃ প্রবাসী লেখক, সাউথ আফ্রিকা।

 

লেখকের  আরও লেখা পড়ুন-বেবি পার্লার

 

আরও পড়ুন