Ads

উপহার

শাহানা ইয়াসমিন মুক্তা

সকাল আটটা বাজে। মারিয়াম খুবই ব্যস্ত পোশাক পরা নিয়ে। কোন পোশাক পরবে ঠিক করতে পারছে না। অন্য দিনের চেয়ে শীতের প্রকোপটা আজ একটু কম। তাই সোয়েটার পরবে না শাল পরবে ঠিক করতে পারছে না। ড্রেসের সঙ্গে সোয়েটার বা শালের ম্যাচিং করাতে হবে এটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে। আলমারির পাল্লা খুলে ভাবছে কোনটা পরা যায়। নীল পরবে না গোলাপী, ঠিক করতে পারছে না। অবশেষে গোলাপী রঙের ড্রেস পরে। যদিও বসন্তকাল চলে এসেছে তবু গোলাপী রঙের কদর সার্বজনীন। মারিয়াম একটা প্রাইভেট কলেজের লেকচারার।

প্রায় বছর তিনেক হলো কলেজে জয়েন করেছে। প্রথম প্রথম ভালো লাগতো না তেমন একটা। এখন সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে তা ছাড়া বাস্তব পরিস্থিতিকে মেনে নিয়েছে। মারিয়ামের বেশির ভাগ ক্লাসই থাকে সকালে, লেপের নিচ হতে বের হতে কষ্ট হয় এই আর কি। এখন ঘড়িতে নয়টা বাজে, ক্লাস শুরু হতে মাত্র ৩০ মিনিট বাকি। তাড়াতাড়ি ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে মাকে বলে আমি কলেজে গেলাম। মা হাসিমুখে বলেন ফিরবি কখন? উত্তর আসে, তাড়াতাড়ি চলে আসব। কলাপসেবল গেট খুলে বের হতে হাত ঘড়িতে দেখে নেয় কয়টা বাজে। তাড়াতাড়ি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী হতে বের হয়ে দোয়া পড়ে, বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ। দোয়া পড়া শেষ হতেই সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে, সুমাইয়া তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

দুজনের সালাম বিনিময়ের পর মারিয়াম জিজ্ঞেস করে,

কেমন আছিস আপু? ভালো তো?

সুমাইয়া বলে আগামী পরশু দিন ভাইভা এজন্য টেনশনে আছি। হাতে সময় কম তাই কথা না বাড়িয়ে বলে বাসায় যা আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যে আসছি। অগত্যা সুমাইয়া মারিয়ামদের বাসায় যায়। বাসায় ঢুকে সবার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে।

মারিয়াম কলেজের গেটে ঢুকতেই ক্লাসে যাবার ঘন্টা দিল। টিচার্স রুম থেকে ছাত্র-ছাত্রীর হাজিরা খাতা, চক ডাস্টার নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যায়। দেখে মাত্র ১২ জন ছাত্র-ছাত্রী এসেছে। কম সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। ক্লাসে রোল কল করার পর পড়ার বিষয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে গত ক্লাসের পড়া। পড়া জিজ্ঞেস করাতে সবাই চুপ। মনে হচ্ছে পিন পতনের শব্দ ও শোনা যাবে।

মারিয়াম মনে মনে বিরক্ত হলেও সহাস্যে বলে,

-তোমাদের পড়া না হওয়ার কারণ কি? তোমরা কি বুঝনি না পড়নি?

সাহস করে একজন বলে পড়া হয়নি। মারিয়াম আবার ও বলে,

-আমার কথা বুঝতে কি তোমাদের অসুবিধা হয়?

সবাই সমস্বরে বলে,

-না ম্যাডাম।

-তাহলে তোমাদের সমস্যাটা কি?

একজন দাঁড়িয়ে বলে,

-পড়ি কিন্তু ম্যাডাম, বলতে গেলে গুলিয়ে ফেলি ।

আরেক জন বলে,

-সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারিনা।

মারিয়াম বলে,

-প্রথম ক্লাসে তোমাদের একটা দোয়া শিখেছিলাম, তোমরা যদি সেই দোয়াটা নিয়মিত পড়তে তাহলে তোমাদের এ সমস্যাটা থাকত না।

একজন ছাত্রী বলে,

-ম্যাডাম দোয়াটা যদি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেন তাহলে আমরা লিখে নিতে পারি।

ম্যাডাম ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিলেন।

“রাব্বিস রাহলি ছাদরি, ওয়া ইয়াচ্ছিরলি আমরি ওয়াহ্লুল উকদাতাম মিল লিছানি ইয়াফকাহু ক্বাওলি” সূরা ত্বহা (২৪-২৭)।

সঙ্গে সঙ্গে বলেন,

-মুসা (আঃ) কে যখন আল্লাহ তায়ালা নবুয়ত দিলেন, “তখন মুসা (আঃ) আল্লাহ তায়ালা কে বলেন, আমি তো তোতলা, কেমন করে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান জানাবো?” তখন আল্লাহ্ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন এবং তাকে আমল করতে বলেন। তাই, আমাদের যদি মুখে জড়তা বা আড়ষ্ঠতা থাকে, এ দোয়ার আমল করে তবে আমাদের জড়তা দূর হবে এবং আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর হবে।

এরপর মারিয়াম সেদিনের পড়া পড়ালেন এবং ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসেন।

একজন ছাত্রী পিছন থেকে ডাকে,

-ম্যাডাম১

মারিয়াম পিছনে ফিরে তাকায়,

-জিজ্ঞেস করে কিছু বলবে?

ছাত্রীটি বলে,

-এই দোয়াটা পড়লে কি আপনার মত সুন্দর করে কথা বলতে পারবো?

মারিয়াম হেসে বলে,

-শুধু আমার মত নয় ইনশাআল্লাহ আমার চেয়েও সুন্দর বলতে পারবে যদি নিয়মিত এই দোয়া পড়।

ছাত্রীটি সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে পুনরায় ক্লাসে চলে যায়। ক্লাস থেকে টিচার্স রুমে এসে খাতা ডাস্টার রেখে চেয়ারে বসতে যাবে এমন সময় মনে পড়ে সুমাইয়ার কথা। আরেকটা ক্লাস আছে তবে তিন পিরিয়ড পর তাই তাড়াতাড়ি গৃহপানে ছুটে সে। কলেজ থেকে বাড়ি ৩-৪ মিনিটের পথ। বাসায় ফিরে দেখে বসে টিভি দেখছে সুমাইয়া। মারইয়ামকে দেখেই বলে উঠে, -আমার ভাইভা সামনে পরামর্শ দাও।

হাসতে হাসতে মারিয়াম বলে ওঠে,

-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীদের পরামর্শ লাগে নাকি!

সুমাইয়া বলে,

-হেয়ালি করোনা, মাথায় জ্যাম হয়ে আছে তাই তোমার কাছে একটু হালকা হতে এসেছি।

পুনরায় মজা করে মারিয়াম বলে,

-বাঃ আমি এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলাম কবে বুঝিনি তো আগে। কেউ তো বলেনি আমার গুণের কথা।

মারইয়ামের হাসি দেখে সুমাইয়া ক্ষেপে যায়। বলে,

-তুমি আমার বিষয়টা সিরিয়াসলি নিচ্ছ না।

এবার মারিয়াম সুমাইয়ার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বলে,

-পরীক্ষার সময় টেনশন হওয়াটা স্বাভাবিক আল্লাহর কাছে সাহায্য চা এবং সুরা ত্বহার চারটি আয়াত পড়ে ভাইভা বোর্ডে যাবি, দেখবি তোর ভয় কেটে গেছে এবং প্রশ্ন উত্তর গুলো সুন্দর ভাবে দিতে পারছিস। টেনশনে আমরা অনেক সময় সহজ প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারি না, জানা উত্তরগুলো গুলিয়ে ফেলি। আমাদের চাওয়া আল্লাহর কাছে তিনি সর্বজ্ঞ, তাই তার ওপর ভরসা করলে আমরা নিশ্চিত হতে পারি।

সুমাইয়া কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো এবং কুরআন থেকে আয়াতগুলো লিখে নিল। ততক্ষনে টেবিলে নাস্তা হাজির। গরম সিঙ্গারা আর চা। মারিয়াম সিঙ্গারার প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল,

-ছোটবেলায় আমি বাহিরে বের হতাম না। কারও সঙ্গে মিশতে পারতাম না। হড়বড় করে কথা বলতাম। ক্লাস টেনে পড়ার সময় সুরা ত্বহার এই চারটি আয়াতের ফজিলত জানতে পারি এবং তখন থেকেই এর আমল করি। আল্লাহর রহমতে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে বা পরীক্ষার সময় আর অসুবিধা হয় না। সবচেয়ে বড় কথা আল্লাহপাক যার সাহায্যকারী হয়ে যান তার তো কোন সমস্যা থাকে না।

হঠাৎ সুমাইয়া মারিয়াম কে জড়িয়ে ধরে বলে,

-আপু ইউ আর গ্রেট।এত সুন্দর করে তুমি সব বুঝিয়ে দাও। এই জন্যই তো তোমাকে এত ভালোবাসি আর যখন তখন তোমার কাছে ছুটে আসি।

ব্যাগ থেকে বের করে একটা আধা ফোটা লাল গোলাপ। আপু পহেলা ফাল্গুনের শুভেচ্ছা “শুধু তোমার জন্য”। তোমার কাছ থেকে একটা অনেক বড় উপহার পেয়েছি। এজন্য প্রতি উত্তরে মারিয়াম বলে “জাজাকাল্লাহু খায়ের”। আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিক।

লেখকঃ গল্পকার

আরও পড়ুন