Ads

ছেলেটা

ফরহাদ হোসেন

প্রায় ছয় মাস হলো আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।আমি এখনও জানিনা আমাদের সংসার কেন ভেঙ্গে গেল। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির প্রবেশ ঘটে নি। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে আমাদের সম্পর্ক দিনকে দিন জটিল হয়ে যাচ্ছিল। যদিও আমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। আমি অবশ্য কোনো অভিযোগের বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারিনি। শুধু ভেবেছি, জোর করে আর যাই হোক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। তারচেয়ে বরং আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো।

যদিও সে এখন আর আমার স্ত্রী নয়, কিন্তু আমার তাকে সাবেক ভাবতে ভাল লাগে না। আমরা দুজনে এখনও সিঙ্গেল, নতুন করে বিয়েও করিনি—কোনো সম্পর্কেও জড়াইনি। তাই প্রাক্তন কিংবা বর্তমান বিষয়টা এখনও আমাদের সম্বোধন বা পরিচয়ের মধ্যে আসেনি।

আমাদের একটি মাত্র ছেলে সন্তান। গত মাসে সে ৫ বছরে পড়ল। সে তার মায়ের কাছেই থাকে। মাসের প্রথম দিনেই আমি সাধারণত আমার স্ত্রীর হাতে এলিমনির বরাদ্দকৃত টাকাটা দিয়ে আসি। এর ব্যতিক্রম খুব একটা হয় না।

একদিন বিকেলে, কাজ থেকে ফেরার পথে আমি টাকা দেবার জন্যে তার বাসায় গেলাম। কলিং বেল বাজাতেই আমার ছোট্ট ছেলেটা দৌড়ে এসে দরজার এক পার্ট খুলে লোহার গ্রিল ধরে দাঁড়াল। আমাকে দেখে যে সে খুব খুশি হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। অফিসের কাজে আমাকে এক মাসের ট্যুরে বাইরে যেতে হয়েছিল। এতদিন পরে আমাকে দেখে খুশিতে চিকচিক করে উঠল ছেলেটার দুই চোখ।

বন্ধ দরজার ভেতর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘বাবা তুমি আসছ?’

‘হ্যা বাবা, আমি আসছি।’ আমি বললাম, ‘কেমন আছো তুমি?’

‘আমি ভালো আছি।’ ছোট ছোট করে উত্তর দিল সে।

‘আম্মু আসে নাই এখনও।’

‘না।’ বলেই সে খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, ‘তুমি কি ভিতরে আসবা? চাবি এনে দেই, খুলে ভিতরে আসো।’

‘থাক বাবা, চাবি আনতে হবে না। আমি এখানেই থাকি।’

‘কেন?’

‘ভিতরে আসাটা ঠিক হবে না বাবা।’

‘কেন? কেন ঠিক হবে না?’

‘তোমার আম্মু যে বাসায় নেই।’

আমাকে দেখার পর তার চোখে মুখে যে আনন্দের ঝিলিক দেখা দিয়েছিল, তা যেন হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল। আমি তার গভীর চোখ দুটোতে বিষাদের হাসি দেখতে পেলাম। এমন একটা পরিস্থিতিতে এতটুকুন একটা বাচ্চা নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমি প্রসঙ্গ বদলে দেবার চেষ্টা করলাম যাতে তার ছোট্ট মনের উপর চাপ না পড়ে। কিছুদিন আগেই ওর জন্মদিন ছিল। অফিসের ট্যুরে শহরের বাইরে থাকায় আমি তার জন্মদিনে আসতে পারিনি। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা তোমার বার্থডেতে কী কী মজা করলে বলো।’

সে খুব খুশি হয়ে বলল, ‘অনেক মজা করেছি। অনেক মজা।’

‘আমাকে মিস করো নি?’

‘অনেক মিস করেছি। অনেক।’

বন্ধ দরজার গ্রিলের মধ্যে দিয়ে হাত প্রসারিত করে আমরা দুজন দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। তার মা বাসায় না থাকা অবস্থায় আমি কখনও যদি আসি, আমরা এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকি। ছেলেটা কয়েকবার ভিতরের দিকে তাকাল। আমি বুঝতে পারলাম সে তার বেবি সিটার দূর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে কি না সেটা লক্ষ্য করছে। আমি আরও কিছুক্ষণ খেলাচ্ছলে বিভিন্ন কথা বললাম। তার স্কুল কেমন চলছে, বার্থ-ডে তে কি কি গিফট পেল, সামনের উইকএণ্ডে সে আমার সাথে কোথায় যেতে চায়—এসব অনেক ধরণের কথাই হলো আমাদের মাঝে।

আমি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, ‘তোমার আম্মুর আসতে বোধ হয় দেরী হবে। আমি তোমার আম্মুর জন্যে কিছু টাকা এনেছি। এগুলো তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। আম্মু এলে বলবে, বাবা এসে দিয়ে গেছে।’ কথা বলতে বলতে আমি আমার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা এনভেলপ বের করে তার হাতে দিলাম।

সে এনভেলপ হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নেড়েচেড়ে বলল, ‘আম্মু তোমার কাছে অনেক টাকা পায়?’

আমি বললাম, ‘না বাবা। অনেক টাকা না। আমি কাজ করে যেই টাকা পাই, তার কিছু অংশ।’

‘ও।’ বলে সে চুপ করে রইল।

সে আদৌ কিছু বুঝেছে কি না জানি না। তবে সে যেহেতু দেখছে বাবা প্রতিমাসে একটা সময়ে এসে আম্মুর হাতে টাকা দিয়ে যায়, সেহেতু এটাই হয়তো নিয়ম। তবুও আমি একটু বুঝিয়ে বললাম, ‘এই ধরো তোমার স্কুল, তোমার ফেভারিট ফুড, ফেভারিট টয়স কেনার জন্যে, বেড়াতে যাওয়ার জন্যে এই টাকাটা আমি দেই।’

সে আবার এনভেলপটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু এখানে তো অনেক টাকা! তোমার জন্যে কিছু রেখেছ?’

আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘হ্যা বাবা, আমার জন্যে যতটুকু দরকার—রেখেছি। তাছাড়া আমি তো একা। আমার বেশি টাকা লাগে না। তোমরা তিনজন। তুমি, আম্মু, বেবি সিটার।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে কিছু একটা ভাবল। তারপর হঠাৎ করেই বলল, ‘তুমি একটু দাড়াও বাবা, আমি আসছি।’ বলেই সে এক দৌড়ে ভিতরে চলে গেল। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ কিছু একটা ভাঙ্গার শব্দ হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ফিরে এলো। তার ছোট্ট হাত দুটির মুঠি বন্ধ করে সে আমার সামনে এসে দাড়াল। আমার দিকে তার ছোট্ট হাত দুটি একসাথে এগিয়ে দিয়ে মুঠি মেলে ধরে বলল, ‘নাও।’

আমি তাকিয়ে দেখলাম তার হাত ভর্তি অনেকগুলো কয়েন। তার ছোট্ট হাত দুটিতে যতখানি সম্ভব, ভরে নিয়ে এসেছে।

‘আমার মানিবক্সে যা ছিল, নিয়ে এসেছি। এখানে হয়তো অনেক নেই, কিন্তু তুমি কিছু কিনতে পারবে।’ বলতে বলতেই তার চোখ ভিজে এলো।

আমি গ্রিলের মধ্যে দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম।

সেদিনের পর থেকে আমি যেন অন্য এক মানুষ হয়ে গেলাম। আমি মরে গেলাম না আমার পুনর্জন্ম হলো, কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলাম, জীবনে আমি কিছু একটা ভাল কাজ করেছিলাম যার কারণে মহান করুণাময় আমাকে এমন পুরস্কার দিলেন।

সেই আনন্দ, সেই ভাললাগা, সেই ভালবাসার কথা আমি যতদিন বেঁচে থাকব, আমার মনে থাকবে। অতটুকু ক্ষুদ্র মনের মধ্যে যেই ভালবাসার আধার পরম করুনাময় সৃষ্টি করেছেন, তার মূল্য অপরিসীম।

ছেলেটা আমার অনেক বড় হয়ে গেছে। তার বয়স এখন দশ। এখন সে ভায়োলিন বাজাতে জানে। সকার খেলে। স্কুলেও ভাল রেজাল্ট করছে। মাঝে মাঝে সে আমার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকার খেলা খেলে। আমি তার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনা। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।

সে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার চোখে কি হয়েছে বাবা। কাঁদছ কেন?’

আমি চোখ মুছতে মুছতে বলি, ‘কাঁদি নারে বাপ। কাঁদি না।’

আমার আত্মার একটা অংশ—যেই ভালবাসা আর মহানুভবতা উপরওয়ালা তার হৃদয়ে সৃষ্টি করে দিয়েছেন, আমি তার জন্যে অশেষ কৃতজ্ঞ। ঐ একটা বিকেল আমার জীবনের গতিপথ নতুন করে বদলে দিয়েছে।

ছোট্ট দুটি হাতের মুঠি ভরা কতগুলো কয়েন এখনও আমার জ্যাকেটের পকেটে। আমার মন খারাপের দিনগুলিতে আমি জ্যাকেটের পকেট থেকে কয়েনগুলো বের করে হাতে নিয়ে দেখি। যেই কয়েনগুলো সে তার মানিবক্স খালি করে নিয়ে এসে আমাকে দিয়েছিল, সেই ভালবাসার কয়েনগুলোই আমার জীবনকে এখন পরিপূর্ণ করে দেয়।

আমি নতুন করে বাঁচতে শিখি!

(এই গল্পটি এবারের অমর একুশে বইমেলা ২০২০-এ আনন্দম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘ধূসর বসন্ত’ নামক আমার প্রথম ছোট গল্পের সংকলনে সংযোজিত হয়েছে!)

ফরহাদ হোসেনঃ লেখক,  নির্মাতা ও প্রবাসী বাংলাদেশী, ডালাস, টেক্সাস

আরও পড়ুন