Ads

জাম্প কেডস । অসাধারণ মানবিক মূল্যবোধের গল্প

মনসুর আলম

কয়েক মাস আগে বাসার সামনের বাউন্ডারি ওয়ালের কাজ করাচ্ছিলাম। একদিন দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে দেখতে এলাম মিস্ত্রিরা কী করছে। প্রচণ্ড রোদে গা পুড়ে যাবার উপক্রম। এমনিতেই সেমি ডেজার্ট এরিয়া তারউপর আবার এত রোদ! ইট, বালু, সিমেন্ট নিয়ে কাজ করতে করতে হাপিয়ে উঠেছে একেকজন। পিপাসায় গলা শুকিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। আমি তাদের সাথে কথা বলছিলাম এই সুযোগে ওরা একটু বিরতি নিচ্ছে। চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল কী পরিমাণ তৃষ্ণার্ত ওরা।

পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এক কিশোর ছেলে বড়জোর ১৫/১৬ হবে বয়স। তার একহাতে ছোট্ট একটি কুলার বক্স অন্য হাতে একটি পিতলের ঘন্টা। কুলার বক্সে করে আইস জুস বিক্রি করে। এটিকে ঠিক আইসক্রিম বলা যাবে না। বিভিন্ন ফ্লেভারের জুসকে পলিথিনের ছোটছোট প্যাকেটে ভরে ডিপ ফ্রিজে রেখে বরফ বানানো হয়। প্যাকেটের কোণায় সামান্য ছিদ্র করে ওরা চুষে চুষে খায়। একটু একটু করে বরফ গলে আর ওরা চুষতে থাকে। গরীবের আইসক্রিম বলা যেতে পারে।

প্রচণ্ড রোদের তাপে ছেলেটিও হাঁপিয়ে উঠেছে। এমনিতেই বয়স কম তদোপরি ভারী কুলার বক্স বহন করে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে। দরদর করে ঘামছে ছেলেটি। গায়ের জামা শরীরে লেপ্টে আছে, ঘামে ভিজে একাকার। এত মায়া লাগছিলো দেখতে পাষাণ না হলে যে কারো চোখ আদ্র হবে। কাছে আসার জন্য ইশারা করলাম। খুবই খুশি হয়ে দৌড়ে আসলো। তার মনে আশার সঞ্চার হয়েছে যে কিছু বিক্রি হবে। চোখেমুখে আনন্দ উপচে পরছে। এদিকে ছেলেটির সাথে কথা বলছি দেখে মিস্ত্রি এবং তার সহকারীদের চোখেমুখেও আনন্দের দ্যুতি বয়ে বেড়াচ্ছে। সবার চেহারায় কেমন একটি প্রত্যাশা। একটু খুশির আমেজে পুরো পরিবেশ শীতল হয়ে গেছে এমন একটি ভাব।

হকার ছেলেটিকে বললাম সবাইকে একটা করে আইস জুস দাও। সে খুবই আনন্দ চিত্তে সবার হাতেহাতে একটি করে ধরিয়ে দিলো। টাকা দেবার সময় বললাম একটির দাম বেশি আছে এখানে সেটি তুমি খাবে। এমন একটি হাসি দিলো ; এমনিতেই গায়ের রঙ কালো, রোদে পুড়ে সেই কালো রঙ কুচকুচে কালো হলেও ঘামে ভিজে চিকচিক করছে। হাসির চোটে ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলি মুক্তোর মতো বিচ্ছুরণ ছড়াচ্ছিলো। আমি নিজের হাতে একটি আইস জুস নিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “এটি খেতে খেতে যাও।” কৃতজ্ঞতায় একেবারে নুয়ে পরে ছেলেটি ধন্যবাদ দিতে দিতে বিদায় নিলো। আমি তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছি। একটু দূরে গিয়েই সেই জুসটি আবার সে কুলার বক্সে রেখে দিলো। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গাড়ির হর্ন বাজালাম। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই আবার ডাকলাম-

এই জুস তো আমি তোমার জন্য কিনেছিলাম। এই গরমে তুমি খুবই কষ্ট পাচ্ছো। তোমার ঘর্মাক্ত শুকনা চেহারা দেখে মায়া লাগছে। না খেয়ে আবার রেখে দিলে যে?
– স্যার, কোভিডের কারণে মায়ের চাকরি গেছে, স্কুল বন্ধ। স্কুলে দুপুরের খাবার দিতো এখন সেটিও নেই। জুসটি যদি বিক্রি করতে পারি আরো তিন টাকা বেশি রোজগার হবে। আমার এখন জুস খাওয়ার চেয়ে পরিজ কেনা বেশি প্রয়োজন।
আহারে জীবন! এইটুকু ছেলে। কী অবলীলায় লোভ সংবরণ করলো। প্রচণ্ড পিপাসা থাকার পরেও জুসটি রেখে দিলো বিক্রি করার জন্য।
– তুমি এখানে আমার সামনে বসে জুস খাওয়া শেষ করে তারপর যাবে। এটির টাকা তো তুমি পেয়েছো, তাই না?
– স্যার, আমাকে টেক্সি স্ট্যান্ডে যেতে হবে। এখানে বসতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। প্লিজ, আমি যাই।
– না, তুমি এখানে বসেই খাবে। আমি তোমাকে টেক্সি স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে আসবো। পায়ে হেঁটে গেলে তোমার অনেক দেরী হতো, আমি তোমার সেই সময় বাঁচিয়ে দিচ্ছি। আর এদের সবাইকে আরো একটি করে আইস জুস দাও।
মানুষ এতটা খুশি হতে পারে এই ছেলেকে না দেখলে জীবনের আরেকটি অধ্যায় দেখা বাকী থেকে যেতো। ছেলেটির এই সীমাহীন আনন্দ দেখে অনেক বছর আগের একটি স্মৃতি মনে পড়লো।

আমি গ্রামের ছেলে। কৃষি প্রধান এলাকায় বছরে একবার মাত্র চাষাবাদ হয়। বর্ষাকালের পুরোটা সময় চারিদিকে অথৈ জল, হাওড় ভর্তি পানি। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই কর্মহীন। বর্ষাকালে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নেই। দলবেঁধে আড্ডা মারা, মাছ শিকার, মার্বেল খেলা, কাবাডি খেলা, ক্যারাম খেলা, নৌকা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর তেমন কিছুই করার নেই অধিকাংশ মানুষের। কিছু মানুষ হাওড়ে মাছ ধরে সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে চাল, ডাল, তেল, নুন ইত্যাদি কিনে নিয়ে আসেন। বছরের এই সময়টায় মাছ বিক্রি করেই চলে তাদের পুরো পরিবারের ভরনপোষন।
আমি তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। এক বাড়িতে গিয়েছিলাম চিঠি লিখতে। আসার সময় দেখলাম পাশের ঘরে ছোট্ট একটি ছেলে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না করছে। তার বাবা তাকে ধমকাচ্ছেন কিন্তু, তার কান্না থামছে না।

দরিদ্র পরিবার, মাছ বিক্রি করেই সংসার চলে। আজ তার বাবা একটি বড় মৃগেল মাছ ধরেছেন। এখন বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন বিক্রি করার জন্য। সবগুলো মাছ বিক্রি হলে ঈদের জন্য কিছু কেনাকাটা করবেন। আগামীকাল ঈদ অথচ ঘরে কিছুই নেই। ঈদের আগের দিন খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরী একধরনের পিঠা আমাদের এলাকার ঐতিহ্য। যতই দরিদ্র পরিবার হোক না কেন সেই পিঠা করবেই করবে। বাবা/মা ছেলেকে বুঝাচ্ছেন মাছ বিক্রি না করলে টাকা আসবে কোথা থেকে? ছেলে বায়না ধরেছে মৃগেল মাছের মাথা খাবে। হায়রে কান্নাকাটি করছে ছেলে! কোনো অবস্থাতেই সে মাছটি বিক্রি করতে দিবে না। তার বাবাও নিরুপায়, কিছু টাকা চাই ই চাই। পরিস্থিতি দেখে মনে হলো ছেলের মায়ের মৌন সম্মতি আছে এই কান্নাকাটিতে। আহারে বেচারি! মনে হয় ওনারও ইচ্ছা হয়েছে মাছের মাথা খাবেন।

মাত্র কয়েকদিন আগেই বৃত্তির টাকা তুলেছি। এক টাকাও খরচ করিনি। নতুন নোট খচখচ করছে পকেটে। আমার সাধ ছিলো একটি কেডস কিনবো। টিভিতে যখন জাম্প কেডসের বিজ্ঞাপন দেখি ইচ্ছে হয় ঝাপটা দিয়ে টিভি থেকেই নিয়ে নেই। কয়েকদিন পরেই শহরে যাবার কথা। আমার স্বপ্নের জুতা কেনার জন্য অপেক্ষা করছি। বৃত্তির টাকা সবসময় পকেটেই থাকে।

কাল ঈদ, এই ছেলের কান্নাকাটি আমার মগজে আঘাত করছিলো। আমার স্বপ্নের কেডস কিন্তু, একটি বাচ্চা ছেলের এই মাটিতে গড়াগড়ি দেখে আমি হতভম্ব হয়ে যাই, আমার সকল অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। জীবনের সেরা কেনাকাটা বোধহয় সেদিনই করেছিলাম। সবগুলো মাছ কিনে ফেললাম ওনার হাঁকানো দামেই। কোনো দামাদামি করিনি। মৃগেল মাছটি মহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “ভাবী, মজা করে রান্না করবেন, মাথাটি আপনারা তিনজনেই ভাগাভাগি করে খাবেন।”

বাকী ছোট মাছগুলি নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম। আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না; সেই পরিবারের চোখেমুখে আমি যা দেখেছি এমন কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। সারারাত ঘুমোতে পারিনি আনন্দের ঠেলায়। সামান্য এটুকু কাজ করলেই যদি একটি পরিবার এতটা খুশী হয় – একটি কেনো কেডসের পুরো ফ্যাক্টরি পেয়ে গেলেও আমি এরকম শান্তি পেতাম না।

লেখকের অন্যান্য লেখা

বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানা থাকুক একসাথে

লেখকঃ সাহিত্যিক ও প্রবাসী বাংলাদেশী,  সাউথ আফ্রিকা

আরও পড়ুন