Ads

ত্রী চক্রযানে ঘোরে জীবনের গল্প-১

ফারহানা শারমীন জেনী 

মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনের গল্পটা রোজকার। এরমাঝে বিলাসি মন খোঁজে মুক্তির বাতাস। এই মুক্ত বাতাসের খোঁজে মা মেয়ে বেড়াতে বেড় হয়েছিলাম সন্ধ্যার ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোতে রিক্সা ভ্রমণে। প্রাত্যহিক রোজনামচার পাতাটা একটু নতুন করতে এটা আমার নিত্যদিনের প্রয়াস।
ভদ্রার মোড়ে অতিথি হোটেলের চা সত্যি মনোমুগ্ধকর। মেয়ে শখ করে বললো সে এককাপ চা খাবে সেখানে। নেমে গেলাম ভদ্রার মোড়ের স্পেশাল চা খাওয়ার উদ্দেশ্যে।আমার আবার স্বভাব “যেই ভাবা সেই কাজ”।

তবে আজকের গল্পটা কিন্তু মা মেয়ের বেড়ানোর গল্প নয়।আজকের গল্পটা এক সাদাকালো জীবনে রঙিন স্বপ্ন পূরণের পথে ত্রিচক্রযানে প্যাডেল চালিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প।

চায়ের ওয়ানটাইম কাপ হাতে নিয়ে একটা রিকশায় উঠলাম।প্যান্টশার্ট পরিহিত রিক্সাচালকের সংখ্যা এখন অনেক বেশি। সুতরাং অবাক হওয়ার মতো কোন বিষয় নয় পরিপাটি চালক দেখে। মা মেয়ে অনেক হিসাব নিকাশ মিলাতে মিলাতে যাচ্ছি। কোথায় কোথায় হিসাবের অংকটা টেনে ধরে আরেক জায়গায় বসালে আরেকটি হিসেবের অংক মিলে যাবে এসব নিয়ে চলছে জীবনের সরল অংকের আলোচনা।এরমাঝে দু-দুবার শ্যামলী এবং হানিফ বাস খুব বেপরোয়া আমাদের রিক্সাটাকে ওভারটেক করে গেল। আমি আর আমার মেয়ে রিকশা চালক ছেলেটিকে সাবধানে চালাতে বলে সাথে ব্যাঙ্গ করে বললাম আমার শ্যামলী আর হানিফ দেখলেই মনে হয় বাসের মাথায় সবসময় জানকবজের ফেরেশতা বসে থাকে। আর সাথে এও বললাম তাকে যে আপনি সময়ের চাইতে জীবনের মূল্য বেশি মনে রাখবেন। তখন ছেলেটি বলছে ” ঠিক বলেছেন ম্যাডাম।গত মাসে একটি চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় যাচ্ছিলাম একটা নিম্ন রেটের বাসে তখন যে কিভাবে গিয়েছি তা বলার মতো নয়।সেই আমার প্রথম ঢাকা যাওয়া।ফেরার সময় সিদ্ধান্ত নিলাম যা থাকে কপালে ট্রেনেই ফিরবো রাজশাহী। ” তার বলা চাকরির পরীক্ষা শব্দটা আমার মস্তিষ্কের নিউরনে বেশ সাড়া জাগালো।

আমি হঠাৎ তার বিষয়ে খুব ঔৎসুক হয়ে উঠলাম। আমি জানতে চাইলাম কোথায় সে চাকরির পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল? সে জানাল যে মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় গ্রেডের একটি সহকারী পোস্টে। যখন সে পোস্টের গ্রেড সহ উল্লেখ করল তখন আমি আরও ঔৎসুক হয়ে উঠলাম। জানতে চাইলাম পড়া লেখা কতদূর? সে বললো রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৩.২৫ পেয়ে মাস্টার্স পাশ করেছে।
তার জীবনের গল্প শোনার নেশায় পেয়ে বসলো আমাকে।

আমি তাকে বললাম কিছু মনে করবানা বাবা আমি তোমাকে তুমি করে বলছি কারণ তুমি আমার ছাত্রসম।আমি সবসময় রিকশা বা অটোচালক সে যে বয়সেরই হোক আপনি সম্বোধন করি।তখন সে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললো ম্যাডাম সবাইত তুমি বলে আপনিত আমাকে প্রথমে আপনি বলেছেন এখন স্নেহের প্রতিশব্দ হিসেবে তুমি বলছেন এটা আমার পরম পাওয়া। ছেলেটি আমাকে ম্যাডাম বলছে এটিও তার প্রতি আমার দূর্বলতার অন্যতম কারণ প্রথম থেকে কারণ এইযে হালের ম্যাম শব্দটির সাথে আমার ভিষণ শত্রুতা। আমি তার নাম জানতে চাইলাম।সে তার নাম মুকুল (ছদ্ম নাম, সঙ্গত কারণে আসল নামটা বলতে চাইছি না,কারণ যদি কখনও সে এটি পড়ে তার লজ্জা লাগতে পারে,যদিও সে তার জীবনের গল্পটা আমাকে বেশ গর্বের সাথে বলেছে সংক্ষেপে হলেও সম্পূর্ণ একটা গল্প,কিছু আমার কল্পনার আঁচড়ও আছে) বলে জানালো।তার বাবা দাদার পরিবারে কোন শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলো না।তার দাদা পরের জমিতে বর্গা খেটে নিদারুণ কষ্টে সৃষ্টে তিন ছেলে পাঁচ মেয়েকে একটুকরো মাথাগোঁজার ঠাঁই সহ মানুষ করেছেন। মুকুলের বাবা তার দাদার বড় ছেলে।পাঁচটি মেয়েকে বিয়ে দিতে যেয়ে তার বাবা আর দাদার মাথার ঘাম পায়ে পড়েছে। সে সময় কিস্তিতে ঋণের সিস্টেম ছিলোনা বটে তবে কিস্তির চাইতেও ভয়াবহ ছিল জমিদারের কাছে থেকে চড়া সুদে অগ্রীম টাকা লেনদেন। যা কখনও শোধ হতো না।বর্গাচাষীদের রক্ত শোষণ করে তারা তাদের সম্পদের পাহাড় গড়ত।আল্লাহ সুদকে করেছেন হারাম আর ব্যবসাকে করেছেন হালাল এবং সুদ দাতা এবং গ্রহিতা উভয়ে কঠিন ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে কুরআনে এসেছে। সে সময়ের সেসব জমিদাররাও ছিলেন বেশ নামাজি, কারও কারও নামের সাথে হাজীও ছিলো অথচ গরিবদের রক্ত চুষে খেতে তারা বোধহয় নিজের সন্তানকেও ছাড় দেন না যদি তারা বিপদে পড়ে। যাইহোক এভাবে চলতে থাকলে কখনোই তারা উঠে দাঁড়াতে পারবেনা সেসব ভেবে মুকুলের বাবা ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যবসা শুরু করলে তাদের অবস্থা বিপদ কাটিয়ে মোটামুটি ভালোর দিকে আসে। পাঁচ ফুফুর ভালো বিয়ে হয়ে যায়,ছোট দুই চাচা বড় হয়ে মুকুলের বাবার সাথে ব্যবসা করে তারাও আয় রোজগার শুরু করে। কিন্তু বংশে কোন শিক্ষার আলো নেই। মুকুল বংশের বড়ো সন্তান। তার যখন চার বছর বয়স তখন তাকে মক্তবে দেয়া হয়।সেখানে মক্তবের হুজুর সহ অনেকেই খেয়াল করেন মুকুল বেশ মেধাবী। বাড়ি থেকে নিকট দূরে বাঁশ আর চাটাই দিয়ে ঘেরা স্কুল থেকে যখন ভেসে আসতো অ-তে অজগর, অজগর ঐ আসছে তেড়ে তখন সেও ছাগল চরাতে চরাতে ওদের সাথে সুর মেলাতো।প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের তখনও তেমন আয় রোজগার ছিলো না ঠিকই কিন্তু তারা ছিলো সমাজের নিবেদিত প্রাণ। তারা এক একটি ছাত্রকে এক একটি জ্ঞানের প্রদীপ বলে ভাবতেন। হঠাৎ করেই গ্রামের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও প্রাইমারির হেড শিক্ষকের চোখে পড়ে যায় মুকুলের এই একাগ্রতা। তারা সবাই মিলে মুকুলের বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করে তার সন্তানটিকে স্কুলে দেয়া হোক।বড়াইগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ খেঁটে খাওয়া মুকুলের বাবার এক কথা চাষার ছেলে পড়া লেখা শিখে কি করবে?বরং কাজ শিখুক কিছু হিসাব নিকাশ শিখুক আর মক্তবে নামাজ ও আমপারা শিখতে পারা অনেক বড়ো। সবাই হাল ছাড়লেও পাশের বাড়ির প্রতিবেশি চাচা জীদ ধরে বসলেন যে না আমি মুকুলের পড়ার দায়িত্ব নিবো

প্রতিবেশী সেই চাচা মুকুলকে নিয়ে যেয়ে ভর্তি করলেন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। মুকুলের সেই আনন্দ তখন মনে। সকাল সকাল মা দাদি গরম ভাত খাইয়ে স্কুল পাঠালেন।কিন্তু খুশি হতে পারলেন না মুকুলের বাবা চাচারা।কারণ এতোগুলা ছাগল দেখার জন্য পয়সা খরচ করে লোক রাখতে হবে এ বিষয়ে তাদের ভিষণ আপত্তি। তখন মুকুলের দাদি বললো “আমি তোদের ছাগল দেখবো। তোদের এনিয়ে এতো ভাবতে হবে না।”
ছেলেরা সাথে সাথে তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলো।তারা বললো যে আমরা গরীব হতে পারি কিন্তু আমাদের বংশের একটা মর্যাদা আছে। মহিলারা কখনও ছাগল চরাতে যায় না।

সাথে সাথে মুকুলের দাদি তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলো।তিনি আর্তনাদের মতো করে বলে উঠলেন –

“আমার বংশে শিক্ষার বাতি জ্বালতে দেয়নি তোর বাপ দাদারা কিন্তু আমার পাশে এখন গ্রামের মানুষ আছে। আমার বংশের ধারা মুকুল দিয়েই শুরু হবে শিক্ষার ধারা।আমার নানা ছিল পন্ডিত, ছোটবেলায় তিনি আমাদের পুঁথি পড়ে শোনাতেন সেখানে শুনেছি শিক্ষা জাতীর মেরুদন্ড। মেরুদন্ড মানে বুঝিস গন্ডমূর্খের দল,আর তোরা বুঝবি কি করে ঘাড়ের ওপর পাঁচবছর বয়স থেকে আদিপুরুষেরা চাপিয়ে দিয়েছে গরু ছাগলের দায়িত্ব। “

ছেলেরা মায়ের কথা শুনে হা করে তাকিয়ে থাকল মায়ের দিকে,তারা বুঝে উঠতে পারছে না সারাজীবন মুখ বুঁজে সব কষ্ট এই সংসারের ঘাণী টেনে যাওয়া মা আজ এত সরব হলো কিভাবে। ছেলেদের নিজের মনের মতো করে শিক্ষার আলোয় মানুষ করতে না পারার চাপা ক্ষোভ এভাবে আগ্নেয়গিরির লাভা হয়ে উদগীরণ হবে তা মুকুলের বাপ চাচারা বুঝে ওঠেনি।

লেখকঃ শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সহ-সম্পাদক, মহীয়সী

আরও পড়ুন-

যিনি ছিলেন দুই খলিফার স্ত্রী

আরও পড়ুন