Ads

জীবনের টানা পোড়েন

এইচ এম গিয়াস উদ্দিন

মোরা আর জনমে হংস–মিথুন ছিলাম
ছিলাম নদীর চরে
যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে।

গানটি চোখ বুঝে শুনছিলেন কামাল সাহেব। তাদের দুই ছেলে পড়াশুনার জন্য বর্তমানে আমেরিকায় থাকে। কিন্তু নিয়মিত মা-বাবার খোঁজ রাখে, কথা হয়। কামাল সাহেব গানের মধ্যে ডুবে আছেন। এমন সময় স্ত্রী রেহেনা বেগম এসে বলছে, আমি আর কাজ করতে পারব না। কামাল সাহেব চোখ না খুলেই কেন, কী হয়েছে? রেহেনা বললেন, “কী হয়েছে তুমি কী বুঝবে! আমাকে তো ঘরের চাকর পেয়েছ। সব কাজ আমাকে দিয়েই করাও। কতদিন ধরে বলছি একটি কাজের মেয়ে এনে দাও তার দিকে তোমার খেয়াল নেই।” কামাল সাহেব বললেন, “আমি কী কোনো কাজ করে দেবো?” এ কথা শুনে রেহেনা বেগম চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “না থাক হয়েছে আমাকে কাজ করে সাহায্য করতে হবে না। গত সপ্তাহে কাপ ধুতে গিয়ে আমার দামী একটি কাপ ভেঙে ফেলেছ। একটি কাজের মেয়ে এনে দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।” কামাল সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার যে কোকিল কণ্ঠ আর যে, তাড়া তাতে করে কাজের লোক টিকতে পারে না।” এ কথায় কামাল সাহেব যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। রেহেনা বেগম বললেন, “আমি তো হাতে লাঠি নিয়ে বসে থাকি ওদের তাড়ানোর জন্য তাই না! তুমি কী বুঝবে সংসারের কাজ কীভাবে করিয়ে নিতে হয়! ওরা সব ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে। আমি শুধু দেখে রাখি এটাই আমার দোষ!” কথাগুলো বলে রেহেনা বেগম হাফাতে লাগলেন। কামাল সাহেব বুঝলেন অবস্থা বেগতিক। তিনি বললেন, “দেখি অফিসের মাসুদকে বলে যদি কোনো কাজ হয়!”

কয়েকদিন পর মাসুদ একটি মেয়েকে কামাল সাহেবের বাসায় দিয়ে যায়। কামাল সাহেব মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেন, “তোমার নাম কি? তুমি কী ঘরের কাজ সব পারবে?”
“আমার নাম নীলা। আমি ঘরের সব কাজ পারব।”
রেহেনা বেগম বললেন, “সকাল থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত সব কাজ করে দিয়ে যেতে হবে। পারবে তো?”
“জি আন্টি পারব। কাজটি আমার খুব প্রয়োজন।”
যেহেতু পরিচিত মানুষ মারফত আনা হয়েছে এবং কাজের লোক দরকার তাই কামাল দম্পত্তি আর বেশি প্রশ্ন না করে মেয়েটিকে রেখে দিলেন।
পরেরদিন সকালবেলা নীলা এসে কামাল সাহেবকে বলেন, “আংকেল আপনাদের কি ডায়াবেটিস আছে?”
“হ্যাঁ। আমাদের দুজনেরই অতিমাত্রায় ডায়াবেটিস আছে।”
“আমি আপনাদের চা করে দিচ্ছি। আপনারা চা খান এর মধ্যে ব্রেকফাস্ট তৈরি করি।”
ব্রেকফাস্ট কথাটি শুনে রেহেনা বেগম কামাল সাহেবকে বললেন, “দেখো মেয়ের ঢং নাস্তাকে ব্রেকফাস্ট বলে।” কামাল সাহেব বললেন, “শহরের বিভিন্ন বাসায় কাজ করে তাই কথায় স্মার্টনেস আছে।”
“স্মার্টনেস না ছাই। আমি গিয়ে দেখি রান্নাঘরে আবার কী করে!”
“তোমার ওদিকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মেয়েটিকে তাড়ানোর ব্যবস্থা কোরো না।”
“ও, আমি শুধু সবাইকে তাড়াই! ওরা গরীব ঘরের মানুষ। যদি কিছু চুরি করে নিয়ে যায়!”
“ওকে দেখে আমার তেমন মনে হলো না।”
তোমার মন সরল তাই সবকিছু সরল দেখো। এখন কাজের মেয়েরা ঘরের মানুষদের খাবারের ভিতর বিষ মিশিয়ে দিয়ে হত্যা করে সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়। তাই চোখে চোখে রাখতে হয়।
তোমার সাথে কথায় পারব না। তবে ও কিন্তু তেমন না।
দুপুরে খেতে বসে কামাল সাহেব বললেন, নীলা তোমার হাতে যাদু আছে। অনেকদিন পর এমন খাবার খেলাম।
নীলা কামাল সাহেবকে ধন্যবাদ জানালে রেহেনা বেগম বললেন, আদিখ্যেতা সব।

এভাবে ভালোই চলছিল। রেহেনা বেগমের কথাকে কানে না নিয়ে নীলা বেশ কাজ করে যাচ্ছিল। একদিন কামাল সাহেব হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার হাত-পা কাঁপছিল। রেহেনা বেগম খুব টেনশনে পড়ে যান। নীলা তা দেখে দ্রুত এক গ্লাস চিনির শরবত কামাল সাহেবকে খাইয়ে দেয়। রেহেনা বেগম বলেন, তুই কী খাওয়ালি? নীলা উত্তরে বলে, চিনির শরবত। রেহেনা বেগম চিৎকার করে বলেন, তুই জানিস তার ডায়াবেটিস আছে তার মধ্যে চিনির শরবত খাইয়ে মারার প্ল্যান করেছিস? তারপর আমাকে মেরে ঘরের সব নিয়ে চম্পট দিবি? নীলা চুপ করে থাকে। রেহেনা বেগম তাদের ডাক্তারকে ফোন দিলে ডাক্তার এসে কামাল সাহেবকে বলেন, কী অসুবিধা হচ্ছে এখন?
কী হয়েছে বুঝলাম না। কাল রাতে কিছু খাওয়া হয়নি।
রাতে ইনসুলিন নিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। প্রতিদিনের মতোই নিয়েছি।
সেটাই ভুল হয়েছে। ইনসুলিন নেয়ার পর খাবার না খাওয়ার কারণে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে গিয়েছে। এটা খুব মারাত্মক। সুগার ফলের কারণেই ডায়াবেটিসের রোগীরা বেশি মারা যায়।
রেহেনা বেগম বললেন, এমনিতেই সুগারের সমস্যা তার মধ্যে কাজের মেয়েটি এক গ্লাস চিনির শরবত খাইয়েছে।
ডাক্তার বললেন, চিনির শরবত? ডাকুন তো মেয়েটিকে একবার।
নীলা এসে চুপ করে মাথা নিচু করে রাখে। ডাক্তার বলেন, এই মেয়েটির কারণে এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন। সুগার কমে গেলে যা করণীয় মেয়েটি তা করেছে। দেরী হলে আমারও কিছু করার থাকত না।

কামাল সাহেব নীলাকে কাছে ডেকে বললেন, বলতো মা তুই কে? তুই অন্যদের মতো বাসায় করা কাজের লোক না। নীলা চোখের পানি ফেলে বলে, আমি আগে কখনো কোনো বাসায় কাজ করিনি। আমার বাবা একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতো। আমার ছোটো ভাই স্কুলে, আমি এমএসসি ফার্স্ট ইয়ারে পড়তাম। গত বছর করোনায় বাবার চাকরি চলে যায়। সংসারের টেনশনে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। জমা যা ছিল তা বাবার অসুখে এবং সংসারে খরচ হয়ে গেছে। বাবা আমাদের ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াতেন। এ অবস্থায় ভাইকে পড়ানো এবং সংসার দেখার জন্য কোনো চাকরিও পাচ্ছিলাম না। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। ভাইকে পড়াতে হবে, সংসার চালাতে হবে। তাই এ কাজটি পেয়ে আর না করিনি।

কামাল সাহেব বললেন, সত্যিই করোনায় শুধু প্রাণে মারছে না, ধনেও মারছে। কত সংসার জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আমরা সত্যিই খুব অসহায় হয়ে পড়েছি।

ডাক্তার বললেন, “আমাদের এতদিনের পাপকর্মের ফল আজ প্রকৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতি বদলা নিচ্ছে। আমরা আপনজকে কাছে আসতে দিইনি। মানুষকে ভালোবাসিনি ফলে আমাদের ঘরবন্দি করে দিয়েছে। আচ্ছা এখন যাই। কাল এসে একবার দেখে যাব।”
রেহেনা বেগমের চোখে পানি এসে যায়। তিনি নীলাকে কাছে নিয়ে বলেন, “আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস। চারিদিকে যে অন্যায় ঘটে তা দেখে মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতে পারিনি। অভাবে পড়ে কাজে এসেছিস। অথচ তোকে অনেক মন্দ কথা বলেছি। তুই মুখ বুঝে সব কাজ করে গেছিস। আজ থেকে তোদের সংসার, তোর এবং তোর লেখাপড়ার দায়িত্ব আমাদের। আমরা খুব স্বার্থপর হয়ে গেছি। আমরা শুধু নিজেদেরকে নিয়েই ভাবি।
নীলার চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝরে…”

লেখকঃ সাহিত্যিক ও অ্যাডমিন, সাহিত্য তরী

জীবনের টানা পোড়েন গল্পের সাথে লেখকের আরও লেখা পড়ুন-

রমজানে মায়ের দেওয়া শিক্ষা

( জীবনের টানা পোড়েন অসাধারণ একটা গল্প, জীবনের টানা পোড়েন গল্পের লেখক এইচ এম গিয়াস উদ্দিন )

আরও পড়ুন