Ads

তৃতীয় পক্ষ

।। শেলী জামান খান ।।
(১)
অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজছে, ক্রিং ক্রিং ক্রিং। রাহেলা বেগম তার বিছানায় শুয়ে কান খাড়া করে সেই শব্দ শুনছেন।তিনি জানেন, এই মূহুর্তের আগন্তুক কারা।কে আসছে তার সংসারে। আজ সারাদিন ধরেই তিনি তাদের আগমনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন।আসলে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে মাসখানেক আগে থেকেই। তবুও কলিং বেলের কর্কশ শব্দটি যেন তার বুকের ভেতরের হৃপিন্ডের উপর হাতুড়ির মত বাড়ি দিতে লাগল। একেকটা আঘাতে হৃপিন্ডটি যেন থেঁতলে যাচ্ছে। সেই থেঁতলানো মাংসপিন্ডটির বিভিন্ন অলিন্দ থেকে ছিটকে পড়া রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীরের অভ্যন্তর। ফুসফুস, যকৃত, পাকস্থলি। রাহেলা বেগমের স্বাসকষ্ট হতে লাগলো। সারা শরীর গুলিয়ে বমি বমি ভাব হল। সমস্ত শারীরীক ও মানসিক কষ্টকে দাঁতে দাঁত চেপে দমন করে তিনি নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন কাজের মেয়েটি গিয়ে দড়জা খুলবে।
কাজের ছুটা বুয়াটা তার হাতের কাজ গুছিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে অনেকক্ষণ হল। তিনি বুয়াকে অনুরোধ করেছিলেন আরও ঘন্টা দু’য়েক অপেক্ষা করে যেতে। নতুন মানুষটিকে বরণ করতে। কিন্তু তার ছোট মেয়ে আসমা’র জ্বরের দোহাই দিয়ে সে চলে গেছে ঘন্টাখানেক হল। বলে গেছে, সে টেবিলে সাহেব আর নতুন বেগম সাহেবার খাবার-দাবার সাজিয়ে রেখে গেছে। বাকী যা করার তা সার্বক্ষণিক কাজের মেয়ে মিনা সামাল দিতে পারবে। নতুন বউ আসা উপলক্ষ্যে আজ বাসায় ভালো রান্না-বান্না হয়েছে। রাহেলা নিজেই বলেছেন পোলাউ, মুরগীর রোস্ট, খাসির রেজালা, ডিমের ঝালভূনা আর পায়েস করতে।ড্রাইভারকে দিয়ে মিষ্টির দোকান থেকে দুই বাক্স মিষ্টি আর দইও আনিয়ে রেখেছেন।তারপর মনে করে সময়মত ড্রাইভারকে সদরঘাট লন্চঘাটে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অসাড় দেহে বিছানায় পড়ে থাকলেও আয়োজনের কোন কমতি রাখেননি রাহেলা।
এতক্ষণে কলিং বেলের শব্দ থেমে গেছে। দরজা খোলার শব্দও শোনা গেল। মিনাকে বলা আছে দরজার পিপহোল দিয়ে আগন্তুককে ভালভাবে দেখে পরিচিত হলেই তবে দরজা খুলতে। অপরিচিত চেহারার কাউকেই দরজা না খুলে দিতে। তাছাড়া বাসায় অপরিচিত নতুন কোন আগন্তুক এলে ইন্টারকমে অনুমতি না নিয়ে উপরে পাঠানোরও নিয়ম নেই। তবুও সাবধানের মার নেই। যে কোন সময় যে কোন দূর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়।মিনা প্রায় দুই বছর ধরেই তার কাছে আছে।বাপের বাড়ির গ্রাম থেকে বারো বছর বয়সি মেয়েটিকে তিনি নিজের কাছে এনে রেখেছেন। পরিচিত জেনেই গরীব বাবা-মা নিশ্চিন্তে রাহেলার হাতে তাদের মেয়েটিকে তুলে দিয়েছিলেন।
(২)
বোঝা যাচ্ছে নতুন বৌকে নিয়ে জামিল সাহেব ঘরে ঢুকেছেন। জামিল সাহেবের অনুচ্চ কণ্ঠের কথাবার্তা ভেসে আসছে ড্রইংরুম থেকে। তিনি মিনা’কে বলছেন, ‘মিনা, নতুন বেগম সাহেবার সুটকেসগুলো আমার ঘরে নিয়ে রেখে আয়তো।’
তারপর নতুন বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘পারুল, তুমি মিনার সাথে ঘরে যাও। কাপড়-চোপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে নাও।আমি নিজেও ফ্রেস হয়ে নিচ্ছি।’
‘বড় বুবু’র সাথে আগে দেখা করতে হবে না?’
‘না, না, এখন না। বাইরের কাপড়-চোপড় নিয়ে ওর ঘরে যাবার নিয়ম নেই।আগে ফ্রেস হয়ে নাও। পরে দেখা করা যাবে।এমনিতে তার দুর্বল শরীর। তাই বাড়ির সবাইকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নভাবে থাকতে হয়। যাতে ওর কোন ইনফেকশন না হয়।’
রাহেলা চুপচাপ শুয়ে রইলেন। তার দু’চোখ বেয়ে অবিরল ধারায় অশ্রুপাত হতে লাগলো। তিনি টের পেলেন, বুকের ভেতরে হৃপিন্ডটি যেন হাপর টানার মত করেই দ্রুত সংকুচিত আর প্রসারিত হচ্ছে। এই অতিরিক্ত পরিশ্রমে তার শরীর অল্পক্ষণেই ক্লান্ত এবং নিস্তেজ হয়ে পড়ল।ডানদিকের বেডসাইড টেবিল থেকে ইনহেলারটি নিয়ে তিনি ক্রমাগত শ্বাস টানতে শুরু করলেন।তিনি মনেমনে প্রমাদ গুনলেন, লম্বা জার্নি করে সবে নতুন বৌ নিয়ে জামিল ঘরে ফিরেছে, আজ রাতে তাদের বাসর হবে, এই মূহুর্তে অসুস্থ হয়ে দৌড়াদৌড়ি, ডাক্তার ডাকা বা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হবার মত বিড়ম্বনা তিনি দিতে চান না মানুষটাকে। নিশ্চয়ই সে অধীর আগ্রহে ছোট্ট, কচি, অনাঘ্রাত নতুন বউটি নিয়ে বাসর গড়ার স্বপ্ন দেখছে। কাবাব মে হাড্ডি বনার কোন ইচ্ছেই তার নেই। তাই তড়িঘড়ি করে তার জন্য রাতের নির্ধারিত ঔষধপত্র আর ঘুমের বড়িটি খেয়ে নিলেন রাহেলা। যত দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে সক্ষম হবেন, ততই বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে পারবেন।
চোখ জোড়া বুজে আসতে আসতে রাহেলার মনে পড়ে গেল তাদের বিয়ের রাতটির কথা। সেও এমনি কচি, অনাঘ্রাত এক কিশোরি বধু হয়েই একদিন জামিল সাহেবের ঘর করতে এসেছিলেন। যদিও বয়সে জামিল তার প্রায় দশ বছরের বড় ছিলেন। আর এই মেয়েটির সাথেতো জামিলের বয়সের ফারাক প্রায় চল্লিশ বছরের। মেয়েটি জামিলের কন্যার বয়সি। বাচ্চা মেয়েটির প্রতি কোন ঈর্ষা নয় বরং একধরনের মমতা অনুভব করলেন রাহেলা।
বিয়ের রাতের সাজগোজ, একজন পূর্নবয়স্ক পুরুষের সাথে এক ঘরে, একই বিছানায় শোয়া। বুকের ভেতর অজানা ভয়, লজ্জা, সংকোচ। শরীরে একজন পুরুষের স্পর্শ, তার সামনে অনাবৃত হওয়া, প্রথম সহবাস। কতশত স্মৃতি।কত রাগ, অভিমান, জীবনযুদ্ধ, মনভাঙ্গার গল্প জমে জমে স্তুপিকৃত হয়ে উঠেছে এই তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবনে। জলভরা চোখে, পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে রাহেলা বেগম গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।তার আর নতুন বৌটির সাজগোজ, আড়ষ্ঠতা, স্বামীর সচকিত চাহনি, অধির অপেক্ষা নিজের চোখে দেখতে হল না।
(৩)
বিয়ের জাঁকজমকপূর্ণ, দামি পোশাকটি খুলে ফেলে জামিল সাহেব একধরনের স্বস্তি পেলেন।তার বয়স বেশী এবং এটি তার দ্বিতীয় বিয়ে।কিন্তু এই মেয়েটির বয়স নিতান্তই কম এবং প্রথম বিয়ে। তাই একেবারে সাদামাটা পোশাকের বর দেখে সঙ্গত কারনেই মেয়েটির মন খারাপ হতে পারে। এসব ভেবেই জামিল সাহেব একটি ঘিয়ে রঙের শেরওয়ানী ভাড়া করে লুকিয়ে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন।দোকানদার প্রায় জোড় করেই একটি পাগড়িও ধরিয়ে দিয়েছিল। জামিল সাহেবের ইচ্ছে ছিল শেরওয়ানীটি বদলে সাধারণ কোন পোশাক পরে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পর নতুন শ্বশুড়বাড়িতে পোশাক বদলের জন্য তিনি হাতে পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ পাননি। পথে দেরী হয়ে যাবে বলে সাত তাড়াতাড়ি রওনা হতে হয়েছিল।তাছাড়া শ্বশুড়বাড়ি বসেই নতুন জামাইয়ের বিয়ের পোশাক বদল করে সাধারণ পোশাক পরা দৃষ্টিকটু দেখাবে বিধায় ঘটকসাহেবও বাঁধ সাধলেন।তবে মাথার সোনালি জরিদার পাগড়িটি যেমন গোপনে সাথে গিয়েছিল তেমনি গোপনেই ফিরে এসেছে।
ফিরতি পথে তার মনে সারাক্ষণ একটি মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। খানিকটা খুঁতখুঁতে অস্বস্তি থাকলেও একধরনের ভালো লাগাও তাকে শিহরিত করছিল। পোশাক বদল করে হাতমুখ ধুয়ে তিনি তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে সাথে নিয়ে রাহেলার সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি বিপরীত দিকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অপেক্ষা করলেন। যদি রাহেলা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে এদিকে দিক পরিবর্তন করে। কিন্তু রাহেলার মধ্যে নড়াচড়ার কোন লক্ষণ দেখতে না পাওয়ায় তিনি বিছানার পাশে রাখা চেয়ারটিতে বসলেন।তারপর অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে, ঘুমন্ত স্ত্রীর কপালে আলতো করে হাত রাখলেন। বহুদিন হয় স্ত্রীর শরীরের স্পর্শ থেকে বন্চিত তিনি।শারীরীক কোন সম্পর্কতো দূরের কথা, পাশে বসে শেষ কবে তার হাত ধরে কথা বলেছেন তাও তার মনে পড়ে না।যদিও খানিকটা দেরী হয়ে গেলেও স্ত্রীর যথাযথ চিকিৎসার দায়িত্ব তিনি পালন করে যাচ্ছেন।
ঘুমের মধ্যেই রাহেলা বিরবির করে কিছু বললেন, তারপর ঘুরে সোজা হলেন।রাহেলাকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে জামিল সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আজকের রাতটা আর অসুস্থ স্ত্রীর মুখোমুখি হতে হচ্ছে না ভেবে যেন একধরনের পরিত্রান পেলেন তিনি। নতুন স্ত্রীকে বের হয়ে আসতে ইশারা করে, নিজেও ওষুধ আর ফিনাইলের কড়াগন্ধ ভরা ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন।
আজ রাতে তার জীবনে দ্বিতীয়বার বাসর হচ্ছে। তিনি নিজের বিছানায় এসে বসলেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই কেবল পৃথকশয্যা নয়, পৃথকঘরে বসবাস করছেন তিনি। তবে রাহেলার এই দূরারোগ্য অসুখটা ধরা পড়ার কিছু আগেই এই ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে রাহেলার মেনোপোজ হবার পর থেকে। তখন থেকেই রাহেলা জামিল সাহেবের সাহচর্যে আগের মত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। প্রায়শই বিরক্তি প্রকাশ করতেন। তার ওপর নতুন উপদ্রব শুরু হল হটফ্লাশ। প্রায়ই হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে রাহেলার হটফ্লাশ শুরু হয়। হঠাৎ গরম লেগে ওঠা, ঘাম হওয়া, বুক ধড়ফড়, অনিদ্রা। একসময় দু’জনেরই শান্তিপূর্ণ ঘুমের কথা চিন্তা করে পৃথকবিছানা এবং ঘরের ব্যাবস্থা মেনে নিয়েছিলেন জামিল সাহেব। একমাত্র মেয়ে রূপা’র বিয়ে এবং দুই ছেলে রনি ও জনি’র বিদেশে চলে যাবার পর এমনিতেই এপার্টমেন্টে ওদের ঘরগুলো খালিই পড়েছিল।
তিনি নতুন বৌকে ডেকে কাছে বসালেন। বললেন, ‘পারুল, আমার এই বয়সে বিয়ে করার কথা না। কোন ইচ্ছেও ছিল না। তুমিতো বিয়ের আলোচনার শুরু থেকেই সব জান। তোমার মামা আমার কলিগ হবার কারনে, এবং তোমাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় এই বিয়ের প্রপোজাল আমার কাছে এসেছিল। ভেঙ্গে পড়া সংসার, অসুস্থ স্ত্রী ও আমাকে দেখাশোনার জন্য একজন বিশ্বস্থ মানুষ আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল।
তুমি যদি আমার অসুস্থ স্ত্রীর প্রতি খানিকটা মমতা দেখাও, আমার এই ভেঙ্গে পড়া সংসারটা আপন করে নাও আমি অনেক সুখী ও আনন্দিত হবো। বিনিময়ে আমি তোমার পরিবারকে সাধ্যমত সাহায্য সহযোগীতা করবো। তোমাকে কথা দিলাম।’
জামিল সাহেব কথাগুলো বলে একধরনের অপরাধবোধ থেকেও কিছুটা নিস্কৃতি পেলেন। তার মন খানিকটা হাল্কা হল। পাশাপাশি একটা আনন্দমিশ্রিত শিহরণও অনুভব করতে লাগলেন। তিনি নিজের মনের এধরনের মিশ্র অনুভূতির সাথে পরিচিত নন। তাই মনেমনে অপ্রস্তুত ও বিব্রতবোধ করতে লাগলেন।
তারই বিছানায়, একান্ত নিরিবিলিতে, তার সামনে বসে আছে এক তুরুনী। যার উপর আজ থেকে রয়েছে তার পরিপূর্ণ অধিকার। তার বহুদিনের বুভুক্ষু শরীর ও মন বেসামাল হয়ে উঠতে চাইছে।কিন্তু একটা জড়তা, শালীনতাবোধ এসে তার দু’হাত আর শরীরকে যেন অবশ করে দিচ্ছে।
তিনি তরুনীর মুখটি দু’হাতে তুলে ধরে তার প্রশস্ত ললাটে নিজের শুকনো ঠোঁট ছোঁয়ালেন। তারপর বললেন, ‘পারুল, ঘুমিয়ে পড়। আজ সারাদিন তোমার মন ও শরীরের উপর অনেক ধকল গেছে।’
পারুল তার প্রায় বৃদ্ধ স্বামীর উদারতা ও সৌজন্যবোধ দেখে বিস্মিত হল। বিনিময়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হল! তার দু’চোখ জলে ভরে উঠলো। জামিল সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি কাঁদছো কেন পারুল? বাড়ির কথা মনে পড়ছে? আমি কি তোমার মনে কোন কষ্ট দিয়েছি?’ উত্তরে পারুল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নিজের বাবা’র অভাবে জর্জরিত সংসার, ঋণের দায়ে পাওনাদারদের গন্জনা, ছোট ভাইবোন দু’টোর লেখাপড়া এইসব কিছুর একটা সুনিশ্চিত ব্যাবস্থা হবে জানতে পেরেই এই প্রায়বৃদ্ধ মানুষটির সাথে বিয়েতে মত দিয়েছিল পারুল! বিয়ের আগেই তার বাবা’র হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন জামিল সাহেব। তাতেও এই মানুষটির প্রতি তার মন টানেনি। কিন্তু বাসর রাতের শয্যায় মানুষটির এই উদারতা পারুলকে সত্যি সত্যি খুব বড় একটা স্বস্তি এনে দিল। মানুষটি পশুর মত তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে অধিকার আদায় করেনি বলেই তার প্রতি একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত কৃতজ্ঞতা অনুভব করলো পারুল!।
(৪)
খুব ভোরে রাহেলা বেগমের ঘুম ভেঙ্গে গেল। অসুস্থ হবার পর সচরাচর তার এত ভোরে কখনও ঘুম ভাঙ্গে না। তিনি অনুভব করলেন, গতরাতে তার খুব ভালো ঘুম হয়েছে। শরীর ও মন দু’টোই বেশ ঝরঝরে লাগছে। গতরাতের প্রচন্ড মন খারাপ, অভিমান ও দূর্ভাবনার গ্লানী আজ আর অবশিষ্ট নেই। স্বামীর এই দ্বিতীয় বিয়েতে তার অনুমোদন ছিল বলেই এই বিয়েটি হতে পেরেছে। এখানে জামিলকে আসামীর কাঠ গড়ায় দাঁড় করানো যৌক্তিক নয়।
দীর্ঘ কয়েকটি বছর ধরেই তিনি দূরারোগ্য এক মরণব্যাধিতে ভূগছেন। যতই দিন যাচ্ছে এই ব্যাধি কালসাপের মত তার শরীরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। বাঁচার আশা ক্রমশই ফিকে হয়ে আসছে। যদিও অসুখের শুরুটা তিনি বা তার স্বামী কেউই তেমন গুরত্ব দেননি। তাছাড়া নিজের বাম স্তনের ভেতরে শক্ত গুঁটিটির উপস্থিতি তিনি নিজে যখন টের পেয়েছিলেন, তখন লজ্জা বা জড়তার কারনে তিনিও প্রকাশ করতে চাননি। ব্লাউজ খুলে ডাক্তারকে দেখানো, এসব নিয়ে আলোচনা করতে হবে ভাবতেই তার অস্বস্তি লাগতো। পরে একটা সময় জামিলের সাথে শেয়ার করতে বাধ্য হলেন। শুরুতে বেশ কিছুদিন হোমিওপ্যাথ চিকিৎসাও করিয়েছিলেন। পড়া তেল, তাবিজ-কবজও বাদ দেননি তিনি। জামিলও কখনও এ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার দেখানোর জন্য জোড় করেননি। লজ্জা, সংস্কার এবং একরকম হেলাফেলার কারনে সেই নির্দোষ ছোট্টগুঁটিটি যে একসময় এমন ভয়ঙ্কর বিষাক্ত হয়ে উঠবে তা তিনি বা জামিল সাহেব কল্পনাও করেননি।
ঠিক তখনই এক দাওয়াতের বাড়িতে রাহেলার সাথে দেখা এবং পরিচয় হয়ে গেল ইয়াসমীন রব্বানীর সাথে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে পাশ করা মেয়ে। শিক্ষকতা করেন। লেখালেখি করেন কাজের অবসরে। নারী মহলের নানারকম গল্প ও কথার মাঝে তিনি সবার সাথেই শেয়ার করলেন তার স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কথা। চিকিৎসার কথা। জানালেন ক্যানসারের সাথে বসবাস করা তার জীবনী গ্রন্থ “অন্দর মহল ও আমার ক্যান্সার” বইটির কথা। বইটিতে কত অকপটে তিনি তার রোগ এবং এর নানাদিক তুলে ধরেছেন। কোন রোগই লজ্জা বা গোপন করার বিষয় নয়। অসুখ হলে তার যথাযথ এবং সুচিকিৎসা কত প্রয়োজন।
তখনই রাহেলা বেগম তার সমস্ত লজ্জা, জড়তা পরিত্যাগ করে ইয়াসমীন রব্বানীর সাথে তার সমস্যার কথা নিয়ে আলাপ করলেন।শুনলেন, ইয়াসমীন আপা নিজে কী কী সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছেন। কিভাবে, কার কাছে, কোথায়, কোথায়, চিকিৎসা নিয়েছেন।
ইয়াসমীন রব্বানীর ডাক নাম লিলি। সবাই তাকে ডাকে ‘লিলি আপা’ বলে। রাহেলা লিলি আপার অনুরক্ত হয়ে পড়লেন। ফোন নম্বর বিনিময় করলেন লিলি আপার সাথে। নিজের কুসংস্কার ও অজ্ঞতার জন্য অনুতাপ হল তার। লিলি আপা জানালেন ‘কেমো থেরাপি’র পর কিভাবে তার মাথার সমস্ত চুল, ভ্রু, চোখের পাপড়ি ঝড়ে পড়ে গেছে। কিন্তু সেই অবস্থায়ও তিনি বাইরে গেছেন, দাওয়াতে গেছেন। কাজ করেছেন। লিলি আপা অভিযোগের স্বরে বললেন, “মেয়েরা শুধু পরিবারের কথা ভাবে। নিজের কথা কখনও ভাবে না। আমাদের দেশে স্তন শব্দটা উচ্চারণ করাই যেন লজ্জার ব্যাপার। তাই স্তন নিয়ে সবার সাথে আলোচনা করা যায় না। তাছাড়া নারী নিজেই বা স্বামীরা চাননা কোন পুরুষ চিকিৎসক তার স্তন পরীক্ষা করে দেখুক।স্বামীর সহযোগীতা ছাড়া চিকিৎসা নেয়াও সম্ভব না। স্তন ক্যান্সার খুব অস্বস্তিকর একটি ব্যাপার। তাই এর চিকিৎসা শুরু করতে প্রায়শঃই খুব দেরী হয়ে যায়!”
লিলি আপার পরামর্শে শুরু হল রাহেলার বড় বড় ক্যান্সারের ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি। চিকিৎসা। একে একে কত ডাক্তারের সাথে তাদের পরিচয় হল। আ্যাপোলো হাসপাতালের ডাঃ নাজিয়া শুভ্রা, ইব্রাহীম মেডিকেলের শারমীন রহমান, ঢাকা মেডিকেলের জসিমউদ্দীন। আরও কত ডাক্তার, নার্স। শুরু হল রাহেলা বেগমের চিকিৎসা। ডাক্তার তাকে মেমোগ্রাফি, এফএনসি, আল্ট্রাসোনো সহ আরও একগাদা টেস্ট করতে দিলেন। তারপর অপারেশন। বায়োপ্সির রেজাল্টে এলো স্তন ক্যান্সারের খবর।শুরু হল কেমো দেয়া। অসহ্য যন্ত্রনাময় জীবন।শরীরময় জ্বালাপোড়া। খাবারে অনিহা। বমিভাব। নিদ্রাহীনতা। সব চুল পড়ে গেল। একপর্যায়ে কোলকাতায়ও যাওয়া হল চিকিৎসার জন্য।কিন্তু সবাই সেই একই কথা বললেন, “বড় দেরী করে ফেলেছেন!”
লিলি আপা তার বুদ্ধি, আধুনিকতা এবং সাবলীল মনোভাবের জন্য স্তন ক্যান্সারকে জয় করে জীবনের দিকে এগিয়ে গেলেন।কিন্তু রাহেলা বেগম হেরে যেতে লাগলেন। চিকিৎসা শুরু হতে হতে, ততদিনে তিনি ক্যান্সারের তৃতীয় ধাপ অথ্যাৎ স্টেজ থ্রিতে পৌঁছে গেছেন। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় হরমোন থেরাপি থেকে শুরু করে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি এবং অনেক ওষুধের প্রয়োজন হয়।এর প্রতিটি ধাপেই বড় অংকের অর্থ গুণতে হয়।
প্রথম পর্যায়ে অপারেশন করতেই পাঁচ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়ে গেল। এরপর ধাপে ধাপে চিকিৎসা ব্যয় কেবল বেড়েছে। তখন তিন ছেলে-মেয়েই লেখা-পড়ার মধ্যে ছিল। একসময় হতাশা এসে ভর করলো। রাহেলাই একসময় জামিল সাহেবকে বললেন, ‘আর চিকিৎসা করে কি হবে? চেক আপ করাতে গেলেই প্রতিবার অনেক টেস্ট দেয়, তাতে অনেক টাকা লাগে।’ তখন জামিল সাহেব বলেছিলেন, ‘এসব চিকিৎসা, অপারেশন সত্যিই ব্যায় সাপেক্ষ, তারপরও চিকিৎসাতো করতেই হবে।’
চিকিৎসা ঠিকই চলছে। কিন্তু শরীর সেভাবে চলছে না। মাঝেমধ্যে যখন শরীরে একটু প্রাণ ফিরে আসে তখন অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে আবার নতুন করে সংসার সাজাতে। নিজের হাতে রান্না করতে। চুলে শ্যাম্পু করে গায়ে সুগন্ধি সাবান মেখে লম্বা সময় ধরে গোসল করতে। কত কী করতে মন চায়, যা বহুদিন করা হয় না। কতদিন পেটপুরে, খুব তৃপ্তি করে একথালা ভাত খাননি।
ঘুম ভেঙ্গে রাহেলা বেগম অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করলেন। আকাশকুসুম অনেককিছু ভাবলেন। অনুমান করলেন, বুয়া এখনও আসেনি। তাই নিজেই উঠে কোনক্রমে বাথরুমে গেলেন। প্রাতকৃত্য সেরে, হাতমুখ ধুয়ে এলেন। ড্রেসিংটেবিল থেকে ক্রিম নিয়ে মুখে লাগালেন। তারপর খাটে বসে হাতে চিরুনী নিয়ে চুল আচড়াতে বসলেন। চুল নেই বললেই চলে। তবুও খানিকক্ষণ পড়েই তার হাত ভেঙ্গে আসতে লাগলো। তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। চুপ করে বসে খোলা জানালা পথে বহুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলেন রাহেলা। ভোরের সূর্যের নরম আলোতে তার চোখের সামনে একটি ধ্রুব সত্য যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো,
“এই সংসারে নতুন এক গৃহকতৃর আগমন ঘটেছে। স্বামী এবং সংসারের উপর যার থাকবে পরিপূর্ণ অধিকার। রাহেলা ইতোমধ্যেই সেই অধিকার থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। সুতরাং আজ থেকে এই সংসারে একজনকে হতে হবে ‘তৃতীয় পক্ষ’! “
(৫)
পারুলের ঘুম ভাঙলো একটু বেলা করে। চোখ খুলেই প্রথমে তার নজরে এলো পাশের ঘুমন্ত মানুষটির প্রতি। জড়সড় হয়ে বিছানার এককোনে শুয়ে আছেন জামিল সাহেব। তার ফর্সা পায়ের উপর পাজামাটি অনেকখানিই উঠে হাঁটুর নীচের অংশটুকু অনাবৃত করে রেখেছে। তার পায়ের গড়ন বেশ সুঠাম। মুখ দেখে যতটা ক্লান্ত মনে হয়, সেই তুলনায় তার শরীরের গঠন বেশ মজবুত। তিনি পারুলের দিকে পিঠ করে শুয়ে আছেন বলে মুখ দেখা যাচ্ছে না। গতরাতে কিছু ঘটাতো দূরের কথা, জামিল সাহেব একবার তাকে স্পর্শ করার চেষ্টাও করেননি। এমনকি দু’জনের মাঝখানে যথেস্ট দূরত্ব বজায় রেখেই তিনি ঘুমাচ্ছেন। এই ব্যাপারটা পুরুষ মানুষ সম্পর্কে তার শোনা সমস্ত ধারনাকে আমূল বদলে দিয়েছে। বাবার বয়সি একজন মানুষ প্রথম পরিচয়েই তার শরীরের উপর ঝাপিয়ে পড়লে শ্রদ্ধার পরিবর্তে হয়তো ঘৃণারই জন্ম হোত।
পারুল হাতমুখ ধুয়ে, পরিপাটি করে শাড়ি পরে চুল আঁচড়ে নিলো। সন্তর্পনে শোবার ঘরের দরজা খুলে বসার ঘরে গিয়ে দেখতে পেল একজন মধ্যবয়সি নারী এবং মিনা মিলে রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করছে। পারুলকে দেখতে পেয়ে নারীটি সহাস্য এগিয়ে এলো। বললো, ‘নতুন বেগম সাহেবা, আমি আসমার মা, আমি আফনেগো বাড়িত ছুডা কাম করি। রাইতে থাহনের ইচ্ছা আছিল, আসমার জ্বর আছিল, তাই গেছিগা। ‘
আসমার মা’র কথাটা খট করেই কানে বাজলো পারুলের। ‘আফনেগোর বাড়িত’! পারুল ড্রইংরুমের চারিদিকে চোখ বুলালো। বিলাসবহুল এই বাড়িটি তার?! তারপর খুব সহজভাবেই বললো, ‘আসমার মা, বড় আপা কি ঘুম থেকে উঠেছে? ‘ আসমার মা হাতের ডানদিকের খোলা দরজাটি দেখিয়ে বললো, ‘বিবিসাবের আইজ ঘুম ভাঙছে তাড়াতাড়ি। দেখলাম হাতমুখ ধুইয়া খাডে বইসা রইছে। আইসাই তারে রং চা বানাই দিলাম। সাথে একখান আটার রুটি। যান, হুনছি কাইল রাইতে বিবিসাবের লগে
আফনের দেহা হয় নাই । ‘
‘কার কাছে শুনলে?
‘ক্যান? মিনায় কইলো।
‘ওহ্, আচ্ছা।
পারুল খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এই ঘরটি তুলনামূলকভাবে বেশ বড়। বেশ খোলামেলা। সকালের উজ্জ্বল রোদে ঘর ঝলমল করছে। জানালায় পর্দা সরিয়ে রাখায় রোদ সরাসরি ঘরে এসে পড়েছে। ঝকঝকে পরিষ্কার ঘরটিতে তাই একটু উষ্ণভাব আছে। ঘরে দুটো চেয়ার রাখা আছে। একটা রাহেলার বিছানার পাশে। আরেকটি উল্টোদিকে রাখা পড়ার টেবিলের কাছে। টেবিলে একটি পানি ভর্তি কাঁচের জগ, গ্লাস, কিছু ওষুধপত্র রাখা আছে। বিছানার একপাশে একটি অক্সিজেন সিলেন্ডার দাঁড় করানো। সাথে জুড়ে দেয়া লম্বা টিউব গোল করে ফোল্ড করে রাখা।
পারুলের মনে হল, কেউ ঘরে আসবে, সেই অপেক্ষায়ই যেন বসে আছেন রাহেলা বেগম। পারুল কোন শব্দ না করে, ঘরের ভেতরে ঢুকলো। তারপর, খাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে রাহেলার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। রাহেলা বেগম শশব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘ওহ্, পারুল! সালাম করছো কেন?
‘জী আপা, আমি পারুল। আপনার শরীর ভাল?’
‘মৃত্যুপথযাত্রীর আর ভাল থাকা!তুমি বস, এই চেয়ারটায় বস। তোমরা নাস্তা খেয়েছো?’
‘জী না, এখনও খাইনি। কালরাত্রে আপনার সাথে দেখা করতে আসছিলাম। আপনি ঘুমাই পড়েছিলেন। তাই আর জাগানো হয় নাই।’
‘হ্যা, সহজে ঘুম হয়নাতো। তাই একবার ঘুমালে কেউ আর আমাকে ডাকে না। আমি সকালে চা, রুটি খেয়েছি।তোমরা খেয়ে নাও।’
পারুল গভীর দৃষ্টিতে রাহেলার মুখের দিকে তাকালো। গলায় সহানুভূতি এনে বললো, ‘আপা, আপনার কাছে কিছুক্ষণ বসি?’
‘বেশতো বস। রোগীর ঘরে বসতে কার ভাল লাগে বল?’
‘উনি বলেছেন, আপনার দেখাশোনা আর সেবা করতে। আপা, যখন যা করতে হবে, যা দরকার হবে, আমাকে বলবেন।
‘মাত্রইতো এলে। তাছাড়া বুয়া আছে, মিনা আছে। অসুবিধা হয় না। সবাই সেবা করতে পারবে, কিন্তু শরীরের যন্ত্রনাতো কেউ কমাতে পারবে না বোন। নতুন বাড়িতে এসেছো, তোমার সুবিধা অসুবিধা দেখার সাধ্যতো আমার নাই। তবুও কোন কিছু দরকার হলে তুমিও আমায় বলবে। তোমার বয়স কম। এখন থেকে এটা তোমারও সংসার। সবকিছু বুঝেশুনে নিও।’
ইতোমধ্যে জামিল সাহেবও দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ইতস্তত ভাব নিয়ে স্ত্রীর পাশে খাটে যেয়ে বসলেন। কপালে হাত রেখে বললেন, ‘শরীর কেমন? রাতে ভাল ঘুম হয়েছে?’
‘হ্যা, ঘুম হয়েছে। নতুন বৌকে এবার সংসারের সবকিছু ভাল করে বুঝিয়ে দাও।’
কথা শেষ করেই তিনি বালিশের তলা থেকে একটি বড় চাবির গোছা বের করলেন। সেটি স্বামীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘ভালই হল, আমাকে আর সংসার, টাকা-পয়সা, হাট-বাজার এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।’
তারপর পারুলের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, ‘ঘরের কোথায় কি থাকে ধীরেসুস্থে দেখে নিও পারুল। তোমরা এখন যাও। বেলা হল, নাস্তা খেয়ে নাও। আমি একটু শুয়ে থাকবো এখন। জানালার পর্দাগুলো একটু টেনে দিয়ে যাও। আজকের রোদ বড্ড কড়া!’
জামিল সাহেব চাবির গোছা হাতে নিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে উঠলেন। তারপর জানালার পর্দা টেনে দিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। তার পেছন পেছন পারুলও বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
(৬)
রান্নাঘরে রুটি বেলতে বেলতে আসমার মা’র মনটা একটু বিষন্ন হয়ে উঠলো। বড় বেগমসাব অসুস্থ থাকায় রান্নাঘরের পুরা কর্তৃত্বই ছিল আসমার মার নিজহাতে। সাহেব কোনদিন কোন কিছুর হিসাব নিতো না। বেগমসাবও শরীর খারাপ লাগলে বেশীরভাগ সময়ই বিছনায় পড়ে থাকে। কখনও খুব একটা জিনিসপত্রের খোঁজখবর করে না। বরং খোঁজখবর করে আসমার মাকে ঘাটাতে সাহসও পায় না। হাতে টাকাপয়সা না থাকলেও আসমার মায়ের মাথায় বুদ্ধির কোন অভাব নেই। তার নিজের সংসারটি ধরতে গেলে পুরাটাই চলে এই বাসারই হাঁটবাজার, টাকা-পয়সা দিয়ে।
আসমার মা বুঝতে পারছে তার সুদিন এবং স্বাধীনতা দু’ই খর্ব হতে চলেছে। সে শুনেছে পারুল নামের এই মেয়েটি এসেছে গরীবের ঘর হতে। ধরেই নেয়া যায় অভাবী সংসার হতে আসা এই মেয়ের মন তেমন উদার হবে না। সে জিনিষপত্র রাখবে চোখে চোখে। বাজার-সদাই করবে হিসেব করে। মাসকাবারি বেতন ছাড়া বারতি কোন বখশিশও দিতে চাইবে না। খুব সঙ্গত কারনেই নতুন বৌয়ের উপর তার মন তেমন প্রসন্ন হল না। কিন্তু মনের ভাব চেপে রেখে সে যথাসাধ্য হাসিমুখ করে নতুন বেগম সাহেবার খাতির যত্ন করতে লাগলো।
পারুলকে সে কোন কাজে হাত লাগাতে দিল না। পারুল কোন কাজ করতে গেলেই সে দৌড়ে এসে বলে, ‘বেগম সাব, আপনি রাখেন, আপনি রাখেনতো। আমি আছি ক্যান? আপনি নতুন বৌ। নতুন বৌ কাম করলে মাইনষ্যে কি কইবো? ‘
পারুল মুখে কিছু বলে না। কিন্তু তার নারী মন এবং অনুসন্ধানি চোখ বলে দিতে পারে, এই বাড়িতে তার উপস্থিতি এই বুয়ার জন্য সমস্যা তৈরি করেছে।সে কেবল কথায় কথায় মুচকি হাসে। এবং মনেমনে জানে খুব দ্রুতই তাকে এই সংসারের হাল ধরতে হবে। জেনে নিতে হবে সংসারের সব খুঁটিনাটি। অগোছালো সংসারটি গুছিয়ে তোলা এবং কাজের বুয়ার হাতে জিম্মি হয়ে পড়া এই সংসারটি পুনর্উদ্ধার করাই জামিল সাহেবের দ্বিতীয় বিয়ের আরেকটি কারন। তাছাড়া, রাহেলা বেগমের জীবনকাল এখন কেবল হাতেগোনা কয়েকটি মাস মাত্র। সেই ধেয়ে আসা ঘূর্ণীঝড়টি সামাল দিতে জামিল সাহেবের পাশে একজন মানুষের খুব প্রয়োজন ছিল।
পারুল মনে মনে ঠিক করলো, রাহেলার জীবনের শেষক’টি দিন সে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে তাকে নিশ্চিন্তে এবং শান্তিতে রাখতে।তার মন জুগিয়ে চলতে।মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি যেন চলে যাবার আগে জানতে পারেন, পারুলের হাতে তার গড়ে তোলা সংসার এবং সন্তানদের কোন অযত্ন হবে না । বয়স কম হলেও এটুকু সে অনায়াসেই করতে পারবে।
(৭)
নতুন খালাম্মাকে পেয়ে মিনা খুব খুশি। রাহেলা খালা বেশীরভাগ সময় পড়ে পড়ে ঘুমায়। শরীরে ব্যাথা বাড়লে কষ্টে কান্নাকাটি করেন। মিনার তখন খুব কষ্ট হয়, মন খারাপ হয়। সে খালার হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দেয়। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সারাক্ষণ পাশে বসে থাকে। আবার ফাঁকে ফাঁকে ছুটাবুয়াকেও সাহায্য করতে হয়। এসবই তার কাজ। খালাম্মা খালু খুব ভালো মানুষ। তারা তাকে খুব আদর করে। তবুও এই বাড়িতে তার কোন আনন্দ ছিল না। এখন নতুন খালাম্মা আসায় ঘরে যেন আনন্দ ফিরে এসেছে। রূপা আপা, রনি এবং জনি ভাইরা বিদেশ চলে যাবার পর বাড়িটি যেন শুধু ‘অসুখবাড়ি’ বা ‘কান্নাবাড়ি’ হয়ে উঠেছিল। এখন তার কাজ ঘরের সব ফার্নিচার মোছামুছি করা। তারপর অবসর সময় বড় খালাকে দেখাশোনা করা। তবে এখন তার কাজে অনেক আনন্দ ফিরে এসেছে। এখন বাড়িতে টেলিভিশন চলে। নতুন খালা তাকে টেলিভিশন দেখতে ছুটি দেন। খালু এখন অবসর সময় দুই খালাম্মাকে সাথে নিয়ে লুডো খেলে। নতুন খালা তাকেও খেলতে ডাকেন।
খালু আর রাহেলা খালাকে বহুদিন হাসতে দেখেনি মিনা। আজকাল তারা প্রায়ই হাসাহাসি করে গল্প করেন। নতুন খালা রাহেলা খালাকে হাত ধরে খাবারের টেবিলে এনে বসান। তারা তিনজন একসাথে বসে রাতের খাবার খান।
তবে আসমার মার এখন আর এই বাড়িতে কাজ নেই। তার জায়গায় নতুন বুয়া এসেছে গ্রাম থেকে। সে নতুন খালার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। মধ্যবয়স্ক বিধবা। ছেলেপুলে নেই। গ্রামে নিঃসঙ্গ একাকী জীবন ছিল তার। পারুল তাকে এনে রান্নাঘরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। মানুষটিরও মিলেছে নিরাপদ আশ্রয়। পারুল অত্যন্ত মমতা দিয়ে নিজের সতীনের সেবা, দেখাশোনার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে।
জামিল সাহেব বিস্মিত হয়ে তার দুই স্ত্রীকে লক্ষ্য করেন। এবং তৃতীয় পক্ষ নির্ধারনী কোন সম্ভাব্য যুদ্ধের দূরাভাষ না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন!
( গল্পটি ক্যানভাস গ্রুপের লেখক ইয়াসমীন রাব্বানী’কে উৎসর্গ করে লেখা। তার লেখা জীবনী “অন্দর মহল ও আমার ক্যান্সার” বইটি আমাকে অভিভূত ও অনুপ্রানিত করেছে এই গল্পটি লিখতে। কৃতজ্ঞতা লেখকের কাছে।)
লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক
আরও পড়ুন